অসহযোগের প্রথম দিনে যেমন ছিল সিলেট
সরকার পতনের এক দফা দাবিতে ছাত্র-জনতার চলমান সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনের প্রথম দিনেই সংঘর্ষ, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগে নগরীসহ প্রায় পুরো সিলেট ছিল অগ্নিগর্ভ। জেলার গোলাপগঞ্জ উপজেলায় সংঘর্ষের গুলিতে ৫ জন নিহত হয়েছেন। নগরীসহ বিভিন্ন স্থানে সংঘর্ষে আহত হয়েছেন সাংবাদিক ও পুলিশসহ প্রায় ৪ শতাধিক। বিভিন্ন সরকারি স্থাপনায় অগ্নিসংযোগ করেছেন আন্দোলনকারীরা।
রোববার (৪ আগস্ট) সকাল থেকে রাত পর্যন্ত থমথমে পরিবেশ বিরাজ করছিল পুরো সিলেট নগরীজুড়ে। সন্ধ্যার পর থেকেই যেন ভুতুড়ে নগরীতে পরিণত হয়েছিল সিলেট। রাস্তাঘাটে মানুষ ও যানবাহন চলাচল প্রায় ছিল না বলা চলে।
কেমন ছিল অসহযোগ আন্দোলনের প্রথম দিন সিলেটের পরিবেশ সংক্ষেপে পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো-
মাইকে ঘোষণা দিয়ে পুলিশ-বিজিবি ও ছাত্র-জনতার দিনভর সংঘর্ষ, নিহত ৫
সংঘাতের শুরু সিলেটের গোলাপগঞ্জের ঢাকা দক্ষিণ থেকে। রোববার সকাল ১১টার দিকে সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলার ঢাকাদক্ষিণ বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজের সামনে বিক্ষোভকারীদের ধাওয়ায় স্থান ত্যাগ করেন গোলাপগঞ্জ উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) অভিজিত চৌধুরী, গোলাপগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাছুদুল আমীন ও বিজিবির টহল টিম। এসময় বিজিবির টহল টিমের গাড়ি ভাঙচুর করা হয়।
পরবর্তীতে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েনসহ বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে টিয়ারশেল, গুলি ছুড়ে ছত্রভঙ্গ করে দেয়া হয়। এরপর গোলাপগঞ্জ পৌর শহর ও উপজেলার বিভিন্ন স্থানে দিনভর ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া ও সংঘর্ষ চলে। এতে ৫ জন নিহত হয়েছেন বলে জানা গেছে।
জিন্দাবাজার-বন্দরবাজারে পুলিশ ও আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষ:
পূর্বঘোষিত কেন্দ্রের নির্দেশনা অনুযায়ী বেলা সাড়ে ১১টার দিকে নগরীর বন্দরবাজারের কোর্ট পয়েন্টে জড়ো হতে থাকেন আন্দোলনকারীরা। আন্দোলনে সাধারণ ছাত্র ছাড়াও ছাত্রদল ও শিবির ছিল বলে জানিয়েছেন প্রত্যক্ষদর্শীরা। তারা জড়ো হয়ে বিক্ষোভ করতে শুরু করলে ১২টার দিকে পুলিশের সঙ্গে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও পরে তুমুল সংঘর্ষ শুরু হয়। এসময় আন্দোলনকারীরা পুলিশের দিকে ইট-পাটকেল ছুড়ে এবং পুলিশ তাদের দিকে গুলি, টিয়ারশেল ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। ফলে আন্দোলনকারীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। তাদের বড় একটি অংশ জিন্দাবাজারের দিকে আসে। কিছুক্ষণ পর ফের তারা বন্দরবাজারের দিকে যায় এবং পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়। একপর্যায়ে পুলিশের সঙ্গে এসে যোগ দেন ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতাকর্মীরা। এসময় তাদের হাতে আগ্নেয়াস্ত্রসহ বিভিন্ন অস্ত্র দেখা যায়। তারা এসে আন্দোলনকারীদের ধাওয়া দিলে তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে নয়সড়কের যায় এবং এ জায়গাসহ নাইওরপুল ও উপশহর পয়েন্টে ছড়িয়ে পড়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বন্দরবাজার এলাকার ছাত্রলীগ-যুবলীগের দখলে ছিলো।
সিলেট আঞ্চলিক নির্বাচন কমিশন অফিস ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ:
বিকাল ৪টার দিকে সিলেট আঞ্চলিক নির্বাচন কমিশন অফিস ও এর পার্শ্ববর্তী মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ভবনে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে আন্দোলনকারীরা। এসময় নির্বাচন অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দুটি মোটরসাইকেল ও দুটি জিপ গাড়ি আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। বিকাল সাড়ে ৫টার দিকে ফায়ার সার্ভিসের টিম গিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে।
