সিলেটের উন্নয়নে বরাদ্দ হাজার কোটি টাকা
চারদিকে পাহাড়, টিলা আর চা বাগানে ঘেরা মনোরম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জেলা সিলেট। বিগত এক দশকে যখন সারা দেশে একের পর এক উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে, সেখানে সিলেটের উন্নয়নের গতি ‘তুলনামূলক’ ছিল তলানিতে। খানাখন্দে ভরা রাস্তাঘাট, যানজট, অনুন্নত ড্রেনেজ ব্যবস্থা, সামান্য বৃষ্টির পানিতে রাস্তাঘাট ডুবে জলাবদ্ধতায় নিত্য দুর্ভোগ পোহাতে হত সিলেটবাসীকে।
তাই সিলেট নগরীর অবকাঠামোগত উন্নয়নের দাবি ছিল দীর্ঘদিনের। অবশেষে সিলেটবাসীর জন্য অবকাঠামোগত উন্নয়নে মেগাপ্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। আগামী চার বছরের মধ্যে সিলেট নগরীর উন্নয়নে প্রায় ১২২৮ কোটি এক লাখ ৮৭ হাজার টাকার প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে। প্রকল্পটি গ্রহণ করেছে স্থানীয় সরকার বিভাগ, স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়, যা বাস্তবায়ন করবে সিলেট সিটি কর্পোরেশন (এসসিসি)।
জানা গেছে, চলতি বছরের ৩০ মে ‘সিলেট সিটি কর্পোরেশনের জলাবদ্ধতা নিরসন, বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ ও অবকাঠামো নির্মাণ’ শীর্ষক প্রকল্প প্রস্তাবনা পরিকল্পনা কমিশনে পাঠিয়েছে স্থানীয় সরকার বিভাগ, স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়। এরপর ৩ জুলাই প্রস্তাবনার ওপর মূল্যায়ন কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভার আলোকে ৯ জুলাই কার্যবিবরণী জারির পর ২২ অক্টোবর পুনর্গঠিত প্রস্তাবনা পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়। এর আলোকে সেটি গত ২৪ ডিসেম্বর জাতীয় অর্থনৈতিক নির্বাহী কমিটির সভায় অনুমোদিত হয়। ২০০১ সালে সিলেট সিটি কর্পোরেশন গঠিত হওয়ার পর থেকে এটিই হলো সবচেয়ে বড় উন্নয়ন বরাদ্দ।
প্রকল্পটি মূল্যায়ন করতে গিয়ে পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের সদস্য শামীমা নার্গিস বলেন, প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে সিলেট সিটি কর্পোরেশন এলাকার সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, ড্রেনেজ ব্যবস্থা উন্নয়নের মাধ্যমে জলাবদ্ধতা দূরীকরণ, বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদারকরণ, উন্নয়ন কার্যক্রমের গুণগত মান নিশ্চিত করার লক্ষ্যে যন্ত্রপাতি ও যানবাহন সরবরাহ করা হবে। এ বিবেচনায় প্রকল্পটি অনুমোদনযোগ্য।
জানা গেছে, অবস্থানগত কারণে সিলেট নগরীতে প্রচুর বৃষ্টিপাত হওয়ায় রাস্তাঘাট অধিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পাহাড়ি ঢলে ছড়া ও ড্রেনগুলো মাটি দিয়ে ভরাট হয়ে যায়। তাই অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত হলে নগরীতে দেখা যায় জলাবদ্ধতা। তাই নগরীর সড়ক উন্নয়ন, জলাবদ্ধতা নিরসনে ড্রেনেজ ব্যবস্থার উন্নয়ন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও সড়ক ব্যবস্থাপনা ও এর কার্যক্রমের গুণগত মান বজায় রাখার জন্য নানা ধরনের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বাস্তবায়ন হবে।
প্রকল্পের আওতায় ২৬২ কিলোমিটার রাস্তা উন্নয়ন করা হবে। মহানগরীর পুকুর সংরক্ষণ ও ভূমিধস হতে নগরবাসীকে রক্ষার জন্য ৯ কিলোমিটার আরসিসি রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণ করা হবে। ফুটপাথ ব্যবহারে পথচারীদের আকৃষ্ট করার জন্য ফুটপাথের উপর ৬৫ কিলোমিটার পেভিং ব্লক স্থাপন করা হবে, সড়ক দুর্ঘটনা এড়ানো ও রাস্তার সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য ২০ কিলোমিটার বৃক্ষ রোপণসহ রোড ডিভাইডার নির্মাণ করা হবে, নগরবাসীর নিরাপদ ও আরামদায়ক ভ্রমণের সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধির জন্য ৬টি পাবলিক টয়লেট নির্মাণ করা হবে।
প্রকল্প সূত্রে জানা যায়, নগরীর উন্নয়নে আরও ৩২৭ কিলোমিটার ড্রেন, ১৯৫ কিলোমিটার পাইপ লাইন স্থাপন, ১৪৫ কিলোমিটার সড়কবাতি স্থাপন, ৮ কিলোমিটার রিটেইনিং ওয়াল, ১ কিলোমিটার ভূমিধস রোধে সিসি ব্লক স্থাপন, ২০টি যন্ত্রপাতি ও ৩৬টি যানবাহন ক্রয় করা হবে।
প্রকল্পটির বছরভিত্তিক ব্যয় বিভাজন তালিকা থেকে জানা যায়, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ব্যয় করা হবে ২৬৯ কোটি ৫০ লাখ টাকা, ২০২০-২১ অর্থবছরে ব্যয় হবে ২৯৩ কোটি ৫৯ লাখ টাকা, ২০২১-২২ অর্থবছরে ব্যয় হবে ২৯৮ কোটি ৪৬ লাখ ৮৭ হাজার টাকা, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ব্যয় হবে ৩৬৬ কোটি ৪৬ লাখ টাকা।
অন্যদিকে অঙ্গভিত্তিক ব্যয় বিভাজন তালিকা থেকে জানা যায়, প্রকল্পটির মোট ব্যয়ের সিংহভাগ ধরা হয়েছে আরসিসি রাস্তা, আরসিসি ড্রেন, আরসিসি ড্রেনসহ ফুটপাত নির্মাণ খাতে।
সিলেটের উন্নয়নের জন্য হাজার কোটি টাকার প্রকল্প পাস হওয়ায় মহানগরীতে আনন্দের ছোঁয়া লেগেছে। বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য সিলেটের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী বলেন, প্রধানমন্ত্রী সিলেটের উন্নয়নের ব্যাপারে সবসময়ই সচেষ্ট। সিলেট নগরীর উন্নয়নে আমরা যে প্রকল্প প্রস্তাবনা পাঠিয়েছিলাম, তা কোন কাটছাঁট না করেই পাস করেছেন। সিলেট সিটি করপোরেশনের ইতিহাসে এত বড় প্রকল্প এর আগে অনুমোদন পায়নি। একনেকে এই প্রকল্প পাসের জন্য সিলেট নগরবাসীর পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেনকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
সিলেট নগরীর উন্নয়নে বিপুল পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ দেওয়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগ। মহানগর সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা মাসুক উদ্দিন আহমদ ও সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক জাকির হোসেন এক যৌথ বিবৃতিতে বলেন, সিলেটের উন্নয়নের দায়িত্ব নিয়েছিলেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। জাতির জনকের কন্যা যে কথা দেন, সেটা রক্ষাও করেন। এর প্রমাণ সিলেটের উন্নয়নে এক সঙ্গে এক হাজার কোটি টাকার প্রকল্প পাস। এর আগে কখনই সিলেটের উন্নয়নে এক সঙ্গে এত বরাদ্দ পাওয়া যায়নি।