যাত্রী দিয়ে ঠাসা বরিশালে লঞ্চ, তবুও লোকসানের অজুহাত
বরিশাল-ঢাকা নৌরুটে প্রতিদিন দুইটি করে লঞ্চ চলাচল করছে রোটেশন ব্যবস্থায়। কিন্তু দিনের পর দিন কোনো কেবিন খালি না থাকার সত্ত্বেও মালিকদের দাবি, তারা লোকসানের মুখে। অথচ বাস্তব পরিস্থিতি দেখে প্রশাসন ও যাত্রীরা মনে করছেন, এ দাবি শুধু নতুন ঋণের সুবিধা পেতে লঞ্চ মালিকদের চাল।
সোমবার (১৩ জানুয়ারি) সন্ধ্যায় বরিশাল নৌবন্দরে সরেজমিনে দেখা যায়, ঢাকাগামী এমভি অ্যাডভেঞ্চার ৯ ও এমভি মানামী লঞ্চের পরিস্থিতি। সকাল থেকেই যাত্রীরা কেবিন পাওয়ার জন্য ছুটোছুটি করলেও কোনো কেবিন ফাঁকা নেই। বরিশাল সদর উপজেলার চরবাড়িয়া ইউনিয়নের বাসিন্দা মো: আলম হাওলাদার সকাল থেকে অ্যাডভেঞ্চার ও মানামী লঞ্চে কেবিন খুঁজে বেড়ালেন। কিন্তু সব অফিস আর টিকিট কাউন্টার থেকে একই উত্তর কেবিন ফাঁকা নেই।
সব কেবিন বুকড, তবুও লোকসান
জানা গেছে, প্রতিটি লঞ্চে কমপক্ষে সাড়ে তিনশো কেবিন, এর মধ্যে ৭০ থেকে ৭৫টি ডাবল কেবিন ও ১২৫ থেকে ১৩০টি সিঙ্গেল কেবিন থাকে। ভাড়া যথাক্রমে ২২০০ ও ১১০০ টাকা। এছাড়া ভিআইপি ও ফ্যামিলি কেবিনও পূর্ণ থাকে। ডেকে থাকা যাত্রীদের ভিড় তো আছেই। এরপরও কীভাবে লঞ্চ মালিকরা লোকসানের দাবি করেন এ প্রশ্ন তুলছেন যাত্রীরাও।
প্রতিদিন বিকেল ৫টার পর লঞ্চঘাটে যাত্রীর কোলাহল তুঙ্গে ওঠে। সন্ধ্যা নাগাদ লঞ্চ স্টাফদের হাঁকডাকে পুরো এলাকাটি কর্মব্যস্ত হয়ে ওঠে। ৮টা বা ৯টায় লঞ্চ ছাড়ার আগে কেবিন ভাড়া থেকে শুরু করে স্টাফদের বাসস্থানও যাত্রীদের কাছে ভাড়া দেয়া হয়। এমনকি লঞ্চের ডেকে বিছানা পেতে টিকিটসহ বিক্রি হচ্ছে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকায়।
বরিশাল থেকে ঢাকাগামী যাত্রী ইয়াছিন হাওলাদার জানান, ডেকের ইঞ্জিন রুমের পাশে শীতের রাতে একটু গরমের জন্য জায়গা চাইতে গেলেও তাকে বাধা দেয়া হয়। অন্যদিকে, নিজের বিছানা পেতে থাকা একজন যাত্রী বলেন, সড়কে দুর্ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় লঞ্চে যাত্রী বাড়ছে। আর এই সুযোগে লঞ্চ শ্রমিকরা ইচ্ছামতো স্বেচ্ছাচারিতা করছে।
বেশ কয়েকজন যাত্রীরা এক কথায় স্বীকার করছেন, পদ্মা সেতুর কারণে লঞ্চে যাত্রী কমার যে ধরণা ছিল তা এখন পুরোপুরি উল্টো। বরং শীতকালীন ছুটিতে ঢাকার সদরঘাট থেকে শুরু করে লঞ্চের প্রতিটি রুটে যাত্রীদের বাড়তি চাপ লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
মানামী লঞ্চের মালিকের মো: আবদুল সালাম বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে লোকসানের অভিযোগ তোলা সঠিক নয়, আমরা সবসময় যাত্রীদের সেবা নিশ্চিত করতে সচেষ্ট। রোটেশন ব্যবস্থার চাপ এবং অন্যান্য সমস্যার মধ্যেও সঠিক সেবা দিতে কাজ করছি।
যুবরাজ লঞ্চের মালিক মো: কালাম হোসেন বলেন, ডেকের যাত্রী দিয়ে লঞ্চ চলে। কেবিনের যাত্রী দিয়ে নয়। তিনি স্বীকার করেন, বর্তমানে লঞ্চ ব্যবসায় লোকসান নেই, তবে নতুন লঞ্চগুলো রোটেশনে ঢুকতে বাধার সম্মুখীন হচ্ছে।
সুরভী লঞ্চের মালিক রিয়াজুল কবির এবং সুন্দরবন লঞ্চের ব্যবস্থাপক জাকির হোসেন রিপনের মতে, রোটেশন ব্যবস্থায় নির্ধারিত লঞ্চ চলায় কিছুটা চাপ তৈরি হলেও ব্যবসা টিকিয়ে রাখার জন্য এটি কার্যকর। তারা বলছেন, রোটেশন তুলে নিলে যে সামান্য মুনাফা এখন হচ্ছে তাও থাকবে না।
এ্যাডভেঞ্চার লঞ্চের নিজাম শিপিং লাইনস এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিজাম উদ্দিন জানান, যাত্রীদের চাপ অনেক বেড়েছে, তবে আমাদের উদ্দেশ্য একটাই প্রতিটি যাত্রীকে সুন্দর ও মানসম্মত সেবা প্রদান করা। রোটেশন ব্যবস্থার কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে, তবে আমরা আমাদের ব্যবসাকে আরও সমৃদ্ধ করতে এবং যাত্রীদের স্বাচ্ছন্দ্য নিশ্চিত করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।
অন্যদিকে নৌবন্দরের উপপরিচালক শেখ মোহাম্মদ সেলিম রেজা জানান, রোটেশন পুরোপুরি মালিক সমিতির স্বেচ্ছাচারিতার ফসল। এ পদ্ধতি জনসাধারণের জন্য হয়রানির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। রোটেশন তুলে নিয়মিত তিনটি লঞ্চ চালানোর অনুরোধ করলেও মালিক পক্ষ কোনো সাড়া দেয়নি।
যাত্রীদের কষ্টের মধ্যে লঞ্চ মালিকদের মুনাফার প্রতিযোগিতা যেনো থেমে নেই। তবে দৃষ্টিকটু বিষয় হলো, পূর্ণ যাত্রী নিয়েও লোকসানের দাবী করা মালিকদের দ্বিচারিতা। সাময়িক চাপকে পুঁজি করে যদি এ ব্যবসায়ীরা যাত্রীসেবার পরিবর্তে মুনাফার দিকে মনোযোগী হয়, তাহলে নৌপথে ভোগান্তির চিত্র আরও ভয়াবহ হতে পারে বলে মনে করছেন সচেতন মহল।