ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলা গত দুই বছরে পিডিবি ও পল্লী বিদ্যুতের ১২৭ টি ট্রান্সফমার চুরির ঘটনা ঘটেছে। চুরি বৃদ্ধি পাওয়ায় চোর ধরতে পুরস্কার ঘোষণা করেছে বিদ্যুৎ বিভাগ।
জানা যায় গত ১৪ ডিসেম্বর উপজেলার রাওনা ইউনিয়নের দীঘা গ্রাম থেকে ৬টি ট্রান্সফরমার চুরি হয়। পাশাপাশি দুটি খুঁটিতে থাকা ৬ টি ট্রান্সফরমারে এলাকাটির প্রায় ১৫০ একর জমিতে সেচ দেওয়া হতো। ট্রান্সফরমার চুরির ঘটনায় সাবেক পুলিশ সদস্য মাকছুদুল ইসলাম বাদি হয়ে ঐদিনই অজ্ঞাত পরচিয় ব্যাক্তিদের আসামী করে থানায় অভিযোগ দিয়েছেন।
ট্রান্সফরমার চুরি হওয়া ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, খুঁটিতে ট্রান্সফরমার থাকলেও ভেতর থেকে খুলে নেওয়া হয়েছে তামার তার। নিচে পড়ে আছে কিছু ধাতব জিনিস৷
মাকছুদুল ইসলাম বলেন, চাকরি থেকে অবসর নিয়ে সেচযন্ত্র চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতাম। কিন্তু চোরের দল আমাকে পথে বসিয়ে দিল।
ময়মনসিংহ পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-২ এর গফরগাঁও জোনাল অফিসের আওতায় উপজেলায় গ্রাহক রয়েছেন প্রায় ৬৬ হাজার ৩৬ জন। এর মধ্যে সেচ গ্রাহক রয়েছেন প্রায় ৯০০ জন। সেচ কাজে ব্যবহৃত পল্লী বিদ্যুতের বেশির ভাগ ট্রান্সফরমার মাঠে নির্জন স্থানে স্থাপন করা হয়।
২০২৩ সালে উপজেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে ২৫, ১৫, ১০ ও ৫ কেভি ক্ষমতাসম্পন্ন ৬১টি ট্রান্সফরমার এবং চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ১৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৪০ টি ট্রান্সফরমার চুরি হয়। প্রায় দুই বছরে ১০১ টি ট্রান্সফরমার চুরি হয় পল্লী বিদ্যুতের। চলতি বছরের অক্টোবরে ২ টি, নভেম্বরে ৩ টি ও চলতি ডিসেম্বরে ৬ টি ট্রান্সফরমার চুরির ঘটনা ঘটেছে। ওই অবস্থায় ট্রান্সফরমার চুরি ঠেকাতে পুরো উপজেলায় মাইকিং করা হচ্ছে।
পল্লী বিদ্যুৎ বিভাগ জানিয়েছে, চুরি হওয়ার পর ট্রান্সফরমার প্রতিস্থাপন করতে সাধারণ গ্রাহকের অর্ধেক মূল্য দিয়ে প্রথম বার ও দ্বিতীয়বার চুরি হলে পুরো মূল্য দিতে হয়। আর সেচের বেলায় চুরি হওয়ার পর পুরো মূল্য দিয়ে নতুন ট্রান্সফরমার কিনে স্থাপন করতে হয়। চুরি হওয়ার পর ট্রান্সফরমার কেনার টাকা যোগান হতে দেরি হওয়ায় ট্রান্সফরমার পুনরায় স্থাপনেও বিলম্ব হয়। এতে গ্রাহক ও কৃষকেরা পড়েন দুর্ভোগে।
ময়মনসিংহ পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-২ এর গফরগাঁও জোনাল অফিসের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার (অতিরিক্ত দায়িত্ব) মো. জিয়াউর রহমান খান বলেন, ট্রান্সফরমার চুরির পর প্রত্যেকটি ঘটনায় থানায় জিডি করা হয়। ট্রান্সফরমারের ভেতরে থাকা কয়েলের জন্যই চুরির ঘটনা ঘটে। চোর চক্র গাজীপুর ও কিশোরগঞ্জ এলাকা থেকে আসে, এলাকার কিছু লোকও জড়িত। শীত মৌসুমে চুরির প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। মাঝে কিছু সময় চুরি কমলেও আবার বেড়েছে। চুরি রোধে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সাহায্য চাই, কিন্তু তাও কমছে না। চুরি রোধে গ্রাহকদের সচেতন রাখতে আজও মাইকিং করা হয়।
অপরদিকে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ বিক্রয় ও বিতরণ (পিডিবি)-র আওতাভুক্ত গফরগাঁওয়ে সংযোগ লাইন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু হয়ে গাজীপুরের টোক পর্যন্ত। এ এলাকায় ৪২০ কিলোমিটার জুড়ে রয়েছে লাইন। গ্রাহক সংখ্যা প্রায় ৭১ হাজার। পুরো এলাকায় বর্তমানে ৭৬৩ টি ট্রান্সফরমার রয়েছে। ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে গতকাল পর্যন্ত মোট ২৬ টি বিভিন্ন আকারের ট্রান্সফরমার চুরি হয়েছে। ২০২৩ সালে ১৪ টি এবং চলতি বছর ১২ টি ট্রান্সফরমার চুরি হয়েছে।
