মালয়েশিয়ায় দালালের ‘মৃত্যুকূপে’ ইকবাল, উৎকণ্ঠায় পরিবার

  • তাসনীম হাসান, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, চট্টগ্রাম ব্যুরো
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

মালয়েশিয়া যাওয়ার আগে বিমানবন্দরে মো. ইকবাল বাহার (বামে)/ছবি: সংগৃহীত

মালয়েশিয়া যাওয়ার আগে বিমানবন্দরে মো. ইকবাল বাহার (বামে)/ছবি: সংগৃহীত

বহু বছর ধরে মালয়েশিয়া যাওয়ার স্বপ্ন দেখছিলেন মো. ইকবাল বাহার। ভাবতেন কোনও মতে সেখানে এক বার যেতে পারলেই সব মুশকিল আসান হয়ে যাবে। অভাব দূর হয়ে আলো ফিরবে সংসারে। তাই নিজের অটোরিকশা বিক্রি করে আর ধার-দেনা করে সেই দেশে বহুবছর ধরে বসবাস করে আসা এক আত্মীয়কে দিয়েছিলেন প্রায় তিন লাখ টাকা। এরপর মাঝখানে কেটে যায় তিনবছর। বহুবার ঘোরানোর পর দশদিন আগে ইকবালের ডাক পড়ে মালয়েশিয়া যাওয়ার। তারপর কয়েক দেশ ঘুরে পৌঁছে যান স্বপ্নের দেশেও।

বিজ্ঞাপন

কিন্তু মালয়েশিয়ায় পৌঁছে জীবিকা তো দূরের কথা, এখন জীবনঝুঁকিতে পড়েছেন ৩৫ বছরের ইকবাল বাহার। মানবপাচারকারী চক্রের ফাঁদে পড়ে পাম বাগানের একটি ছোট্ট গুমটি ঘরে জায়গা হয়েছে কক্সবাজারের পেকুয়া উপজেলার রাজাখালীর এই তরুণের। সেখানে মানবপাচারকারী চক্রের সদস্যরা তাঁকে আটকে রেখে আরও কয়েক লাখ টাক মুক্তিপণ দাবি করছেন। চাহিদা অনুযায়ী টাকা না পাওয়ায় ইকবালকে ঠিক মতো খাবারও দিচ্ছে না। কিছু বলতে গেলেই বেধড়ক মারধর করা হচ্ছে। দিনে একবার অল্প সময়ের জন্য পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করার সুযোগ দেয় তারা। আর ফোন দেওয়ার সুযোগ পেলেই স্বজনদের ইকবাল শুধু বলছেন একটা কথা, ‘রক্ত বেছে হলেও টাকা পাঠাও। না হয় ওরা বলে দিয়েছে আমাকে মেরে ফেলবে, তারপর লাশ পুতে ফেলবে’।

স্বপ্নপূরণের আশায় মালয়েশিয়ায় গিয়ে এমন পরিস্থিতিতে পড়ায় ভেঙে পড়েছেন ইকবালের মা-বাবা-স্ত্রীসহ স্বজনেরা। ছোট ছোট চার সন্তান নিয়ে স্বামীর দুশ্চিন্তায় নির্ঘুম দিন কাটছে স্ত্রী মরজিনা সুলতানার। ইকবালকে কীভাবে মানবপাচারকারী চক্রের ‘কারাগার’ থেকে মুক্ত করবেন তা কোনোভাবেই ভেবে উঠতে পারছে না অসহায় পরিবারটি। এমন পরিস্থিতিতে সহযোগিতা চেয়ে সেনাবাহিনীর কাছে লিখিতভাবে অভিযোগ করেছেন ইকবালের ছোট ভাই মো. ফোরকান উদ্দীন। এখন অন্তবর্তীকালীন সরকার ও মালয়েশিয়ায় অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসের দিকে তাকিয়ে আছে ইকবালের স্বজনেরা।

