পদ্মার স্রোতে নেই বড় ইলিশ, জাটকাই ভরসা জেলেদের

  • ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, রাজশাহী
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

রাজশাহী জেলার পদ্মা নদী একসময় ছিল ইলিশ মাছের স্বর্গ। তখন জেলেরা সহজেই বড় ইলিশ ধরতে পারতেন। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নদীর পানি প্রবাহ এবং পরিবেশের পরিবর্তনের কারণে বড় ইলিশের সংখ্যা অনেক কমে গেছে। বর্তমানে জেলেরা জাটকা মাছ ধরার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন।গত কয়েক বছরে জাটকা মাছের সংখ্যা বেড়েছে, কিন্তু বড় ইলিশের অভাব এখনও প্রবল।

স্থানীয় জেলেরা বলছেন, একসময় বড় ইলিশ ধরা পড়তো, এখন সেখানে শুধু ছোট আকারের জাটকা মাছই পাওয়া যাচ্ছে। নদীর গভীরতা কমে যাওয়া, বাঁধের প্রভাব এবং আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার মাছের চলাচলে বাধা সৃষ্টি করেছে। ফলে, রাজশাহীর পদ্মায় বড় ইলিশের আশা ক্রমশ কমে যাচ্ছে।

বিজ্ঞাপন

নদীর পরিবেশ পুনরুদ্ধারের জন্য কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানান জেলেরা। যাতে রাজশাহীর পদ্মায় আবার বড় ইলিশ ফিরে আসে।

জানা যায়, ১৯৭০-এর দশকে, এই নদীতে প্রচুর বড় আকারের ইলিশ মাছ ধরা পড়ত। তখন এই মাছের স্বাদ ছিল অতুলনীয়। সাধারণ পরিবারের প্রতিটি সদস্যই ইলিশ খেতে পারতেন, কারণ তখন দামও ছিল সাশ্রয়ী এবং সহজলভ্য। কিন্তু পদ্মার উজানে ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের পর থেকে নদীর পানির প্রবাহে পরিবর্তনের ফলে ইলিশের সংখ্যা কমে যায়।

বর্তমানে রাজশাহী অঞ্চলে জেলেদের জালে ধরা পড়ে ছোট আকারের জাটকা মাছ। গত কয়েক বছরে, বড় ইলিশের সংখ্যা কমতে কমতে প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে। এখন শুধুমাত্র রাজশাহী বিভাগের কিছু এলাকা যেমন পাবনার ঈশ্বরদী, সুজানগর এবং সিরাজগঞ্জের চৌহালী এলাকায় ইলিশ মাছের উৎপাদন ভালো রয়েছে। বিশেষ করে সিরাজগঞ্জের চৌহালীতে ইলিশ মাছের প্রাচুর্য অপেক্ষাকৃত বেশি, যেখানে স্থানীয় জেলেরা এখনও ভালো পরিমাণে ইলিশ ধরতে সক্ষম হন। রাজশাহী জেলার চারঘাট এবং বাঘা এলাকায়ও ইলিশ মাছের কিছু পরিমাণ পাওয়া যায়।

রাজশাহী জেলা মৎস্য অধিদফতরের তথ্যমতে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে রাজশাহী বিভাগে ৫০৭ মেট্রিক টন ইলিশ আহরণ করা হয়েছিল। পরবর্তী বছর, অর্থাৎ ২০১৯-২০ সালে এই পরিমাণ বেড়ে ৭৩৫ মেট্রিক টনে পৌঁছায়। কিন্তু ২০২০-২১ অর্থবছরে আবার এটি ৭৪১ মেট্রিক টনে পৌঁছানোর পর থেকে একটি নিম্নমুখী ধারায় চলে যায়। ২০২১-২২ অর্থবছরে আহরণ হয় ৫৮১ মেট্রিক টন, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৬০০ মেট্রিক টন, কিন্তু ২০২৩-২৪ অর্থবছরে তা আবার কমে ৪৯২ মেট্রিক টনে এসে দাঁড়ায়।

দফতরের তথ্য অনুযায়ী, পবা, চারঘাট, বাঘা এবং গোদাগাড়ী উপজেলায় পদ্মা নদীতে কিছু পরিমাণ ইলিশ মাছ পাওয়া যায়। এর মধ্যে চারঘাট এলাকায় সবচেয়ে বেশি ইলিশ ধরা পড়ে। চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে চারঘাট থেকে ৩২০০ কেজি ইলিশ ধরা পড়ে, যা আগের মাস আগস্টের তুলনায় বেশ ভালো। আগস্টে ধরা পড়েছিল ২৮৩০ কেজি ইলিশ এবং জুলাই মাসে এটি ছিল ১৪৪৬ কেজি। তবে বর্তমানে ধরা পড়া ইলিশের আকার ছোট, সাধারণত পাঁচ থেকে ছয়টি মাছ মিলিয়ে এক কেজি হয়। বড় আকারের ইলিশ মাঝে মাঝে ধরা পড়ে, কিন্তু সংখ্যায় তা অল্প।

