শপিং ব্যাগ হিসেবে পলিথিন ব্যাগ মানুষের দৈনন্দিন জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য উপাদান। মসজিদের তবারক বিতরণ থেকে শুরু করে পাড়া-মহল্লার দোকানে কিছু কিনতে গেলেও দরকার হয় এই পলিথিন। একবার ব্যবহার্য এসব পলিথিন ব্যবহার শেষে পয়োনিষ্কাশনের ড্রেন, নালা, নর্দমা, খাল, বিল ও নদীগুলোতে গিয়ে পড়ছে। দূষণ হচ্ছে পরিবেশের, নষ্ট হচ্ছে জীববৈচিত্র্য।
অপচনশীল এই পদার্থটির ফলে জমির উর্বরতা নষ্ট হয়, বাধা দেয় মাটিতে থাকা অনুজীবের সাধারণ বৃদ্ধিতেও। নদী, নালা, খাল, বিল থেকে সমুদ্রের পানিতে মিশে গিয়ে দূষিত করছে পানি, সামুদ্রিক জীবের ওপর যার প্রভাব হচ্ছে মারাত্মক।
তবে আশার বাণী হচ্ছে, পলিথিন বন্ধে কঠোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার। সে লক্ষে ইতোমধ্যে ১ অক্টোবর থেকে সুপারশপগুলোতে নিষিদ্ধ করা হয়েছে পলিথিন ব্যবহার। যা পরবর্তীতে ধীরে ধীরে সর্বস্তরে কার্যকর করারও ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।
১ অক্টোবর সুপারশপ আগোরায় পলিথিন ব্যাগ বন্ধের উদ্যোগ পরিদর্শনে গিয়ে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, প্রথম পরিকল্পনা হচ্ছে পলিথিন শপিং ব্যাগের ওপর বিদ্যমান নিষেধাজ্ঞা ক্রমান্বয়ে বাস্তবায়নের দিকে যাওয়া। আমরা সুপার শপ দিয়ে শুরু করেছি। ক্রমান্বয়ে ঢাকার বাহিরে যাবো। একসময় মুদি দোকান, কাঁচাবাজারে চলে যাবো। কাঁচাবাজারে এসব পলিথিন ব্যাগ বন্ধে আমাদের অভিযান শুরু হবে ১ নভেম্বর'।
সরেজমিনে মঙ্গলবার (১ অক্টোবর) পলিথিন শপিং ব্যাগ বন্ধের বিষয়ে রাজধানীর বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলেও পাওয়া গেছে ইতিবাচক মনোভাব। সরকারের এমন উদ্যোগে অকুণ্ঠ সমর্থন জানিয়ে তা সর্বস্তরে কার্যকর করার দাবি মানুষের। তবে এর বিকল্প হিসেবে যে সব পণ্য আসবে তার সহজলভ্যতায় সরকারের পদক্ষেপের প্রতিও জোর দেন তারা।
তেমনই একজন মো. রাজা। পড়াশোনার পাশাপাশি কাজ করেন মোহাম্মদপুর টাউন হল কাঁচাবাজারে মাছ কাটার। দিনে কয়েকশো পলিথিনের প্রয়োজন হয় তার। তবে পরিবেশের কথা চিন্তা করে পলিথিন ব্যবহার না করে পরিবেশবান্ধব ব্যাগ ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু দামের বিশাল পার্থক্য, তা আর সম্ভব হয়ে উঠেনি।
মো. রাজা বার্তা২৪.কমকে বলেন, পলিথিন পরিবেশের সব কিছু ধ্বংস করে দিচ্ছে। এখন এটা নিষিদ্ধ হওয়ায় ভাল হয়েছে। আমি আগেও চেষ্টা করছিলাম যেন পরিবেশবান্ধব ব্যাগ ব্যবহার করতে পারি, কিন্তু দামের পার্থক্য অনেক বেশি। এখন যে পরিমাণ পলিথিন ৭০ টাকায় কিনি, সে একই পরিমাণ পরিবেশবান্ধব ব্যাগের দাম ৮০০ টাকা। সরকার যদি এখানে দামটা কমাতে পারে, সহজলভ্য করতে পারে তাহলে আমাদের জন্য ভাল হবে।
লালমাটিয়া মহিলা কলেজের বিবিএ চতুর্থ বর্ষে পড়েন তানজিল আক্তার। থাকেন মেসে, সন্ধ্যায় টিউশনি শেষ করে বাসায় ফেরার পথে এসেছেন বাজারে। এক কেজি করে শসা ও পটল নিয়েছেন। সেই সঙ্গে ২০ টাকার কাঁচা মরিচ। তিনটি পণ্য তিনটি ব্যাগে দিলেন দোকানদার। বাসায় নিয়ে যাবার সুবিধার্থে তিনটি ব্যাগ আরেকটি পলিথিন ব্যাগে দেন তাকে।
এই যে পলিথিনের এমন অবাধ ব্যবহার করছেন, সরকার এক মাস পর বন্ধ করে দিলে সমস্যায় পড়বেন কিনা জানতে চাইলে তানজিল আক্তার বলেন, বিকল্প ব্যবস্থায় মানুষ যেতে চায় না। সহজে যেটা পায় সেখানেই থাকে। কিন্তু যখন সে ব্যবস্থাটা থাকবে না তখন তো বিকল্প ব্যবস্থায় যাবেই। আমি এখন পলিথিন পাচ্ছি, তাই ব্যাগ নিয়ে আসিনি, কিন্তু যখন আমাকে পলিথিন দেবে না, তখন একটা বিকল্প নিশ্চয় তৈরি হয়ে যাবে।