ইকবালের স্ত্রী মরজিনা সুলতানা জানান, তাঁর খালাতো ভাই রবিউল্লাহ রবি বহু বছর ধরে মালয়েশিয়া প্রবাসী। সে ‘ফ্রি ভিসায়’ আমার স্বামীকে নিয়ে যাওয়ার কথা বললে একমাত্র জীবিকার মাধ্যম অটোরিকশা বিক্রি ও ধার দেনা করে তার চাহিদা অনুযায়ী তিন বছর আগে আড়াই লাখ টাকা দিই। কিন্তু এত বছর ধরে বারবার মালয়েশিয়া নিয়ে যাওয়ার কথা বলে ঘোরাতে থাকে, আবার টাকা ফেরত চাইলেও দেয়নি। এক পর্যায়ে আগস্টের শেষেরদিকে ফ্লাইট হবে জানিয়ে ঢাকায় নিয়ে কয়েকদিন রেখে পুনরায় বাড়িতে ফেরত পাঠিয়ে দেন। এরপর ফ্রি ভিসার পরিবর্তে ট্যুরিস্ট ভিসার ব্যবস্থা করে রবিউল্লাহ। সেই ভিসায় ১৮ সেপ্টেম্বর রওনা হন আমার স্বামী। কয়েক দেশ ঘোরানোর পর তাঁরা ২২ সেপ্টেম্বর আমার স্বামীকে মালয়েশিয়া নিয়ে যান।’

এদিকে মালয়েশিয়া পৌঁছার পর জঙ্গলের পাম বাগানের কয়েকটি অন্ধকার কক্ষে ইকবালসহ ২২ জনকে আটকে রাখে মানবপাচারকারী চক্রের সদস্যরা। এর মধ্যে চাহিদা অনুযায়ী মুক্তিপণ দেওয়ায় ২০জনকে ছেড়ে দেওয়া হয়। বাকি দুজনকে এখনো সেই আলোবাতাসহীন কক্ষে আটকে রাখা হয়েছে। প্রতিদিন সকালে ৫-১০ মিনিটের জন্য মোবাইল ফোন দিয়ে পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করার সুযোগ করে দেয়। শুরুতে ১ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করলেও শনিবার (২৮ সেপ্টেম্বর) থেকে ১ লাখ ৩০ হাজার টাকা মুক্তিপণ দাবি করছে চক্রটি। রোববারের মধ্যে মুক্তিপণ না দিলে ইকবালকে মেরে মাটিতে পুঁতে ফেলার হুমকিও দিয়ে রেখেছে তারা।

দালালচক্রের সঙ্গে যুক্ত আইয়ুব, রবিউল্লাহ ও জিয়া

রবি উল্লাহর মাধ্যমে ইকবাল মালয়েশিয়া যাওয়ার সব কাজ করলেও এখন তিনি দায় নিচ্ছেন না। রবির সঙ্গে ইকবালের পরিবারের সদস্যরা যোগাযোগ করলে মো. আইয়ুব নামের একজনের মাধ্যমেই তিনি ইকবালকে নেওয়ার ব্যবস্থা করেছেন বলে জানান। মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর সঙ্গে জড়িত ঢাকাভিত্তিক একটি এজেন্সির মালিক মো. জিয়া নামের আরও একজন এই কাজের সঙ্গে যুক্ত আছেন। এই বিষয়ে রবিউল্লাহ কিছু করতে পারবে না বলে জানিয়ে দেন। এরই মধ্যে মো. আইয়ুব ও রবিউল্লাহর পরিচয় পাওয়া গেছে। এখন আইয়ুব নামের এই দালাল চক্রের হেফাজতেই আছেন ইকবাল।

এদিকে মালয়েশিয়ায় দালালের মাধ্যমে যাওয়া আরও কয়েকজন প্রবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চকরিয়া-পেকুয়াকেন্দ্রীক মানবপাচারকারী চক্রের একটি শক্ত অবস্থান রয়েছে সেই দেশে। তাঁরা ফ্রি ভিসায় মালয়েশিয়ায় নিয়ে যাওয়ার কথা বলে এলাকার বেকার যুবকদের টার্গেট করেন। পরে কয়েক লাখ টাকার বিনিময়ে মালয়েশিয়ায় নিয়ে গিয়ে সেখানে চাকরির ব্যবস্থা করার লোভ দেখান। সেই ফাঁদে পড়ে অনেকেই ৩-৪ লাখ টাকা খরচ করে মালয়েশিয়ায় গিয়েই আটকা পড়েন দালালদের ঢেরায়। এরপর মারধর করে বাড়িতে ফোন করিয়ে আরও কয়েক লাখ টাকা হাতিয়ে নেয় দালাল চক্রটি। সেই চক্রের অন্যতম সদস্য আইয়ুব, রবিউল্লাহ রবি ও জিয়া।

এর মধ্যে দালাল চক্রের প্রধান হোতা মো. আইয়ুবের বাড়ি চকরিয়া পৌরসভার ২ নম্বর ওয়ার্ডের কাকারা জালিয়া পাড়া এলাকায়। তিনি সেখানকার ছৈয়দ আহমদের পুত্র। চক্রের আরেক সদস্য রবিউল্লাহর বাড়ি পেকুয়ার রাজাখালীর বৈশ্যাঘোনা এলাকায়। তিনি সেখানকার আবুল হাসানের ছেলে।