চারঘাটের সিনিয়র উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. ওয়ালী উল্লাহ মোল্লাহ জানান, গত কয়েক বছরের তুলনায় এ বছর সবচেয়ে বেশি ইলিশ ধরা পড়েছে, কিন্তু সেগুলোর আকৃতি খুব ছোট। নদীর পানির গভীরতা কমে যাওয়ার কারণে ইলিশ মাছের আসা-যাওয়া কমে গেছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, নদীতে যদি পানির গভীরতা ২০ থেকে ২৫ ফুট না হয়, তাহলে মাছ সেখানে আসতে চায় না। এটি একটি প্রকৃতিগত সমস্যা, যা রাজশাহীর পদ্মায় মাছের পরিমাণ কমানোর জন্য দায়ী।

রাজশাহী জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, এক সময় পদ্মায় প্রচুর ইলিশ পাওয়া যেত, কিন্তু বর্তমানে পরিস্থিতি বদলে গেছে। পানির গভীরতা কমে যাওয়ার কারণে, ড্রেজার দিয়ে বালু উত্তোলন, বাঁধ নির্মাণ এবং আধুনিক জাল দিয়ে মাছ ধরার কারণে রাজশাহীর এলাকায় ইলিশ কমে গেছে। তবে, জাটকা সংরক্ষণ প্রকল্প এবং মা ইলিশ ধরা বন্ধ থাকায় কিছুটা ইলিশের সংখ্যা বাড়ছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।

নদী গবেষক মাহবুব সিদ্দিকী বলেন, ইলিশ মাছ সাধারণত ঝাঁকে ঝাঁকে চলাচল করে এবং উজানে যেতে পছন্দ করে। এক সময় পাকিস্তান আমলেও বঙ্গোপসাগর থেকে ইলিশ মাছ রাজশাহীর নদী পাড়ি দিয়ে উজানে ভাগলপুর পর্যন্ত যেত এবং ডিম ছাড়ত। চারঘাট থেকে পদ্মার শাখা বড়াল নদীর বাঘার আড়ানিতে প্রচুর ইলিশ পাওয়া যেত। স্বাধীনতার পরও ১৯৭৪-৭৫ সাল পর্যন্ত রাজশাহীতে প্রচুর ইলিশ ধরা পড়ত। তখন সকল শ্রেণির মানুষের ঘরে ইলিশ দেখা যেত। কিন্তু বর্তমানে বাঁধের কারণে পদ্মায় পানির প্রবাহ কমে যাওয়ায় স্রোতও কমে যায়। হার্ডিঞ্জ ব্রিজ অতিক্রম করে ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ আসা বন্ধ হয়ে গেছে।

এ বিষয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. ইয়ামিন হোসাইন বলেন, পদ্মার ইলিশ মাছ একসময় বড় এবং স্বাদে অনন্য ছিল। তবে এখন সেই বড় ইলিশ নেই, স্বাদও নেই। অন্যান্য নদী যেমন মেঘনা, যমুনা, সুরমা এবং কুশিয়ারায় ইলিশ বাড়লেও পদ্মায় তা বাড়েনি। এর কারণ হলো পদ্মার স্বাভাবিক খরস্রোতা বা যৌবন হারিয়ে গেছে।

তিনি জানান, ইলিশ মাছের প্রজনন মৌসুমে (অক্টোবর-নভেম্বর) রাজশাহীর পদ্মায় বড় ইলিশ পাওয়া যায় না। বর্তমানে পদ্মায় ধরা পড়া ইলিশের ওজন সাধারণত ২০০ থেকে ৩০০ গ্রামের বেশি হয় না।

ভারতের সঙ্গে যৌথ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করলে ইলিশ মাছ ফেরানোর পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে বলেন অধ্যাপক ইয়ামিন আলম। এজন্য রাজশাহীর পদ্মায় ইলিশের জন্য একটি সুবিধাজনক পরিবেশ তৈরি করা আবশ্যক। যদি নদীর স্রোত ফিরিয়ে আনা যায় এবং মাছের চলাচলের পথ সুগম করা যায়, তবে ইলিশের আগমন পুনরুদ্ধার সম্ভব।

এদিকে, মৌসুমে ইলিশের নিরাপদ প্রজনন নিশ্চিত করতে ১৩ অক্টোবর থেকে ৩ নভেম্বর পর্যন্ত ২২ দিন ইলিশ আহরণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এই নিষেধাজ্ঞা একদিকে যেমন মাছের প্রজনন নিশ্চিত করবে, অন্যদিকে পদ্মার ইলিশের সংখ্যা বাড়াতে সহায়তা করবে।