কৌতূহলই কাল হলো আয়েশার, আসামিদের হুমকিতে এলাকা ছেড়েছেন স্বামী

  • আল-আমিন রাজু, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

রাজধানীর মিরপুরের পল্লবী থানার বাউনিয়াবাঁধ বস্তির বাসিন্দা আয়েশা আক্তার (৩৫)। দুই সন্তান ও বাস চলক স্বামীকে নিয়ে সুখের সংসার। বুধবার সকালে স্বামী সন্তানদের সঙ্গে নাস্তা খেয়েছেন। এরপরেই হঠাৎ ঘাতক বুলেট সব এলোমেলো করে দিলো আয়েশা ও মিরাজুলের ৮ বছরের সাজানো সংসারের। বাসার সামনের গলিতে লাগা বিবাদ দেখতে জানালা দিয়ে বাইরে তাকানোই কাল হলো আয়েশার। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন আয়েশা। বয়ে যায় রক্তের স্রোত।

এ দিকে স্ত্রীর মৃত্যুর পর আরও সঙ্কা যোগ হয়েছে নিহতের স্বামী মিরাজুলের। স্ত্রী হত্যার ঘটনায় দায়ের করা মামলার আসামিরা মুখ বন্ধ রাখতে দিচ্ছেন নানা হুমকি। আর এতে স্ত্রীর লাশ হাসপাতালের মর্গে রেখেই দুই শিশু সন্তানকে নিয়ে ঢাকা ছাড়েন মিরাজুল। বর্তমানে অবুজ দুই সন্তানকে নিয়ে গ্রামের বাড়িতে আছেন তিনি। এদিকে দীর্ঘ সময় মা কে না পেয়ে অস্থির হয়ে উঠেছে দুই শিশু সন্তান। তারা বাবার কাছে বারবার মা কখন আসবে সেই প্রশ্নে অস্থির করে তুলছে। আর সন্তানদের প্রশ্নের জবাবে বাবা মিরাজুল অশ্রু লুকিয়ে মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে চলেছেন।

বিজ্ঞাপন

জানা গেছে, নিহত আয়েশার স্বামী মিরাজুলের গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহ জেলার নান্দাইল থানার তিতকলা এলাকায়। ৮ বছর আগে আয়েশা ও মিরাজুলের পারিবারিকভাবে বিয়ে হয়। তাদের সংসারে দুটি সন্তান আছে। আরিয়ান (৫) ও মেহেদী হাসান (২)। রাজধানীর গাবতলী থেকে স্টাফ কোয়াটার ‍রুটে চলাচল করা অছিম পরিবহনের বাস চালিয়ে সংসার চালাতেন মিরাজুল। দুই সন্তান নিয়ে সুখেই কাটছিলো তাদের দিন-রাত।

বৃহস্পতিবার দুপুরে পল্লবীর মিরপুর সেকশন ১১ নম্বরে এলাকার বাউনিয়াবাঁধ বস্তির বি ব্লকের ৬ নম্বর লেনের নাদিম মিয়ার বাড়ির ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, ভবনের সামনে অনেকেই নিরব দাঁড়িয়ে। এই বাড়ির তৃতীয় তলার একটি রুমে ভাড়া থাকতেন আয়েশা ও মিরাজুল দম্পতি। সেই ভবনের সিঁড়িতে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন আয়েশা। ঘটনার পরে বাসিন্দাদের চলাচলের জন্য রক্ত ধুঁয়ে ফেলা হয়েছে। তৃতীয় তলায় গিয়ে দেখা যায়, আয়েশাদের বাসার দরজায় তালা ঝুলছে। আয়েশা যেখানে গুলিবিদ্ধ হন তার পাশেই ভবনের বাইরের অংশে আরও একটি গুলির চিহ্ন। স্থানীয়দের চোখে মুখে অজানা এক আতঙ্ক। সরকার পতনের পর স্থানীয়দের মাঝে এই আতঙ্ক কয়েকগুণ বেড়েছে। মাদক ও আধিপত্য বিস্তারে প্রায়ই গোলাগুলি ও হামলার ঘটনা ঘটছে।