মালয়েশিয়ায় বৈধভাবে বসবাস করে আসা একজন তরুণ বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘ফ্রি ভিসা নামের কোনো ভিসার আসলে অস্তিত্ব নেই। মধ্যপ্রাচ্যের প্রায় সব দেশের ভিসা প্রক্রিয়া এক এবং প্রত্যেকটি দেশে একই প্রক্রিয়াতে কর্মী নিয়োগ দিয়ে থাকে। এসব দেশগুলোতে ফ্যামিলি ভিসা, ভিজিট ভিসা, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ারিং ভিসা, খাদ্দামা (নারী গৃহকর্মী) ভিসা, তাব্বাক (পুরুষ গৃহকর্মী) ভিসা, ড্রাইভিং ভিসা, কোম্পানির ভিসাসহ বিভিন্ন ক্যাটাগরির ভিসা দিয়ে থাকে। কিন্তু দেশে কর্মসংস্থানের সংকটের কারণে গ্রামের নিম্নমধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত অসহায় মানুষদের সরলতার সুযোগ নিয়ে ফ্রি ভিসা নামের একধরনের ভিসার উদ্ভাবন করেছে দালালেরা। এসব ভিসা নিয়ে বিদেশ যাওয়া প্রবাসীর কাজের দায়িত্ব নিয়োগকর্তা নেন না। নিজের কাজ নিজেকে সন্ধান করতে হয়। কাজের জন্য সকাল-সন্ধ্যা ঘুরতে হয় রাস্তায় রাস্তায়। পুলিশের হাতে ধরা পড়লে জেল-জরিমানার ভয় তো আছেই, ফিরতে হতে পারে দেশেও।’

ট্যুরিস্ট ভিসায় নিয়ে যাওয়াও ইকবালের এক থেকে দেড় লাখ টাকা খরচ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এর দ্বিগুণের বেশি টাকা দেওয়ার পরও তাঁকে মুক্তিপণের জন্য আটকে রেখেছে দালালচক্র। এখন দালালচক্রের সেই মুক্তিপণের টাকা দেওয়া ইকবালের পরিবারের পক্ষে একেবারেই অসম্ভব।

ইকবালের শ্বশুর ইউসুফ আলী বার্তা২৪.কমকে বলেন, ধার দেনা করে বহুকষ্টে মেয়ে জামাই মালয়েশিয়া গেছে। যাওয়ার সময় আমার মেয়েকে এক টাকাও দিয়ে যেতে পারেনি। যে তিন লাখ টাকা রবিউল্লাহকে দেওয়া হয়েছে সবই ধার-দেনার। এখন মেয়ে চার নাতি-নাতনিকে নিয়ে অসহায় হয়ে পড়েছে।’

একদিকে জীবনঝুঁকিতে স্বামী, অন্যদিকে মুক্তিপণের টাকা জোগাড়ের দুশ্চিন্তায় অসুস্থ হয়ে পড়েছেন ইকবালের স্ত্রী মরজিনা সুলতানা। ইকবালের মা-বাবা, শ্বশুর-শাশুড়িরাও ভেবে পাচ্ছেন না তাঁকে কীভাবে মুক্ত করবেন।

ইকবালের ছোট ভাই মো. ফোরকান উদ্দীন সেনাবাহিনীর কাছে এই বিষয়ে সহযোগিতা চেয়েছেন। তিনি বলেন, ‘অনেক কষ্ট করে টাকা জোগাড় করে আমার ভাই মালয়েশিয়া গিয়েছেন। এখন সেখানে গিয়ে দালালের কাছে জিম্মি হয়ে আছেন। আমার ভাই যেন দ্রুত মুক্তি পেয়ে সেই দেশে কাজ করে যেতে পারেন সেজন্য অন্তবর্তীকালীন সরকার ও মালয়েশিয়া অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসের সহযোগিতা কামনা করছি।’

দালালচক্রের সদস্য রবিউল্লাহ রবির সঙ্গে হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগ করা হলে তিনি ইকবালের বিষয়ে কোনো দায় নেবেন না বলে জানিয়ে দেন। বলেন, ‘চাহিদা অনুযায়ী মুক্তিপণ দিলেই ছাড়া পাবেন ইকবাল। আর এই বিষয়টি দেখছেন আইয়ুব, আমি না।’ এরপর ফোন কেটে দেন রবিউল্লাহ।