রাজারবাগে শোকের ছায়া, ক্ষোভের কালো মেঘ

  • অভিজিত রায় (কৌশিক), স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, ঢাকা
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

রাজারবাগে শোকের ছায়া, ক্ষোভের কালো মেঘ

রাজারবাগে শোকের ছায়া, ক্ষোভের কালো মেঘ

কোটা সংস্কার আন্দোলন দিয়ে শুরু, সরকার পতন দিয়ে শেষ। ছাত্র-জনতার লাগাতার আন্দোলন, আর দফায় দফায় কর্মসূচি ঘিরে দেশজুড়ে সংঘাত-সংঘর্ষ-প্রাণহানির পর প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনার। টানা ১৬ বছরের স্বৈরশাসনের পর আন্দোলন ও তোপের মুখে ক্ষমতা ছেড়ে দেশত্যাগের পরই লাখ লাখ সাধারণ বিক্ষুব্ধ জনতা ঘেরাও করেন আওয়ামী লীগের সভানেত্রীর (সরকারি বাসভবন) গণভবন, রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন থানা, দলটির বিভিন্ন কার্যালয়সহ বিভিন্ন স্থাপনায়। হামলা চালানো হয় সেখানে। ভেঙে দেওয়া হয় বিভিন্ন স্থাপনা, করা হয় লুটপাট, লাগানো হয় আগুন।

মূলত আন্দোলনের শুরু থেকে সরকারের পক্ষে আন্দোলনকারীদের দমনে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছে পুলিশ। গণঅভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতার রোষানলের শিকার হয়েছেন মাঠ পর্যায়ের পুলিশ সদস্য ও বাহিনীটির গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা।

বিজ্ঞাপন

গত কয়েকদিন ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলার কয়েকশো থানা ও পুলিশ স্থাপনা অগ্নিসংযোগ-ভাঙচুর করা হয়েছে।


সোমবার (৫ আগস্ট) সরকার পতনের পর পুলিশ সদর দফতরেও অগ্নিসংযোগ করা হয়। এমন অবস্থায় জীবনের শঙ্কায় কর্মবিরতির ঘোষণা দেয় ‘বাংলাদেশ পুলিশ অধস্তন কর্মচারী’ ব্যানারে পুলিশের একটি অংশ।

বিজ্ঞাপন

এদিকে সংঘাতের ঘটনার পর থানা ছেড়ে পালিয়ে যান পুলিশের অনেক কর্মকর্তা। আবার অনেকেই আটকে পড়েন থানায়। দুর্বৃত্তদের থানায় চালানো হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় নিহত হন নিম্নপদস্থ অনেক কর্মকর্তা। আগুনে পোড়া ও পিটিয়ে হত্যা করা এসব মরদেহ নিয়ে আশা হয় রাজারবাগ পুলিশ লাইনে।

ফলে সহকর্মীদের পোড়া ক্ষত-বিক্ষত লাশের স্তূপে ভারি হয়ে উঠে রাজারবাগ পুলিশ লাইনের আকাশ। সহকর্মীদের নির্মম মৃত্যুতে তাদের মনে বাসা বেঁধেছে শোকের ছায়া। একই সঙ্গে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অসহযোগিতায় এমন নির্মম মৃত্যুতে প্রাণ হারানো কর্মীদের সহকর্মীদের মনে জমাট বেঁধেছে ক্ষোভের কালো মেঘ।

এদিকে বার্তা২৪.কম একটি সূত্র মারফত জানতে পারে, এখন পর্যন্ত লাশ বুঝিয়ে দেওয়া ও দাফন শেষ হয়েছে ২৬ থেকে ২৭ লাশের। এছাড়াও গত রাতে আনুমানিক ৩০ থেকে ৪০টা লাশ ছিল। একই সঙ্গে ডিউটির উদ্দেশ্যে ইস্যু হওয়া ৩৩০ থেকে ৩৪০-এর মতো অস্ত্র এখনও ফেরত আসেনি।


ফলে ডিউটিরত অবস্থায় সংঘাতের ঘটনায় নিহত পুলিশ সদস্যদের সুরক্ষা না দিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের পলায়নের ঘটনায় ক্ষোভ বিরাজ করছে রাজারবাগ পুলিশ লাইনের অধস্তন কর্মকর্তাদের মধ্যে। ফলে রাষ্ট্রপতির নিয়ন্ত্রণাধীন পুলিশের চাকরি ও পলায়নকৃত ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের চাকরিচ্যুতিসহ বেশ কিছু দাবি উত্থাপন করেছেন অধস্তন কর্মকর্তারা। দাবি মেনে না নেওয়া হলে কোন ধরনের প্রশাসনিক কাজে যোগ দেবেন না বলে জানিয়েছেন তারা।