বিজ্ঞাপন

স্থানীয়রা বলছেন, আয়েশা হত্যার ঘটনা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে মাদকের টাকা ভাগাভাগির গল্প প্রচার করছে একটি চক্র। স্থানীয় সন্ত্রাসী মোমিন ও তার ছেলের নেতৃত্বে একটা কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা ভাঙারি ব্যবসায়ী মামুনের কাছে পাঁচ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে। এই চাঁদার টাকা না পেয়ে গত বুধবার (৩০ অক্টোবর) সকালে মামুনের ওপর হামলা চালায় মোমিন ও কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। এ সময় মামুনকে গুলি ও ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে আহত করা হয়। মামুনকে তুলে নিয়ে যাওয়ার সময় স্থানীয়দের প্রতিরোধের মুখে পড়লে মোমিন ও শাবু ফাঁকা গুলি ছোড়ে। যার একটি গুলি গিয়ে লাগে ভবনের দোতলার জানালায় দাঁড়িয়ে থাকা আয়েশার কপালে। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই শিশু সন্তানদের সামনে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন আয়েশা।


তবে নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র বার্তা২৪.কমকে নিশ্চিত করেছে, হামলার শিকার মামুনও বাউনিয়াবাঁধ বস্তির একজন চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ী। বাসার সামনে ভাঙ্গারি দোকান দিয়ে নিজেকে ব্যবসায়ী দাবি করলেও আদতে তিনি একজন মাদক কারবারি। তার মাদকের আয়ে ভাগ বসাতে চেয়েছিলেন মোমিনসহ স্থানীয় সন্ত্রাসীরা। তবে দাবিকৃত টাকা না দেওয়ায় এই হামলার ঘটনা ঘটে। মোমিনের ছোড়া গুলিতে আয়েশার মৃত্যু হলেও বেঁচে গেছে তার ছেলে আজমির। বাবার ছোড়া গুলি পায়ে লেগে গুরুতর আহত হয়েছে স্থানীয় কিশোর গ্যাং চক্রের মূলহোতা। হামলার ঘটনায় উপস্থিত না থাকলেও একটি পক্ষ জয়, জাহাঙ্গীর, আল ইসলাম ও সম্রাটকে আসামি করা হয়েছে।

সন্ত্রাসীদের গুলিতে গৃহবধু আয়েশা নিহতের ঘটনায় নিহতের স্বামী মিরাজুল পল্লবী থানায় বাদী হয়ে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলায় ১৭ জনের নাম উল্লেখসহ ১০/১২ জনকে অজ্ঞাত আসামি করা হয়েছে। মামলার আসামিরা হলেন, মমিন (৩৫), শাবু (২৮), সম্রাট (২৩), শামিম (৪৫), জয়নাল (৩২), পাতা সোহেল, কালা মোতালেব (৪০), ভাগ্নে মামুন (৩৮), জাহাঙ্গীর (৩৩), ভেজাল মামুন (৪২), আল-ইসলাম (৪৫), ইউনুস ওরফে ডিস্কু (৪০), রুবেল (৩৮), মজনু (৫০), কালন (৩৫), কামাল (৩৫) ও জয় (২৭)। এই ঘটনায় গ্রেফতার হয়েছেন- আল ইসলাম ও জাহাঙ্গীর নামের দুই আসামি।

বার্তা২৪.কমের হাতে আসা একাধিক সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বুধবার দুপুর ২টার দিকে অস্ত্র ও চাপাতি হাতে মামুনের বাসার গলিতে প্রবেশ করেন চিহ্নিত অস্ত্রধারী মমিন, শাবু, শামিম, জয়নাল, ইদ্রিস, কালা মোতালেব, কামাল, মামুন ওরফে ভেজাল মামুন, মোমিনের ছেলে আজমির, ইউনুস, রুবেলসহ অজ্ঞাতনামা আরও ১৪ থেকে ১৫ জন।