একই বাজারে ১০ বছরের বেশি সময় ধরে পলিথিনের ব্যাগসহ একবার ব্যবহার্য বিভিন্ন প্লাস্টিকের পণ্য বিক্রি করেন ভাই-ভাই স্টোরের মালিক আব্দুল হান্নান। এটা তার ব্যবসা হলেও অখুশি নন সরকারি সিদ্ধান্তে।
বরং সরকারকে সাহায্য করার কথা জানিয়ে এই বিক্রেতা বলেন, পলিথিন ব্যাগ নিষিদ্ধ করাটা খুবই ভাল সিদ্ধান্ত। এখন আমরা পাচ্ছি তাই বিক্রি করছি, সরকার নিষিদ্ধ করে দিলে তখন বিক্রি করবো না। অন্য কিছু তো আসবে, তাই বিক্রি করবো। আমরা তো আর সরকারে বাহিরের কেউ না। এটা বন্ধ হওয়া উচিত।
রাজধানীর ঝিগাতলা আগোরা সুপারশপে কথা হয় ডাক্তার সাব্বির নামের এক ভোক্তার সঙ্গে। তিনি বলেন, পলিথিন ব্যাগ নিষিদ্ধ এর আগেও একবার হয়েছিলো। তখন সরকার অভিযান চালিয়েছে, কিন্তু পরে বন্ধ হয়ে গেছে সে অভিযান। আমরা সব কিছুই খুব ঘটা করে শুরু করি কিন্তু সেটা আর বেশি দিন ধরে রাখতে পারি না। তবে এখন আশা রাখি সরকারি তৎপরতা বন্ধ হবে না। এটা খুবই ভাল সিদ্ধান্ত।
আগোরার ঝিগাতলা শাখার স্টোর ম্যানেজার আমিনুল ইসলাম বলেন, আমরা ভাল সাড়া পাচ্ছি। গ্রাহকরা বিষয়টাকে ভালভাবে নিয়েছেন। আজ সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এখনো কারো থেকে কোন অভিযোগ পাইনি। এই সিদ্ধান্তটা আরও আগেই নেওয়া উচিত ছিলো।
জানা যায়, পণ্যে পাটজাত মোড়কের বাধ্যতামূলক ব্যবহার আইন ২০১০ অনুযায়ী ধান, চাল, গম, ভুট্টা, সার, চিনি, মরিচ, হলুদ, পেঁয়াজ, রসুন, আদা, ডাল, ধনিয়া, আলু, আটা, ময়দা, পোল্ট্রি ফিড, ফিস ফিড ও তুষ-খুদ-কুঁড়া মোড়কীকরণে পাটের বস্তার ব্যবহার বাধ্যতামূলক। এই আইন ভঙ্গ করলে ১ বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক ৫০ হাজার টাকার অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডের বিধান রয়েছে। একই অপরাধ পুনঃসংঘটনের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ দণ্ডের দ্বিগুণ দণ্ডেরও বিধান আছে। এছাড়াও এই আইনের অধীনে কোম্পানিগুলোকে পাটের বস্তার ব্যবহার সংক্রান্ত মাস ভিত্তিক তথ্য নির্ধারিত ছকে প্রতিমাসের ৫ তারিখের মধ্যে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিকট প্রদান করারও নির্দেশনা রয়েছে।
তবে বাস্তব প্রয়োগ না থাকায় এতদিন কেউ মানেনি আইনটি। অন্তর্বর্তী সরকার সক্রিয় হওয়ায় মানুষের মধ্যে আবারও আশার প্রদীপ জ্বলে ওঠছে। জীবন ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় এটি কার্যকর করা গেলে তা দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে বলেও মত ভোক্তাদের। এতে করে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পাবে মানুষ, প্রাণ ও পরিবেশ।
পলিথিন ব্যাগ বন্ধের বিষয়টি নিয়ে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের ভাইস প্রেসিডেন্ট এসএম নাজের হোসাইন বার্তা২৪.কমকে বলেন, সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন পলিথিনের ব্যবহার বন্ধ করার, এটা ভাল উদ্যোগ। পলিথিন পরিবেশের জন্য খুবই ক্ষতিকর। এই যে বন্যা, সাইক্লোন এইগুলোর পিছনেও এর একটা বড় প্রভাব আছে। তাই পলিথিন বন্ধ হওয়াটাই উচিৎ।
পলিথিন বন্ধ করার সাথে সাথে ভোক্তাদের জন্য সরকার কোন বিকল্প ব্যবস্থা করেছেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, পলিথিন সরকার বন্ধ করেছে। এখন এটা নিয়ে যদি সরকার যথাযথ আইন প্রয়োগ করে তাহলে বিকল্প ব্যবস্থা হয়ে যাবে। এটা তেমন কোন সমস্যা হবে বলে মনে হয় না।