রাজনীতির মাঠে আসছে নতুন দল!
১৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় থাকা শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটিয়েছে এখন আলোচনার তুঙ্গে ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’। কোটা সংস্কারের দাবি নিয়ে মাঠে নামলেও শেষমেশ তা রূপ নেয় সরকার পতনের আন্দোলনে। এর মধ্যেই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে নতুন কোনো রাজনৈতিক দল গঠন হবে কিনা উঠছে সে প্রশ্নও। নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের বিষয়ে কী ভাবছেন এর সমন্বয়করা?
গত তিন দশকের বেশির ভাগ সময় ধরেই বাংলাদেশে সরকার গঠন করেছে শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ বা তার প্রতিদ্বন্দ্বী খালেদা জিয়ার বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল- বিএনপি। এই দুই দলের প্রধানের বয়স এখন ৭০ বছরের বেশি।
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্র নেতারা এই রাজনৈতিক দলের শাসন অবসান ঘটাতে একটি রাজনৈতিক দল গঠনের বিষয়ে আলোচনা জোর আলোচনা চলছে।
শিক্ষক সংগঠনের নেতা মাহফুজ আলম বলেন, দেশের দুই প্রধান দলের প্রতি বাংলাদেশের মানুষ খুবই বিরক্ত। তারা এর থেকে বাইরে বের হওয়ার চেষ্টা করছেন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া শিক্ষার্থীরা বলছেন, দেশের প্রয়োজনে তারা রাজনীতিতে সরাসরি অংশগ্রহণ করতেও রাজি। ইতিবাচক সাড়া পেলে গড়ে তুলবেন নতুন রাজনৈতিক দল। তবে তা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন নয়, নতুন কোনো নামে আত্মপ্রকাশ করবে বলে জানিয়েছেন তারা। সেই সঙ্গে তারা রাজনৈতিক দল হিসেবে লেজুড়বৃত্তি, গতানুগতিকতা ও পরিবারতন্ত্রের বাইরে গিয়ে জনগণের প্রত্যাশা পূরণে কাজ করবে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে প্রথম সারিতে থাকা অধিকাংশই গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তি নামের একটি ছাত্র সংগঠনের সদস্য। মূলত নুরুল হক নুরের গণঅধিকার পরিষদ থেকে বের হয়ে ডাকসুর সাবেক সমাজসেবা সম্পাদক আখতার হোসেন ও মো. নাহিদ ইসলামের নেতৃত্বে গত বছর এই ছাত্র সংগঠনটি করা হয়েছিল। এই সংগঠনের অনুসারীরাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম করার চিন্তা করছেন। তারা মূলত তারুণ্যনির্ভর বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি তৈরি করতে চান।
তারা জানান, কোটা সংস্কার আন্দোলনের আরেকটি লক্ষ্য রাষ্ট্র সংস্কার। রাষ্ট্র সংস্কার করতে হলে রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্মের বাইরে গিয়ে করা সম্ভব হবে না। তাই এখনকার মতো জনসমর্থন অব্যাহত থাকলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন থেকে নতুন রাজনৈতিক দল তৈরি করা হবে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন নেতা বলেন, আমাদের অন্দোলন রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য। সরকার পতন করে আরেকটি রাজনৈতিক দলকে ক্ষমতায় বসানোর জন্য আমরা এত প্রাণ দিইনি। আমরা চাই, আমাদের মধ্য থেকে একটি রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম করতে। যে প্ল্যাটফর্মের কাজ হবে সেবামূলক রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করা।
তবে রাজনৈতিক দলটির রূপরেখা কী হতে পারে তা এখনও ঠিক হয়নি বলে জানিয়েছেন নেতারা। তারা বলেছেন, আমরা একটি লিয়াজোঁ কমিটি গঠন করেছি। তারা আমাদের সারা দেশের সমন্বয়ক ও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে আলোচনা করে একটি রূপরেখা তৈরি করবে।
গত বৃহস্পতিবার রাষ্ট্রের নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের জন্য ৬ সদস্যের একটি লিয়াজোঁ কমিটি ঘোষণা করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। ওই সময় জানানো হয়, এই কমিটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে পরামর্শ দেবে এবং সরকার, অংশীজন ও ছাত্রজনতার সঙ্গে সমন্বয় করবে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম জানান, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের রূপরেখা ও সরকারের অংশীজন নির্ধারণে সহায়তার কাজ করে যাচ্ছে লিয়াজোঁ কমিটি। সরকার গঠন-পরবর্তী রাষ্ট্রের নতুন রাজনীতি বন্দোবস্তের লক্ষ্যে কাজ করে যাবে এ কমিটি।
লিয়াজোঁ কমিটির সদস্য আরিফুল ইসলাম বলেন, আমরা রাষ্ট্রের সব অংশীজন, নাগরিক সমাজের সঙ্গে এ নিয়ে আলাপ-আলোচনা করব। ইতোধ্যেই আমরা সেই আলোচনা শুরু করেছি। তারা যদি আমাদের রাজনৈতিক দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করেন, তাহলে আমরা রাজনৈতিক দল করব।
অবশ্য বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শীর্ষ নেতারা এরই মধ্যে নতুন রাজনৈতিক দলের ইঙ্গিত দিয়েছেন। এর মধ্যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে উপদেষ্টা হিসেবে আন্দোলনের সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম ও আসিফ মাহমুদ শপথ নেওয়ার পর অভিনন্দন জানিয়ে আরেক সমন্বয়ক সারজিস আলম বলেছিলেন, নাহিদ ইসলাম ও আসিফ মাহমুদকে অভিনন্দন। এটা যেমন তাদের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ একটি অর্জন, তেমনি দেশের মানুষের স্বার্থে সেক্রিফাইসও (বিসর্জন) বটে। কারণ অন্তর্বর্তীলীন সরকারে থাকার কারণে সামনের ইলেকশনে তারা অংশগ্রহণ করতে পারবেন না।
গত বুধবার অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের চ্যালেঞ্জ ও করণীয় বিষয়ে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার বিশিষ্টজন এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি সংলাপের আয়োজন করে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি)। ওই সংলাপে বক্তারা বলেন, রাষ্ট্র মেরামতে আন্দোলনের বার্তা অক্ষুণ্ন রাখতে হবে। এ লক্ষ্যে ছাত্র-জনতার প্ল্যাটফর্মকে স্থায়ী রূপ দিতে হবে। এর জন্য একটি কাঠামো খুঁজে বের করার তাগিদ দিয়েছেন তারা। বক্তারা বলেন, এই প্ল্যাটফর্ম দাঁড় করানো না গেলে একপর্যায়ে পরিস্থিতি আবার পুরোনো চেহারায় ফিরবে।
তবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম করা নিয়ে দ্বিমত রয়েছে সমন্বয়কদের অনেকেরই। এর মধ্যে অন্যতম কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক উমামা ফাতেমা গত শনিবার বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন একটি আন্দোলনের প্ল্যাটফর্ম। বোঝাপড়া হয়েছিল, এই আন্দোলনের মঞ্চ থেকে পরবর্তীতে রাজনৈতিক সংগঠন হবে না। এই আন্দোলনের মঞ্চকে রাজনৈতিক কাঠামোতে পরিণত করলে গণঅভ্যুত্থান তার আকাঙ্ক্ষা থেকে বিচ্যুত হবে।