প্রত্যদক্ষদর্শীদের সঙ্গে ঘটনার বিষয়ে কথা বলতে গেলে এগিয়ে আসে হামলার শিকার মামুনের পরিবারের সদস্যরা। তারা দাবি করেন, মামুনের সঙ্গে মাদকের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। বাসার পাশেই ভাঙ্গারি ব্যবসা করে মামুন। এই ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকেই মোমিন পাঁচ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে। এখানে দুই দলের গোলাগুলির কোনো ঘটনা ঘটেনি। জয়, জাহাঙ্গীর, আল ইসলাম ও সম্রাট হামলার সময় ছিলো না। অথচ একটি পক্ষ জোর করে মামলায় তাদের নাম দিয়েছে। আরও অনেককে দিতে চেয়েছে। পছন্দ মতো আসামি না দিতে পারায় মামলার বাদীকে হুমকি দিয়েছে। ভয়ে সে বাসা ছেড়ে পালিয়েছে।

নানা সঙ্কায় স্ত্রীর লাশ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেলে কলেজ হাসপাতালের মর্গে ফেলে ঢাকা ছাড়া মিরাজুলের সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলার মাঝেও অন্তত তিন বার ছোট সন্তানের মায়ের আসার প্রশ্নের উত্তর দিতে শোনা যায় মিরাজুলকে।

স্ত্রীকে কোথায় দাফন দিয়েছেন জানতে চাইলে মিরাজুল বার্তা২৪.কমকে বলেন, আমার স্ত্রীর লাশ এখনো বাড়িতে আনা হয়নি। ময়নাতদন্ত শেষে লাশ নিয়ে স্বজনরা বাড়ির পথে আছেন। আমি বাচ্চাদের নিয়ে লাশের জন্য অপেক্ষায় আছি। আমার ছোট সন্তান দেখেছে তার মায়ের মাথায় গুলি লেগেছে। এটা সে বারবার দেখাচ্ছে। আর মা কখন আসবে জানতে চাচ্ছে। কি করবো বলেন। কি উত্তর দেবো।

লাশ না নিয়েই বাড়িতে যাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে মিরাজুল বলেন, ঘটনার পরে বুধবার রাতে থানায় মামলা হয়। মামলায় আসামি দেওয়া নিয়ে বিভিন্ন লোকজন নানা কথা বলতে থাকে। বিষয়টা থানার ওসিকে (ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) জানালে তিনি আমাকে ঢাকা থেকে গ্রামের বাড়ি চলে যাওয়ার পরামর্শ দেন। মামলায় আসামি করায় একটি পক্ষ ক্ষিপ্ত হয়েছে। এখন কি আর করবো বাধ্য হয়ে ওই রাতেই গ্রামের বাড়িতে চলে এসেছি।

সাজানো সংসারটা ওরা ধ্বংস করে দিলো উল্লেখ করে মিরাজুল বলেন, দুদিন আমার হাতে গাড়ি ছিলো না। তাই বাসায় ছিলাম। বুধবার সকালেও আমার স্ত্রীর সঙ্গে ভাত খেয়েছি। বাসা থেকে বের হয়ে শুনি এই ঘটনা ঘটেছে। ওরা ইচ্ছা করে আমার সাজানো সংসারটা ধ্বংস করে দিলো। দুই ছোট বাচ্চা নিয়ে আমি কি করবো কিছুই বুঝতে পারছি না।

মামলার বাদীকে হুমকি দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে পল্লবী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম বলেন, আমার কাছে কোনো তথ্য নেই। বাদী লাশ বুঝে নিয়ে গেছে। এই ঘটনায় আমরা দুজনকে গ্রেফতার করেছি।

কিছু মানুষকে ঘটনার সময়ে না থেকেও মামলার আসামি করা হয়েছে এমন প্রশ্নের জবাবে ওসি বলেন, এই কথাটি সত্য নয়। নিরাপরাদ কাউকে হয়রানির সুযোগ নেই। জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আমরা কাজ করছি।