ব্যাংক দখল-অর্থ লোপাট: নাফিজ সরাফাতের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানে দুদক

  • স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: নাফিজ সরাফাত

ছবি: নাফিজ সরাফাত

আর্থিক খাতের অনিয়মকারীদের তালিকায় বার বার নাম এলেও অদৃশ্য কারণে পার পেয়ে যাওয়া চৌধুরী নাফিজ সরাফাতের বিরুদ্ধে এবার ব্যাংক দখল ও শেয়ারবাজার থেকে অর্থ লোপাটের মাধ্যমে ৮০০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগের অনুসন্ধান শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

দুদকের উপপরিচালক ইসমাইল হোসেনকে প্রধান করে তিন সদস্যর একটি দল গঠন করা হয়েছে। দলের অপর দুই সদস্য হলেন দুদকের উপপরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান ও উপসহকারী পরিচালক মিনহাজ বিন ইসলাম।

বিজ্ঞাপন

জানা গেছে, পদ্মা ব্যাংকের (সাবেক ফারমার্স ব্যাংক) সাবেক চেয়ারম্যান চৌধুরী নাফিজ সরাফাত সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানি রেইস অ্যাসেট ম্যানেজেমেন্ট পিএলসির মালিকানাতেও যুক্ত।

দুদকের এক পরিচালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান , “তার (নাফিজ সরাফাত) বিরুদ্ধে শেয়ারবাজার থেকে অর্থলোপাট ও ফারমার্স ব্যাংক দখলের অভিযোগ রয়েছে। মাস খানেক আগে এ বিষয়ে একটি অনুসন্ধান শুরু হয়। প্রাথমিকভাবে তার বিরুদ্ধে ৮০০ কোটি টাকা লোপাটের অভিযোগ রয়েছে।

বিজ্ঞাপন

অনুসন্ধানের অংশ হিসেবে এরই মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকসহ বিভিন্ন ব্যাংক ও প্রতিষ্ঠানে অডিট রিপোর্ট ও নথিপত্র তলব করে চার দফায় চিঠি পাঠানো হয়েছে। সেসবের উত্তর পাওয়া যায়নি। তবে এখন হয়ত তাদের টনক নড়বে। ওই অনুসন্ধানেও গতি আসবে।

কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান নাফিজ সরাফাত হোটেল ব্যবসা, বিদ্যুৎ, মোবাইলের টাওয়ার, মিডিয়াসহ বিভিন্ন খাতে ব্যবসার বিস্তার ঘটিয়েছেন গত এক দশকে।

অনিয়ম আর ঋণ কেলেঙ্কারিতে ফারমার্স ব্যাংক বন্ধ হওয়ার উপক্রম হলে মালিকানা ও ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন ঘটে ২০১৭ সালে। সে সময় চাপের মুখে চেয়ারম্যানের পদ ছাড়েন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সাবেক সদস্য মহীউদ্দীন খান আলমগীর।

পরের বছর ব্যাংকের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেন চৌধুরী নাফিজ সরাফাত; পরিচালনা পর্ষদে পরিবর্তনের পর ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে ফারমার্স ব্যাংকের নাম হয় পদ্মা ব্যাংক।

পদ্মা ব্যাংককে উদ্ধার করতে সরকারের উদ্যোগে রাষ্ট্রায়ত্ব সোনালী, জনতা, অগ্রণী, রূপালী ও ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি) এর মাধ্যমে ৭১৫ কোটি টাকার মূলধন জোগান দেওয়া হয়, যা ওই সময়ে ব্যাংকটির মোট মূলধনের ৬৬ শতাংশ।

আর্থিক স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ায় আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দিতে পারছিল না পদ্মা ব্যাংক। ওই অবস্থায় ২০২০ সালে কোনো রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হওয়ার প্রস্তাব দেয় তারা। আরেকটি প্রস্তাবে যোগান দেয়া মূলধনের বিপরীতে রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে সমপরিমাণ শেয়ার ইস্যু করার প্রস্তাব দেওয়া হয়।

বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের মতামত জানিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগে যে চিঠি দেয়, সেখানে বলা হয়, পদ্মা ব্যাংক সরকারি ব্যাংকের আমানতের বিপরীতে শেয়ার ইস্যু করার যে প্রস্তাব দিয়েছে সেটা ব্যাংক কোম্পানি আইনের সাথে ‘সমঞ্জস্যপূর্ণ নয়’।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে একমত হয়ে প্রস্তাবটি ফিরিয়ে দেয় অর্থমন্ত্রণালয়। তখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে পদ্মা ব্যাংকের পর্ষদকে বলা হয়েছিল, বিদেশ থেকে বিনিয়োগ আনার চেষ্টা চালাতে। সেই চেষ্টা করেও তারা ব্যর্থ হয়।

২০১৯ সালে ফারমার্স ব্যাংক থেকে পদ্মা ব্যাংক হওয়ার সময় প্রতিষ্ঠানটির খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল তিন হাজার ৭০ কোটি টাকা। ২০২৩ সালের শেষে তা বেড়ে ৩ হাজার ৬৭২ কোটি টাকায় দাঁড়ায়, যা মোট ঋণের প্রায় ৬৪ শতাংশ। অর্থাৎ নাফিজ সরাফাতের সময়ে খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় ৬০২ কোটি টাকা।

পদ্মা ব্যাংকের দুর্দশা নিয়ে আলোচনার মধ্যে চলতি বছর ৩১ জানুয়ারি ব্যাংকের চেয়ারম্যানের পদ ছাড়েন নাফিজ সরাফাত। এরপর বাংলাদেশ ব্যাংকের মধ্যস্থতায় গত মার্চে এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে একভূত হওয়ার চুক্তি করে পদ্মা ব্যাংকের পর্ষদ।

সিটিজেন টিভির চেয়ারম্যান ও দ্বাদশ সংসদে আওয়ামী লীগের এমপি শফিকুর রহমান গত মে মাসে অভিযোগ তোলেন, নাফিজ সরাফাত তাকে কোনো এক রাতে সাবেক আইজিপি (ঘটনার সময় ছিলেন র‌্যাবের মহা পরিচালক) বেনজীর আহমেদের বাসায় নিয়ে যান এবং সেখানে জোর করে তার কাছ থেকে সিটিজেন টিভির মালিকানার অংশ লিখে নেওয়া হয়।

২০২১ সালে কার্টুনিস্ট আহমেদ কবীর কিশোরের আঁকা একটি কার্টুন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আলোড়ন তোলে। চৌধুরী নাফিজ সরাফাতকে চিত্রায়িত করা ওই কার্টুনে নাভির জায়গায় দেখা যায় ব্যাংকের প্রতীক সিন্দুকের হাতল। তাতে ক্যাপশন ছিল, “আমি চৌ নাফিজ সারাফাত/জানি ব্যাংক খাওয়ার ধারাপাত!”

সে সময় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের আলোচনায় বলা হয়, কিশোরের আঁকা ওই কার্টুনের উপরের ক্যাপশনটি লিখেছিলেন অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট মুশতাক আহমেদ।

ওই বছর মে মাসে ‘সরকারবিরোধী প্রচার ও গুজব ছড়ানোর’ অভিযোগে মুশতাক, কিশোরসহ চারজনকে গ্রেফতার করা হয়। বার বার জামিন প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পর কাশিমপুরের হাই সিকিউরিটি কারাগারে মৃত্যু হয় ৫৩ বছর বয়সী মুশতাকের। আর কিশোর জামিনে মুক্তি পাওয়ার পর তার ওপর নির্যাতনের অভিযোগ তোলেন।