প্রতিবেশীকে ফাঁসাতে মুনতাহাকে হত্যা, ধারণা বাবার
দেশব্যাপী আলোচিত সিলেটের কানাইঘাটে প্রতিবেশীকে ফাঁসাতে শিশু মুনতাহা আক্তার জেরিনকে হত্যা করা হতে পারে ধারণা করছেন তার বাবা শামীম আহমদ। মুনতাহা আক্তার জেরিন কানাইঘাট উপজেলার সদর ইউনিয়নের বীরদল ভাড়ারিফৌদ গ্রামের শামীম আহমদের মেয়ে।
শামীমের দাবি- প্রতিবেশী আব্দুল ওয়াহিদ ওরফে মটরকে ফাঁসাতে মুনতাহকে হত্যা করা হতে পারে। মঙ্গলবার (১২ নভেম্বর) বার্তা২৪.কমের প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে এই কথা জানান মুনতাহার বাবা।
শামীম আহমদ বার্তা২৪.কমকে বলেন, মটর ও মুনতাহার গৃহশিক্ষক মার্জিয়াদের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে বিরোধ রয়েছে। যা আশেপাশের সবাই জানেন। ওই বিরোধকে কেন্দ্র করে মুনতাহাকে হত্যা করা হয় ও পরবর্তীতে মটরের পুকুরে মরদেহ ফেলে তাকে ফাঁসাতে চেয়েছিল বলে মনে হচ্ছে। রোববার ভোররাতে পুকুরে মার্জিয়ার মা যখন মুনতাহার মরদেহ পুকুরে ফেলে দিতে চায় তখন মটর দেখে ফেলেন। পরে আলিফজান বিবি পালিয়ে যেতে চাইলে মটরসহ স্থানীয় লোকজন তাকে আটক করে।
মার্জিয়াদের সঙ্গে বিরোধের কথা স্বীকারও করেছেন আব্দুল ওয়াহিদ ওরফে মটর।
মটর বলেন, বেশ কিছুদিন আগে এক লোকের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল মার্জিয়ার। পরবর্তীতে ওই লোককে মার্জিয়া ও তার মা মারধর করে। তার বিচার করতে গিয়ে দোষী হয় তারা দুজন। তখন থেকে মার্জিয়া ও তার মা দাবি করেন আমার মেয়ের সঙ্গে ওই লোকের বিয়ে দেবে বলে তাদেরকে দোষী বানানো হয়েছে। এই থেকে আমার সঙ্গে তাদের বিরোধ।
তিনি আরও বলেন, মুনতাহা নিখোঁজের ৭ দিনের মাথায় তা ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতে আমার বাড়ির পুকুরে লাশ ফেলার পাঁয়তারা করেছিল মার্জিয়া ও তার মা। আল্লাহর মেহেরবানিতে খুনি মরদেহসহ গ্রামবাসীর হাতে ধরা পড়ে। আমি এই ঘটনায় জড়িতদের শাস্তি চাই।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, মুনতাহার মৃত্যুতে গ্রামজুড়ে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। দূর দূরান্ত থেকে ছুটে আসছে মানুষ। পরিবারের লোকজনকে শান্তনা দিচ্ছেন। ঘটনাস্থল ঘুরে দেখছেন। কথা বলছেন গ্রামের লোকজনের সাথে। সবার একটাই প্রশ্ন কেন মুনতাহাকে হত্যা করা হয়েছে। কি এমন অপরাধ ছিল, যার জন্য এভাবে হত্যা করতে হয়েছে।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ঘটনার পর থেকে ঘাতকরা মুনতাহাদের ঘরে যাওয়া আসা করেছিলেন। সাবেক গৃহশিক্ষিকা শামীমা বেগম মার্জিয়ার মা আলিফজান বিবি পূর্বের মতো বিভিন্ন স্থানে ভিক্ষার জন্য গিয়েছেন। তারাও মুনতাহাকে পরিবারের লোকজনের সঙ্গে খোঁজাখুজি করেছেন। কিন্তু কারো মুখে ছিল না কোনো দুশ্চিন্তার ছাপ। তারা স্বাভাবিকভাবেই জীবন-যাপন করছিলেন। তাদের আচরণে কেউ বুঝতেই পারেনি এই ঘটনায় তারা সম্পৃক্ত।
স্থানীয়রা বলছেন, মুনতাহাকে প্রাইভেট না পড়াতে নিষেধ ও চুরির ঘটনায় বিরোধে এমন ঘটনা ঘটাতে পারে। এই ঘটনার সঙ্গে যারা জড়িত তাদের কঠোর শাস্তি হওয়া উচিত।
পুলিশ ও পারিবারিক সূত্রে জানায়, শিশু মুনতাহা আক্তার জেরিনের কোথাও কোনো খোঁজ না পেয়ে বাবা শামীম আহমদ একটি সাধারণ ডায়েরি করেন থানায়। এরপর বিভিন্ন সময় তার কাছে বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে মুঠোফোনে কল দিয়ে টাকা পয়সা চাওয়া ও তথ্য দেয়া হয়। তাদের কথা শুনে সিলেটে নগরীসহ জেলার বিভিন্ন উপজেলায় পুলিশকে সঙ্গে নিয়ে তল্লাশি করা হয়। কিন্তু কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি মুনতাহাকে। শনিবার (৯ নভেম্বর) মুনতাহার বাবা মার্জিয়ার পরিবারকে কিছুটা সন্দেহ হচ্ছে বলে পুলিশকে জানান। পরে পুলিশ ওই রাতেই জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানায় নিয়ে আসে মার্জিয়াকে। এরমধ্যে ১০ নভেম্বর ভোর ৪ টার সময় খাল থেকে তুলে মুনতাহার প্রতিবেশী আব্দুল ওয়াহিদ ওরফে মটরের পুকুরে মরদেহ ফেলে দেওয়ার সময় মটরসহ স্থানীয় জনতা ধাওয়া দিয়ে মার্জিয়ার মা আলিফজানকে আটক করে।
গ্রামের বাসিন্দা জয়নাল বলেন, বাড়ি থেকে কাপড় নিয়ে সেগুলো কেটে ফেলে দেয়াকে কেন্দ্র করে মুনতাহার পরিবারের সঙ্গে মার্জিয়ার সামান্য কথা কাটাকাটি হয়। এই বিরোধের জেরে মুনতাহাকে নিয়ে গিয়ে মেরে ফেলেছে। মুনতাহার জন্য শুধু এলাকার মানুষ কাঁদেনি পুরো দেশের মানুষ কেঁদেছে। আমরা সঠিক বিচার চাই।
আবুল হাসান নামে আরেকজন বলেন, আমাদের গ্রামে এই ঘটনা একটি ন্যাক্কারজনক ঘটনা। এই ঘটনা কানাইঘাটের জন্য একটি কলঙ্কিত অধ্যায়। আমরা প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি এই ধরনের ঘটনা যারা ঘটিয়েছে তাদের যেন রেহাই না দেওয়া হয়। তাদেরকে আইনের আওতায় এনে ফাঁসির দাবি জানাচ্ছি।
এ ব্যাপারে সিলেটে জেলা পুলিশের কানাইঘাট সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার অলক শর্মা বার্তা২৪.কমকে বলেন, আমরা সবগুলো বিষয় নিয়ে কাজ করছি। আসামিদের ইতোমধ্যে ৫ দিনের রিমান্ডের জন্য থানা নিয়ে আসা হয়েছে। রিমান্ড শেষে হয়তো আরও কিছু তথ্য পেতে পারি।
প্রসঙ্গত, ৩ নভেম্বর সকালে নিখোঁজের আগে মুনতাহা আক্তার জেরিন তার বাবা শামীম আহমদের সঙ্গে স্থানীয় একটি মাদরাসার ওয়াজ মাহফিলে গিয়ে বাড়িতে আসে। পরে চিপস খাওয়ার জন্য ৫ টাকা চাইলে তার বাবা চিপস এনে দেন। কিছুসময় পর যোহরের ওয়াক্ত হওয়ায় মসজিদে নামাজে চলে যান শামীম। ওই সময়ে দুটি সবুজ রঙয়ের আপেল হাতে নিয়ে মায়ের চোখ ফাঁকি দিয়ে মুনতাহা ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। এরপর থেকেই আর তার খোঁজ পাওয়া যায়নি। গত শনিবার (৯ নভেম্বর) কানাইঘাট থানায় অজ্ঞাতনামাদের বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে একটি অপহরণ মামলা করেন। রোববার ভোররাতে মুনতাহার মরদেহ উদ্ধারের পর পুলিশ সেটাকে হত্যা মামলা হিসেবে রেকর্ড করে। ওই মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়েছে ৪ জনকে।
গ্রেফতারকৃতরা হলেন-কানাইঘাট থানার বীরদল ভাড়ারীফৌদ গ্রামের মৃত ময়না মিয়া আলিফজান (৫৫) ও তার মেয়ে শামীমা বেগম মার্জিয়া (২৫), একই এলাকায় ইসলাম উদ্দিন (৪০) ও নাজমা বেগম (৩৫)।
সোমবার (১১ নভেম্বর) আসামিদের সিলেট জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক কাজী মো.আবু জাহের বাদলের আদালতে তোলার পর মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা শামসুল আরেফিন জিহাদ ভূঁইয়া ৭ দিনের রিমান্ড চাইলে বিচারক ৫ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।