অধস্তন কর্মকর্তাদের দাবি, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশ পালনে সাধারণ জনতার উপর গুলি চালিয়েছেন তারা। কিন্তু তাদের উপর আক্রমণ হলে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা তাদের কোন ধরনের নিরাপত্তা নিশ্চিত না করে গা ঢাকা দেন। ফলে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সহযোগিতার অনেক আকুতি জানিয়েও কোন কোন সহযোগিতা না পেয়ে মৃত্যুবরণ করতে হয় তাদের।

বৃহস্পতিবার (৮ আগস্ট) নাম পরিচয় না প্রকাশ করার শর্তে রাজারবাগ পুলিশ লাইনের এক পুলিশ সদস্য বার্তা২৪.কমকে বলেন, এখন পর্যন্ত লাশ বুঝিয়ে দেওয়া ও দাফন শেষ হয়েছে ২৬ থেকে ২৭টা লাশের। এখনও বেওয়ারিশ হিসেবে ডিএনএ টেস্ট চলছে। ফিঙ্গার প্রিন্ট চলছে, এখনও শনাক্ত হয়নি অনেক লাশের। এই লাশগুলো পুলিশ লাইনের মর্গে এবং কিছু ঠান্ডা ঘরে এসি চালিয়ে আপাতত রাখা হয়েছে। নির্দিষ্ট সংখ্যা বলা কষ্ট, কার গুনতি হয়নি এখনও।

তবে এখনও রাজারবাগ থেকে যে অস্ত্রগুলো ইস্যু হয়ে ডিউটিতে গিয়েছে এখনও ৩৩০ থেকে ৩৪০-এর মতো অস্ত্র ফেরত আসেনি। অস্ত্রের সাথেও তো এক একজন মানুষ (পুলিশ কর্মকর্তা) থাকে তারাও ফিরে আসেনি।

গত রাতে রাজারবাগে লাশবাহী গাড়ি প্রবেশের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, (বুধবার ৭ আগস্ট) রাতে ১০ থেকে ১১টা লাশবাহী গাড়ি প্রবেশ করে। এগুলোর এক একটি ফ্রিজিং গাড়িতে ৩টা করে লাশ ছিল। আনুমানিক ৩০ থেকে ৪০টা লাশ ছিল।


এদিকে গত মঙ্গলবার (৬ আগস্ট) রাজারবাগ পুলিশ লাইন ঘুরে বিভিন্ন অধস্তন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা হয় বার্তা২৪.কমের প্রতিবেদকের। সে সময় দাবি না মানা পর্যন্ত কর্মবিরতিরও ঘোষণা দেন তারা।

তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, রাজধানীজুড়ে সংঘাতের ঘটনায় নিহত পুলিশ সদস্যদের সুরক্ষা না দিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের পলায়নের ঘটনায় ক্ষোভ বিরাজ করছে রাজারবাগ পুলিশ লাইনের অধস্তন কর্মকর্তাদের মধ্যে। ফলে রাষ্ট্রপতির নিয়ন্ত্রণাধীন পুলিশের চাকরি ও পলায়নকৃত ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের চাকরিচ্যুতিসহ বেশ কিছু দাবি উত্থাপন করেছেন অধস্তন কর্মকর্তারা। দাবি না মেনে নেয়া হলে কোন ধরনের প্রশাসনিক কাজে যোগ দিবেন না বলে জানিয়েছেন তারা।

এসময় একাধিক অধস্তন কর্মকর্তারা বার্তা২৪.কমকে বলেন, আমাদের উপর আক্রমণ হলে আমরা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে সাহায্যের আবেদন করেছি। তারা আমাদের সাহায্য না করে পালিয়ে গেছেন। তাদের কারণে আজ সারাদেশে আমাদের এতো ভায়েরা মারা গেছে। আমরা এই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বিচার চাই। তাদের চাকরিচ্যুত করতে হবে এবং কঠোর বিচারের আওতায় আনতে হবে। আমরা তাদের অপকর্মের সাক্ষ্য দেবো। আমরা আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়াবো।

তারা বলেন, আমরা কারোর গোলাম হয়ে থাকতে চাই না। আমাদের চাকরি রাষ্ট্রপতির নিয়ন্ত্রণাধীন করতে হবে। আমরা আর কোন রাজনৈতিক দলের আন্ডারে পরাধীন থাকতে চাই না।