তিন বছরে গড়েছেন সম্পদের পাহাড়, আত্মীয়ের বাড়িতে টাকা রাখতেন হাবিব
২০২০ সালের নভেম্বরে ঢাকা-১৮ আসনে উপনির্বাচনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাবিব হাসান। এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর মাত্র ৩ বছর ২ মাসে নগদ অর্থের পরিমাণ বেড়েছে ১১ গুণ। আর এই সময়ে দখল-চাঁদাবাজির করে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন এই সংসদ সদস্য।
নির্বাচনি হলফনামায় হাবিব হাসানের নিজের নামে একটি বাড়ির কথা উল্লেখ করেন। আর আয়ের সূত্র বলেন দোকান ভাড়া। ওই খাতে তার বছরে আয় ছিল ১০ লাখ ৬৪ হাজার ৭১২ টাকা। ২০২০ সালে তার ব্যাংকে ছিল ১১ লাখ ৪৬ হাজার ৭৪৪ টাকা, ২০২৪ সালে তা বেড়ে হয়েছে ১ কোটি ৪০ লাখ টাকা, যা ২০২০ সালের তুলনায় ২০২৪ সালে পৌনে ১১ গুণ।
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে হলফনামায় দেখা যায়, দুটি থেকে ছয়টি প্লটের মালিক হয়েছেন হাবিব হাসান। এই সময়ে ২টি গাড়ি থেকে ৬টি গাড়ির মালিক হন হাবিব। ২০২০ সালে হাবিব হাসানের ব্যাংকঋণ ছিল ২ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। ২০২৪ সালে সেই ঋণ তিনি পুরোপুরি পরিশোধ করেছেন। ২০২০ সালে তুরাগে হাবিবের প্লট ছিল দুটি। ২০২৪ সালে মোট তিনটি প্লটের মালিক হয়েছেন। এ ছাড়া ঢাকার পল্লবীতে ১৫ শতাংশের আরেকটি প্লট রয়েছে তার। ২০২৪ সালে উত্তরায় আরেকটি ছয়তলা ভবনের সাড়ে ১৩ শতাংশের মালিক হয়েছেন তিনি।
তবে হাবিব এসব অবৈধ অর্থ নিজের কাছে না রেখে রাখতেন আত্মীয়ের বাসায়। সরকার পতনের পর গত সেপ্টেম্বরে উত্তরার একটি বাড়িতে অভিযান চালিয়ে ১ কোটি ১৬ লাখ টাকা এবং বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা উদ্ধার করেছে পুলিশ। ঢাকা মহানগর পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, যে বাড়িতে অভিযান চালানো হয়, সেটি হাবিব হাসানের ছেলে আবির হাসানের শ্বশুরবাড়ি। জব্দ করা টাকা, বৈদেশিক মুদ্রা ও গাড়ি দুটি এমপি হাবিব হাসান ও তার পরিবারের সদস্যদের।
এলাকাবাসীর মতে, রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় হাবিবের ফ্ল্যাট, প্লট, মার্কেট ও বিলাসবহুল বাড়ি থাকলেও তিনি অনেক কিছুই গোপনে হ্যান্ডেল করতেন। উত্তরায় হাউজিং ব্যবসায় অংশীদার ও চাঁদাবাজিতে সর্বেসর্বা ছিলেন হাবিব। দুর্নীতির টাকার বড় অংশ কানাডায় পাচার করেছেন বলে উত্তরায় স্থানীয় অধিবাসীদের মধ্যে আলোচনা আছে। তারা জানান, কানাডায় হাবিব বাড়ি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন।
বিদেশে বাড়ি ও অর্থ পাচার
ঢাকা-১৮ আসনের সাবেক এমপি হাবিব হাসানের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান চলমান রেখেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তার নামে থাকা অর্থ-সম্পত্তি, ভূমি ও ব্যাংক হিসাবের তথ্য চেয়ে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে গত ১৪ সেপ্টেম্বর চিঠি দিয়েছে দুদক। এমপি ও মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক পদের অপব্যবহার করে হাবিব হাসান বিভিন্ন দুর্নীতি ও অনৈতিক কার্যক্রম জড়িয়ে পড়েন। তিনি অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে নিজের, স্ত্রী-ছেলে ও ভাইদের নামে কোটি কোটি টাকার সম্পদ গড়েছেন। হাবিবের ছেলে আবির হাসান তানিমের নামে কানাডার বেগমপাড়ায় ১৫ লাখ ৫০ হাজার কানাডিয়ান ডলারে বাড়ি ক্রয় করেছেন বলে স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে। এ ছাড়া দেশে-বিদেশে বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়েছেন তিনি।
আধিপত্য ও দখলদারত্ব
২০২০ সালে উপনির্বাচনে এমপি হন হাবিব হাসান। নির্বাচনি হলফনামায় সম্পত্তিতে অকৃষি নাল জমি দেখিয়েছেন ১৫০ শতাংশ, যা তিন বিঘার চেয়ে কিছু বেশি। কিন্তু তুরাগ থানার বাউনিয়া এলাকায় বিমানের রানওয়ের পাশ থেকে শুরু করে উত্তরা ১৭ নম্বর সেক্টর পর্যন্ত প্রায় ১১০ বিঘা সম্পত্তিতে নিজের নামে হাবিব সিটি ও বাবার নামে লি সিটি ঘোষণা করেছেন। এই বিস্তীর্ণ এলাকা উঁচু ইটের প্রাচীর দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে। ১৭ নম্বর সেক্টরের পাশের অংশে গেটের ওপর লতিফ সিটি নামে সাইনবোর্ড টাঙানো রয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এর মধ্যে ১০ বিঘা নিজে কিনেছেন। বাকি জমি হয় তিনি দখল করেছেন- না হলে নামমাত্র মূল্য দিয়ে জমি নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়েছেন। এমপি ও তার ক্যাডার বাহিনীর দাপটের কারণে প্রকৃত মালিক তাদের জমির ধারেকাছে যাওয়ার সুযোগ পাননি।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, কাঠাপ্রতি ৫ থেকে ৬ লাখ টাকার বিনিময়ে নিজ নামে লিখে নেওয়ার প্রস্তাব দেন হাবিব। কেউ বিক্রি করতে আপত্তি জানালে তাকে ভয়, হুমকি ও মামলা দেওয়ার কথা বলে জমি দখল করেন। অনেকের কাছ থেকে জমি রেজিস্ট্রি করে নির্ধারিত টাকার অর্ধেক পরিশোধ করেন। বাকি অর্ধেক টাকা বাকি রেখে পরে পরিশোধ করবেন বলে সময় নেওয়া হয়। এরপর পাওনাদার সময়মতো টাকা চাইতে গেলে হয়রানি শুরু করতেন।
উত্তরায় বিভিন্ন সেক্টরে একাধিক অবৈধ বার প্রতিষ্ঠা করা হয় হাবিবের পৃষ্ঠপোশকতায়। সেখানে রাত হলেই মিউজিকের সঙ্গে শুরু হতো উদ্যম নৃত্য ও মদ্যপান। চলত অসামাজিক কাজও। এসব বার থেকে প্রতি মাসে হাবিব হাসানের জন্য পার্সেন্টিস (এমপি মানি) যেত।
নামে-বেনামে বেড়েছে সম্পত্তি
এমপি হওয়ার এক বছরের মধ্যে উত্তরায় পৈতৃক বাড়িটিকে অনেকটা দোতলা রাজপ্রাসাদে রূপান্তর করেন হাবিব। পাশে থাকা সরকারি খাস জমিতে রিকশার গ্যারেজ, খাবার হোটেল ও নিম্নবিত্তদের টিনশেড ঘর নির্মাণ করে ভাড়া দেন। সে ঘরগুলো অবশ্য এখন বিএনপির নেতা-কর্মীদের দখলে। উত্তরা রাজলক্ষ্মী কমপ্লেক্সের পাশে পৈতৃক সম্পত্তিতে হাবিব হাসান নির্মাণ করেন আটতলাবিশিষ্ট একটি বিশাল মার্কেট।
এর বাইরেও উত্তরায় বিভিন্ন সেক্টরে হাবিবের নিজস্ব ২০টির মতো ফ্ল্যাট রয়েছে বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন। একাধিক বাড়ি রয়েছে হাবিবের। তবে এর মধ্যে অনেক বাড়ি লোকচক্ষুর আড়াল করতে নিজের পরিবারের সদস্যদের নামে কিনিছেন তিনি।
বলপ্রয়োগ করতে ব্যবহার করতেন ভাইকে
