চট্টগ্রামের বিভিন্ন হাসপাতাল, রেস্তোরাঁ, বাসস্থান ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের খাবার পানির নমুনায় ৫ দশমিক ৩৩ শতাংশে টাইফয়েডের জীবাণু শনাক্ত হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো, এই জীবাণুগুলোর ৮৭ দশমিক ৫ শতাংশ নমুনা মাল্টি ড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট জীবাণু হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে, যা চিকিৎসা প্রক্রিয়াকে আরো কঠিন করে তুলছে। জীবাণুর এ উপস্থিতি শুধু বাংলাদেশ নয়, বৈশ্বিক জনস্বাস্থ্যের জন্যও এক গুরুতর হুমকি বলে মনে করছেন গবেষকরা।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) একদল গবেষকের গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে। বিশ্ববিদ্যালয়টির জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. এ এম মাসুদুল আজাদ চৌধুরীর নেতৃত্বে এ গবেষণা চালানো হয়। গবেষণায় যুক্ত ছিলেন একই বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সোহানা আকতার মিনা, পবিত্র দেবনাথ, একেএম জাকির হোসাইন, জাহিদ হাসান। গবেষণাপত্রটি আন্তর্জাতিক সেল পাবলিকেশনের ‘হেলিয়ান’ জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে।
গবেষকরা জানিয়েছেন, মাল্টি ড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট জীবাণু সাধারণত চিকিৎসায় ব্যবহৃত অ্যান্টিবায়োটিকগুলোর প্রতি প্রতিরোধ গড়ে তোলে, ফলে রোগের চিকিৎসা অধিকতর জটিল হয়ে পড়ে। বিশেষজ্ঞরা স্বাস্থ্যঝুঁকি থেকে সুরক্ষিত থাকতে জনগণের মধ্যে নিরাপদ পানি ব্যবহারের পাশাপাশি স্যানিটেশন সম্পর্কিত সচেতনতা বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন।
জানা গেছে, ২০২২ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু হয়ে নগরীর বিভিন্ন এলাকার স্বাস্থ্যকেন্দ্র, রেস্টুরেন্ট এবং বাসস্থান থেকে ১৫০টি নমুনা সংগ্রহ করা হয়। যা পরবর্তীতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগের ল্যাবরেটরি অফ মাইক্রোবায়াল এন্ড ক্যান্সার জিনোমিক্স গবেষণাগারেই গবেষণার কাজ সম্পন্ন করেন গবেষকরা। ১৫০টি নমুনার ৮টিতে সালমোনেলার টাইপ (টাইফয়েড) জীবাণু শনাক্ত হয়। এর মধ্যে ৮৭ দশমিক ৫ শতাংশ নমুনা মাল্টি ড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট জীবাণু হিসেবে চিহ্নিত হয়।
বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দিয়েছেন, নিরাপদ পানি ব্যবহারের পাশাপাশি খাবারের সঠিক স্যানিটেশন নিশ্চিত করা জরুরি। এক্ষেত্রে জনগণের মধ্যে স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে এই সমস্যা মোকাবিলা করা সম্ভব বলে মনে করছেন তারা।
এটি জনস্বাস্থ্যের জন্য অশনিসংকেত উল্লেখ করে গবেষকসহ চিকিৎসকরা বলছেন, এ পরিস্থিতি শুধু পানিবাহিত রোগের প্রাদুর্ভাবই বাড়াচ্ছে না, বরং অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী জীবাণুর (মাল্টি ড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট) দ্রুত বিস্তারের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। যা জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকিস্বরূপ।
গবেষক অধ্যাপক ড. এ এম মাসুদুল আজাদ চৌধুরী বলেন, এই গবেষণার ফলাফল শুধু বৈজ্ঞানিক গুরুত্বই বহন করে না; বরং এটি বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্যের জন্য একটি গুরুতর সতর্কবার্তা। খাবার পানিতে এই জীবাণুর উপস্থিতি প্রমাণ করে পানির মাধ্যমে এর সংক্রমণের ঝুঁকি অনেক বেশি। এই পরিস্থিতি বাংলাদেশের মতো একটি জনবহুল দেশে দ্রুত মহামারি আকার ধারণ করতে পারে। মাল্টি ড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট জীবাণু এমন একটি হুমকি তৈরি করে, যেখানে প্রচলিত ওষুধ কার্যকর হয় না। নতুন ও শক্তিশালী অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের প্রয়োজন হয়, যা বেশ ব্যয়বহুল এবং সময়সাপেক্ষ। দরিদ্র ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠীর জন্য এটি আর্থিকভাবে অসম্ভব হয়ে উঠতে পারে।
গবেষকরা জানান, সালমোনেলার টাইপ (টাইফয়েড) বেশিরভাগ নমুনায় gyra 2, sul2, tem, int1 নামক অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী জিনগুলো শনাক্ত হয়। যা এই জীবাণুর ওষুধ প্রতিরোধের ক্ষমতাকে ব্যাখ্যা করে। কো-ট্রাইমক্সাজল এবং সিপ্রোফ্লক্সাসিনের মতো গুরুত্বপূর্ণ অ্যান্টিবায়োটিক এখনও কার্যকর হলেও বেশকিছু জীবাণু এই ওষুধগুলোর প্রতি প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তোলার প্রক্রিয়ায় রয়েছে। এছাড়া ভয়ংকর এ জীবাণু শরীরে প্রবেশ করলে ভবিষ্যতে কোনো ওষুধ কার্যকর হবে না। যা মানবদেহের জন্য হুমকিস্বরূপ।
গবেষণার তথ্যের বিষয়ে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ট্রপিক্যাল এন্ড ইনফেকশাস ডিজিজেস’র (বিআইটিআইডি) সহকারী অধ্যাপক (মাইক্রোবায়োলজি) ডা. মো. জাকির হোসেন বলেন, গবেষণায় যে তথ্যটি উঠে এসেছে, তা খুবই উদ্বেগজনক। এটি জনস্বাস্থ্যের জন্য খুবই হুমকি হয়ে উঠবে। বিশেষ করে শিশু ও দুর্বল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার মানুষেরা এই জীবাণু দ্বারা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। টাইফয়েড জ্বর শিশুদের মধ্যে মারাত্মক স্বাস্থ্য জটিলতা এমনকি মৃত্যুর কারণও হতে পারে। তাই এ বিষয়ে এখনই সচেতন হতে হবে। পাশাপাশি কার্যকরী ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। না হয় সামনে ভয়ংকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে।