রংপুর পাবলিক লাইব্রেরি: জ্ঞানের ঘরে অন্ধকার

  • ফরহাদুজ্জামান ফারুক, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, রংপুর
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

রংপুর পাবলিক লাইব্রেরি, ছবি: বার্তা২৪.কম

রংপুর পাবলিক লাইব্রেরি, ছবি: বার্তা২৪.কম

ঘড়ির কাঁটায় বিকেল ৪টা। রংপুর পাবলিক লাইব্রেরির দরজা খোলা। একটু এগুলে দেখা মিলল এক বৃদ্ধের। একা বসে আছেন। কাছে যেতেই তিনি বললেন, বসে পত্রিকা পড়েন।

বুঝলাম তিনি পাঠকের অপেক্ষায় ছিলেন। কিন্তু লাইব্রেরিতে শুধু পত্রিকা কেন, বই নেই? কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন, আছে। তবে যা আছে, তার কোনোটাই পড়ার মত নয়।

বিজ্ঞাপন

তার কথা শেষ না হতেই চোখে পড়ল কয়েকটি আলমিরার দিকে। কোনোটার গ্লাস ভাঙা, কোনোটা বই শূন্য। আবার কোনোটাতে বই আছে, কিন্তু বোঝার উপায় নেই। তবে কিছু আলমিরায় পত্রিকার স্তূপ দেখা গেল। এসব ধুলোবালু আর মাকড়সার জালে সংরক্ষিত। মেঝেতে বস্তাবন্দি হয়ে পড়ে আছে আরও কিছু পত্রিকা।লাইব্রেরির এমন করুণ দশার জন্য পাঠকের কাছে দুঃখ প্রকাশ করা ছাড়া আর কিছুই করার নেই বৃদ্ধ আজিজুল ইসলাম সানুর। এক যুগেরও বেশি সময় ধরে এ ভঙ্গুর লাইব্রেরিকে আগলে রেখেছেন তিনি। বিনিময়ে মাস শেষে তার বেতন মাত্র আড়াই হাজার টাকা।

আজিজুল ইসলাম সানু রংপুর পাবলিক লাইব্রেরির কেয়ারটেকার। ২০০৮ সাল থেকে ১৬৬ বছরের ঐতিহ্যবাহী এ লাইব্রেরির দেখাশুনা করছেন। সানুর টেবিলে পড়ে আছে একটা ভাঙা চশমা। সেটার অবস্থা আর লাইব্রেরির অবস্থা অনেকটা একই রকম। যেন লাইফ সাপোর্টে বেঁচে আছে।

বিজ্ঞাপন
রংপুর পাবলিক লাইব্রেরির ভেতরে অন্ধকার, ছবি: বার্তা২৪.কম

১৮৫৪ সালে প্রতিষ্ঠিত এ লাইব্রেরির ভেতর দেখে মনে হবে জ্ঞানের ঘরে আলোর অভাব। লাইব্রেরিয়ান নেই। বই নেই। পত্রিকা নেই। আলো নেই। ভালো পরিবেশ নেই। টয়লেট নেই। এসব দেখভালের অভিভাবক নেই। কমিটি নেই। সংস্কার নেই। কোনো কোনো আলমিরাতে তালা নেই। বহু পুরোনো একটা টেবিলে কয়েকটা পত্রিকা পড়ে আছে, তবে প্লাস্টিক চেয়ারে পাঠকের ভর নেই।

নেই শব্দে সমৃদ্ধ রংপুর পাবলিক লাইব্রেরিতে আধুনিকতার ছোঁয়াও নেই। এখানে কম্পিউটার, ইন্টারনেট বা অন্য কোনো তথ্য প্রযুক্তির উপকরণের ব্যবহার নেই। চার কক্ষের লাইব্রেরির একটা কক্ষ পাশে নির্মাণাধীন বিভাগীয় শিল্পকলা একাডেমির পেটে চলে গেছে। বাকি তিনটার একটা পরিত্যক্ত। আর দু’টি কক্ষ সংস্কারের অভাবে ঝড়-বৃষ্টিতে যেন কাঁদে।যার একটি হলরুম হিসেবে ভাড়া দিয়ে কিছু অর্থ মেলে। সেই অর্থে বেতন দেওয়া হয় সানু ও পরিচ্ছন্নতা কর্মীকে। জেলা প্রশাসনের দায়িত্বে থাকা এ লাইব্রেরির জন্য আর কোনো বরাদ্দ নেই।

ব্রিটিশ শাসনামলে নির্মিত এ লাইব্রেরিতে এখন ফাটল ধরেছে। দেয়ালে জমেছে শেওলা। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে লাইব্রেরির কার্যক্রম। এখনকার ২০টি আলমিরার আটটি নষ্ট হয়ে গেছে। নতুনত্ব না থাকায় আলমিরার স্তূপের পুরাতন বই-পত্রিকা পাঠককে কাছে টানে না। অথচ একটা অন্ধকার ঘরে মাকড়সার জালে আলমিরাতে আটকে আছে বহু মানিদামি লেখকের বই। তাও নেহাত কম নয়, সংখ্যার হিসেবে অন্তত দেড় হাজার হবে।

রংপুর পাবলিক লাইব্রেরিতে পুরনো পত্রিকার স্তূপ, ছবি: বার্তা২৪.কম

লাইব্রেরিতে বসে বসে এসব জানলাম সানুর কাছ থেকে। এরই মধ্যে ঘড়ির কাঁটা সাড়ে ৫টা ছুঁই ছুঁই। এ দেড় ঘণ্টায় দু’জন পাঠককে দেখ গেল। তারা এসেছেন পত্রিকায় পাতায় চোখ বুলাতে। কিছুক্ষণ পর চলেও গেলেন। সানু জানালেন, প্রতিদিন বিকেল ৪টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত লাইব্রেরি খোলা থাকে। এ চার ঘণ্টায় ১০/১৫ জন আসেন। তবে তারা পাঠক নন, আড্ডাবাজ।

গল্পে গল্পে যখন সাংবাদিক পরিচয় নিশ্চিত হন আজিজুল ইসলাম সানু, তখন তিনি বললেন, এক সময় এখানে অনেক বই ও পত্রিকার পাঠক ছিল। কিন্তু এখন পাঠক কমে গেছে। জনবল নেই। পড়ার উপযোগী কোনো বই নেই। কিছু পুরাতন বই আছে, তাও উইপোকা, তেলাপোকা কাটা, ধুলাবালু, বৃষ্টির পানি পড়ে পড়ে নষ্ট হয়ে গেছে। এভাবেই নামে মাত্র টিকে আছে রংপুর পাবলিক লাইব্রেরি।