প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা গেছে, দুপুর ২টা থেকে নগরীর শাহজালাল উপশহর পয়েন্টে কয়েক শ আন্দোলনকারী জড়ো হয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন। এসময় তাদের হাতে লাঠি-সোটাসহ বিভিন্ন রকমের অস্ত্র দেখা যায়। বিকাল ৪টার দিকে হঠাৎ তারা পয়েন্ট সংলগ্ন সিলেট আঞ্চলিক নির্বাচন কমিশন অফিস ও মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ভবনে হামলা ও ভাঙচুর শুরু করেন। নির্বাচন কমিশন অফিসের সামনে থাকা দুটি মোটরসাইকেল ও গ্যারেজে থাকা দুটি জিপ গাড়িতে অগ্নিসংযোগ করেন। এতে গাড়িগুলো পুড়ে ছাই হয়ে যায়। এছাড়া নির্বাচন কমিশন অফিসের বিভিন্ন কক্ষে ঢুকে আন্দোলনকারীরা ব্যাপক ভাঙচুর চালান।
মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ভবনে ভাঙচুর:
মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ভবনের ভেতরে ঢুকতে না পেরে গ্লাস ভাঙচুর করে দুর্বৃত্তরা। খবর পেয়ে বিকাল সাড়ে ৫টার দিকে ফায়ার সার্ভিসের একটি টিম গিয়ে নির্বাচন অফিসের গ্যারেজের আগুন নিভায়।
কাস্টমস অফিস ভাঙচুর:
বিকেল ৫টার দিকে আন্দোলনকারীরা মেন্দিবাগ কাস্টমস এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেট অফিসে হামলা চালায়। এসময় অফিসের বাহিরের দিকে গ্লাস ভাঙচুর করে তারা। একই সময় কর ভবনেও হামলা হয়। এসময় ভেতরে থাকা কর্মকর্তা ও কর্মচারীর মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। প্রায় এক ঘন্টা ভেতরে অবরুদ্ধ ছিলেন তারা। পরে পুলিশে এসে আন্দোলনকারীদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়।
এমপি হাবিবের কার্যালয় ভাঙচুর:
সিলেট-৩ আসনের সংসদ সদস্য ও সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য হাবিবুর রহমান হাবিবের অফিসে ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগ চালিয়েছেন আন্দোলনকারীরা। রোববার দুপুর ২টার দিকে দক্ষিণ সুমরার চন্ডিপুলস্থ অফিসে এই হামলা হয়। এসময় অফিসের সামনে থাকা ১০-১২টি মোটরসাইকেলে আগুন দেয়।
এ ব্যাপারে সংসদ সদস্য হাবিবুর রহমান হাবিব গণমাধ্যমকে বলেন, আমার অফিস বন্ধ ছিলো। এক দল দুর্বৃত্ত অফিসের সামনে আগুন ধরিয়েছে। তবে কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি বা কেউ হতাহত হননি।
নগরীর বিভিন্ন স্থানে দিনভর ধাওয়া-পাল্টা ও সংঘর্ষ:
এদিন দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত নগরীর জিন্দাবাজার, চৌহাট্টা, বারুতখানা, জেলরোড, হাওয়াপাড়া, মিরবক্সটুলা, নয়াসড়ক ও আম্বরখানাসহ বিভিন্ন স্থানে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশ ও ছাত্রলীগ-যুবলীগের খণ্ড সংঘর্ষ হয়। সন্ধ্যার দিকে কুমারপাড়া এলাকায় কয়েকটি মসজিদে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতাকর্মীদের ঠেকাতে ঘোষণা দেওয়া হয়। পরে ওই এলাকায় আন্দোলনকারী ও এলাকাবাসীর সঙ্গে ছাত্রলীগ-যুবলীগের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায়। পরে সেনাবাহিনী বাহিনী এসে জনসাধারণকে বুঝিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে।
চার সাংবাদিক আহত:
পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে চার সাংবাদিক আহত হয়েছেন। ভাঙা হয়েছে ক্যামেরা। আহতরা হলেন- চ্যানেল এস সিলেট অফিসের চিফ রিপোর্টার মঈন উদ্দিন মনজু, একাত্তর টেলিভিশনের রিপোর্টার হোসাইন আহমদ সুজাদ ও ক্যামেরাপার্সন তারেক আহমেদ ও যুগান্তরের ফটো জার্নালিস্ট মামুন হাসান।
এরমধ্যে চ্যানেল এস সিলেট অফিসের চিফ রিপোর্টার মঈন উদ্দিন মনজুরের পায়ে গুলি লাগে। দুপুরে আন্দোলনকারীদের মারধরে আহত একাত্তর টেলিভিশনের রিপোর্টার হোসাইন আহমদ সুজাদ সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নেন। এছাড়া পুলিশ-আন্দোলনকারী সংঘর্ষকালে গুলিবিদ্ধ হন যুগান্তরের আলোকচিত্রী মামুন হাসান। তিনিও চিকিৎসা নিয়েছেন।
উত্তপ্ত বিশ্বনাথ পৌরশহর:
অসহযোগ আন্দোলনের প্রথম দিনে উত্তপ্ত ছিল বিশ্বনাথ পৌরশহর। পৌর শহরের আল-হেরা শপিং সিটির সামনে জামায়াত-শিবির নেতাকর্মীদের সঙ্গে ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও পুলিশের সংঘর্ষ চলে। এসময় উভয় পক্ষের প্রায় ১৫ জন আহত হয়েছেন বলে জানা গেছে। পরে থানাপুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।
সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের উপকমিশনার আজবাহার আলী শেখ বলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ দিনভর তৎপর ছিল। তিনি নিজেসহ বেশকিছু পুলিশ আহত হয়েছেন বলে জানান।
সিলেটের পুলিশ সুপার আব্দুল মান্নান গণমাধ্যমকে জানান, গোলাপগঞ্জে সংঘর্ষে নিহত হওয়ার খবর পেয়েছি। তবে এর সংখ্যা এখনো জানতে পারিনি। পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে।