‘ভারতের বিএসএফ আমার মাইয়াডারে গুলি কইরা পাখির মতো মাইরা কাঁটাতারে ঝুলাইয়া রাইখছে। ১৪ বছর হইল, তারও বিচার পাইলাম না। বিচারের জন্য আর কত অপেক্ষা করতে হবে।’ফেলানীর কবরের সামনে দাঁড়িয়ে শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে কথাগুলো বলছিলেন কুড়িগ্রাম সীমান্তে নিহত কিশোরী ফেলানীর মা জাহানারা বেগম। তিনি আরও বলেন, ‘আগে যে সরকার ছিল, তারা অনেক আশা দিছে। আমার মেয়ের হত্যার বিচার করবে। কিন্তু কিছুই হয় নাই এলা তো নতুন সরকার আসল। এলা যদি তারা বিচারের ব্যবস্থাটা করে। আমি চাই, এমরা( সরকার) যেন ফেলানী হত্যার বিচার করে ।’
পরিবারের অভাব এবং নিজেদের অসহায়ত্ব প্রকাশ করে জাহানারা বেগম বলেন, ‘প্রতিবছর মৃত্যুবার্ষিকী আসলে টিএনওর কাছে যাই, ডিসির কাছে যাই। কিন্তু দুই বছর থেকে কোনো সাহায্য পাই না। আমার বাচ্চাগুলাকে কষ্ট করে পড়াশোনা করাইছি। কিন্তু চাকরি নাই। যেন আমার ছেলের জন্য একটা চাকরির ব্যবস্থা করে। ছোট চাকরি হলেও যেন দেয়। তাহলে অন্তত জীবনের বাকি দিনগুলা আমরা বাঁচতে পারব।’
২০১১ সালের ৭ জানুয়ারি কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার অনন্তপুর সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া অতিক্রম করার সময় বিএসএফের গুলিতে নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হন ১৪ বছরের কিশোরী ফেলানী খাতুন। দীর্ঘ সাড়ে চার ঘণ্টা কাঁটাতারে ঝুলে থাকে ফেলানীর রক্তাক্ত মৃতদেহ। দেশবিদেশে বিভিন্ন গণমাধ্যমসহ মানবাধিকার সংগঠনগুলোর তীব্র সমালোচনার মুখে পড়ে ভারতের ‘সীমান্ত নীতি’। আন্তর্জাতিক চাপের মুখে অভিযুক্ত বিএসএফ সদস্য অমিয় ঘোষের ‘বিচারের’ ব্যবস্থা করে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী। পরে ২০১৩ সালের ১৩ আগস্ট ভারতের কোচবিহারে জেনারেল সিকিউরিটি ফোর্সেস কোর্টে ফেলানী হত্যা মামলার বিচার শুরু হয়। বিএসএফের এই কোর্টে সাক্ষ্য দেন ফেলানীর বাবা নূরুল ইসলাম ও মামা হানিফ। ওই বছরের ৬ সেপ্টেম্বর আসামি অমিয় ঘোষকে খালাস দেয় বিএসএফের বিশেষ কোর্ট। পরে রায় প্রত্যাখ্যান করে পুনরায় বিচারের দাবি জানান ফেলানীর বাবা। ২০১৪ সালের ২২ সেপ্টেম্বর পুনরায় শুরু হলে ১৭ নভেম্বর আবারও আদালতে সাক্ষ্য দেন ফেলানীর বাবা।
২০১৫ সালের ২ জুলাই এই আদালত আবারও ফেলানী হত্যার আত্মস্বীকৃত আসামি অমিয় ঘোষকে খালাস দেন। দুই দফা অভিযুক্ত বিএসএফ সদস্য অমিয় ঘোষকে খালাস দেওয়ান রায় প্রত্যাখ্যান করে ২০১৫ সালে ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টে যৌথ রিট আবেদন করেন ফেলানীর বাবা নুরুল ইসলাম এবং ভারতের প্রখ্যাত মানবাধিকারকর্মী কিরিটি রায়। কিন্তু একের পর এক তারিখ পিছিয়ে আজও সেই রিটের নিষ্পত্তি হয়নি।
সর্বশেষ আজ ৭ জানুয়ারি সেই রিটের শুনানি হওয়ার কথা থাকলেও আবারও তারিখ পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। আগামী ২৯ জানুয়ারি শুনানির নতুন তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন ফেলানীর পরিবারকে আইনি পরামর্শ দেওয়াসহ ফেলানীর বাবার সঙ্গে ভারতে একাধিকবার সহযাত্রী হওয়া কুড়িগ্রামের সাবেক পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) ও মানবাধিকারকর্মী এস এম আব্রাহাম লিংকন। ভারতীয় মানবাধিকারকর্মী কিরিটি রায়ের বরাতে তিনি বলেন, ‘আবার তারিখ পিছিয়েছে। কার্যতালিকায় নতুন তারিখ ২৯ জানুয়ারি। আমি মনে করি, ভারতীয় উচ্চ আদালত রিটটির শুনানি নিয়ে ন্যায়বিচার করবেন। ফেলানীর পরিবার ন্যায়বিচার পেলে কারও জয় বা পরাজয় হবে না। সেটা মানবাধিকারের বিজয় হবে।
এস এম আব্রাহাম লিংকন বলেন, ‘ অমিয় ঘোষ আত্মস্বীকৃত খুনি। সে বলেছে, তার গুলিতে মারা গেছে। খুনিকে সাজা দেওয়াই ন্যায়বিচার, খালাস ন্যায়বিচার নয়। আমরা বিএসএফের আদালতে ন্যায়বিচার পাইনি। ভারতের উচ্চ আদালতের গ্রহণযোগ্যতা বিশ্বজুড়ে রয়েছে। তাঁরা যদি ন্যায়বিচার করেন, তাতে ভারতের রাষ্ট্রীয় আইনের সুরক্ষা হবে। সীমান্ত ব্যবস্থাপনায় ভারতীয় নাগরিকদের জন্য সেটা সুরক্ষা দেবে। সেটা মানবতার বিজয় হবে, কারও পরাজয়ের প্রশ্ন আসবে না।’
ব্র্যাকের মাইগ্রেশন ও ইয়ুথ প্ল্যাটফর্মের সহযোগী পরিচালক শরিফুল হাসান বলেন, ‘ প্রত্যেকটা মৃত্যুই দুঃখজনক আর বিনা কারণে সীমান্তে হত্যা তা আরো দু:দুঃখজনক। ফেলানী হত্যাকাণ্ড সীমান্তে বিনা বিচারের হত্যাকাণ্ডের একটি প্রতীক হয়ে উঠেছে আন্দোলিত করেছে সারা দেশের মানুষকে। এই হত্যাকাণ্ডের বিচার হওয়া জরুরি।’ তিনি আরো বলেন,‘ যেখানে বহি : বিশ্বের দেশগুলোতে বর্ডার কাঁটাতারের বেড়া দিচ্ছি। সেখানে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে এমন ঘটনা বিরল। প্রতিবেশী দেশগুলোর উচিত পারস্পরিক সম্পর্ক বাড়ানো।’