পিডিবি জানিয়েছে, উপজেলার রসুলপুর ইউনিয়ের ভরভরা টাওয়ারের মোড় এলাকায় ২৯ নভেম্বর ৫০ কেভি ট্রান্সফরমারের কয়েল চুরি হয়। একই ইউনিয়নের গোপপাড়া এলাকায় ১০০ কেভি ট্রান্সফরমার গত ২২ নভেম্বর খুলে ভেতরে থাকা তামার তার নিয়ে যায়। গত ১২ ডিসেম্বর ত্রিশালের ইছমতি এলাকার ২৫০ কেভি ট্রান্সফার সংযোগ বিচ্ছিন্ন করলেও বিদ্যুৎ বিভাগের তৎপরতায় নিতে পারেনি।
পিডিবির গফরগাঁও বিদ্যুৎ বিক্রয় ও বিতরণ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মোশারফ হোসেন বলেন, ‘সংঘবদ্ধ চোর চক্র রাতের অন্ধকারে পিকআপ ভ্যান নিয়ে দ্রুত ট্রান্সফরমার খুলে নিয়ে যায়। মূলত ট্রান্সফরমারের তামার তারের জন্য চুরি হচ্ছে৷ এসব ঘটনায় আমরা নিয়ম অনুযায়ী সাধারণ ডায়েরি করি। কিন্তু চোর ধরা পড়ছে না, সমস্যাটি প্রকট আকার ধারণ করেছে। সেপ্টেস্বর-অক্টোবর থেকে সমস্যাটি বেড়েছে। এতে গ্রাহকদের চাপে থাকতে হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, আমরা রাত জেগে পাহারা দিচ্ছি। শুধু যে গফরগাঁওয়ে চুরি হচ্ছে তা নয়, আশপাশের উপজেলায় চুরি হলেও আমাদের এখানে বেশি ঘটছে। তিনি আরও বলেন, আমাদের একটি ট্রান্সফরমারের গড় মূল্য চার থেকে সাড়ে চার লাখ টাকা। কিন্তু চোর চক্র তামার তার খুলে খুব সামান্য টাকা পায়। তার জন্য আমাদের সকলের ভোগান্তি।
তামার তারের জন্য চুরি হয় ট্রান্সফরমার
চোরচক্র বিদ্যুতের খুঁটিতে স্থাপন করা ট্রান্সফরমার গুলো নামিয়ে তার ভেতরে থাকায় তামার তারের কয়েল খুলে নেয়। ট্রান্সফরমারের ভেতরে থাকা সেই তামার তারের কয়েলগুলোকে মূল্যবান বিবেচনা করা হয়। কেজি দরে সেই তার গুলোই বিক্রি করা হয়। ৫ কেভি ক্ষমতার ট্রান্সফরমারে প্রায় ৯ কেজি, ১০ কেভি ক্ষমতার ট্রান্সফরমারে প্রায় ১৯ কেজি, ১৫ কেভি ক্ষতার ট্রান্সফরমারে ২৪ কেজি, ২৫ কেভি ক্ষমতার ট্রান্সফরসারে প্রায ৩০ কেজি তামার তার থাকে। পুরোনো তামার তার ৯০০ থেকে ১ হাজার টাকা কেজি তরে বিক্রি করা যায়। মূলত তামার তারের জন্যই ট্রান্সফরমার চুরি হয় বলে জানিয়েছেন বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তারা।
চুরি ঠেকাতে বিশেষ সম্মাননা ঘোষণা
গত ২৩ নভেম্বর গফরগাঁও পিডিবি নিজেদের ফেসবুকে জরুরি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। ট্রান্সফরমার চুরির বিষয়টি গ্রাহকদের জানিয়ে চুরি ঠেকাতে গ্রাহকদের সতর্ক থাকার কথা বলা হয়। যদি গভীর রাতে সন্দেহজনক কোন কার্যকলাপ চোখে পড়ে, তাহলে নিজেরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিবেন, একই সাথে বিদ্যুৎ বিভাগকে তথ্য জানাতে বলা হয়। যারা এই চোরের গ্রুপকে ধরিয়ে দিতে পারবে, তাদেরকে বিশেষ সম্মাননা প্রদান করার ঘোষণা দেওয়া হয়।
পিডিবির গফরগাঁও বিদ্যুৎ বিক্রয় ও বিতরণ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মোশারফ হোসেন বলেন, চুরি ঠেকাতে প্রতিরাতে আমাদের একাধীক টিম টহল দিচ্ছে। এলাকায় মাইকিং ও লিফলেট বিতরণ করক হচ্ছে। আমাদের একার পক্ষে চুরি রোধ সম্ভব নয়, সে কারণে সাধারণ মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে বিশেষ পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে।
গফরগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শিবিরুল ইসলাম বলেন, চুরি রোধে আমাদের টহল কার্যক্রম অব্যহত রয়েছে। ইতোপূর্বে ট্রান্সফরমার চুরির ঘটনায় দুটি মামলা হয়েছিল৷ সেই চক্রটি জামিনে এসে আবার এ ধরণের ঘটনায় জরাচ্ছে না নতুন কোনো গ্রুপ কাজ গুলো করছে সে বিষয়ে তদন্ত চলছে৷ আশপাশের চোরদেরও নজরদারিতে রাখা হয়েছে। চুরি রোধে পুরো এলাকায় পুলিশের টহল বৃদ্ধি করা হয়েছে।