চার ভাইয়ের মধ্যে হাবিব হাসান ছিলেন মেজো। বড় ভাই মারা গেছেন। সেজো ভাই হাদিম, ছোট ভাই সোহেল। এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই জনকল্যাণমূলক কাজে মনোযোগ না দিয়ে চাঁদাবাজির দিকে মনোযোগী হন হাবিব। আর এমপি হাবিবের ক্ষমতা সমান তালে ব্যবহার- করতেন তার ছোট ভাই সালাউদ্দিন সোহেল। হাবিবের এই ভাই যেসব জায়গায় থাবা দিয়েছেন সেগুলো হলো উত্তরায় অবৈধ কাঁচাবাজার, পরিবহনে চাঁদাবাজি (লেগুনা-অটোরিকশা), ডিশ-ইন্টারনেট অ্যান্টেনা, ফুটপাতের চাঁদা, পদ-বাণিজ্য, সেক্টর কল্যাণ সমিতির নির্বাচন না দিয়ে কমিটি ঘোষণা, বিভিন্ন রাজনৈতিক প্রোগ্রামে ডেকোরেটরের কাজের টাকা না দেওয়া, হোটেল,
রেস্তোঁরা, ফার্নিচার মার্কেট, স্কুল-কলেজে চাঁদাবাজি, অবৈধ বিদ্যুৎ-গ্যাস সংযোগ ভাড়া, ময়লা পরিষ্কারের পার্সেন্টেজ ইত্যাদি। স্থানীয় বাসিন্দারা জায়গা বিক্রি করলেও সেখান থেকে হাবিবের হয়ে সোহেল পার্সেন্টেজ নিতেন। উত্তরার বাউনিয়ায় ভূমি দখল করে মার্কেট নির্মাণ করেছেন হাবিব। উত্তরা ১১ নম্বর সেক্টরে সোনারগাঁও জনপথ রোডে রাজউকের খালি প্লটের ফার্নিচার মার্কেট প্রতিষ্ঠা করেন সোহেল। সেখানে প্রায় ২০০টি ফার্নিচারের দোকান থেকে মাসে ভাড়া নিতেন সোহেল, যা এখন স্থানীয় বিএনপি ও তাদের সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীদের নিয়ন্ত্রণে।
হাবিব বাহিনীর দৌরাত্ম্য
হাবিব ও তার ভাই সোহেলের পকেটে প্রতি মাসে টাকা পৌঁছে দিত তাদের ক্যাডার বাহিনীর সদস্যরা। স্থানীয় পর্যায়ে আলাদা ওয়ার্ড ও জায়গা বুঝে আলাদা বাহিনী তাদের পকেটে টাকা পৌঁছে দিত। জমি দখলে হাবিবের প্রধান হাতিয়ার ছিলেন আওয়ামী লীগ নেতা নূর হোসেন। ফার্নিচার মার্কেটের চাঁদাবাজিতে যুক্ত রয়েছেন ৫১ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর শরীফুল ইসলাম ও তার অনুসারীরা। আব্দুল্লাহপুর মাছবাজারের চাঁদাবাবাজিতে যুক্ত হাবিবের অনুসারী কাউন্সিলর মোতালেব।
উত্তরা ১০ নম্বর সেক্টরসংলগ্ন কাঁচাবাজার থেকে ৫ লাখ টাকা চাঁদা পেতেন হাবিব ও ছেলে তানিম এবং ভাই সোহেল। এই বাজারের চাঁদা তুলতেন ‘আয়নাবাজ'খ্যাত নাজমুল। টাকার বিনিময়ে নিজের নামে অন্যকে জেল খাটান তিনি। এই নাজমুল স্থানীয়দের মাঝে পিস্তলবাজ হিসেবে পরিচিত। কথায় কথায় পিস্তল তাক করতেন তিনি। তার বাসায় অভিযান চালিয়ে র্যাব বিপুল মাদক উদ্ধার করে। তার বিরুদ্ধে একাধিক মামলাও চলমান রয়েছে।
তুরাগ থানা আওয়ামী লীগের সম্পাদক পর্যায়ের এক নেতা জানান, হাবিব হাসান একাই সব করতে মরিয়া ছিলেন। তার ভাইও তেমন ছিলেন। দলীয় এমপি হয়েও দলের নেতা-কর্মীদের জন্য কিছু করেননি। স্থানীয় জনগণের কল্যাণের দিকে তার মনোযোগ ছিল না। দলীয় নেতাদেরও নানাভাবে হয়রানি করেছেন। জমি দখলের প্রতিবাদ জানিয়ে সাধারণ মানুষ থানা-পুলিশে অনেক অভিযোগ করেছেন। হয়েছে অনেক বিচার-সালিশও। কোনো লাভ হয়নি। এখন তারা পলাতক। তবে সাধারণ নেতা-কর্মীদের ক্ষতি হয়ে গেল।
গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর তার হাবিব ও তার ভাইয়েরা পলাতক। বিভিন্নভাবে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে চাইলেও সম্ভব হয়নি।