পর্ব-৪
নেই শব্দে সমৃদ্ধ রংপুর পাবলিক লাইব্রেরি
‘হামার লাইব্রেরি এতিম হয়া গেইছে। কাও এ্যর খোঁজখবর নেয় না। ঝড় বৃষ্টিত পানি পড়ি পড়ি লাইব্রেরির জিনিসপত্র নষ্ট হইছে। মেলা দিনের পুরাতন বইগুল্যাত পোকা ধরছে। আগের মতো পত্রিকা নাই। মাইনষেও তেমন বই পড়ার জনতে আইসে না। হামার লাইব্রেরি এ্যলা বাপ-মাও মরা ছাওয়ার মতো এতিম।’
অনেক আক্ষেপ থেকে কথাগুলো বলছিলেন মদন কুমার রায়। পেশায় একজন পরিচ্ছন্নতা কর্মী। রংপুর পাবলিক লাইব্রেরিতে কাজ করেন তিনি।
প্রতিদিনের মতো গত শুক্রবারও ঝাড়ু দিচ্ছিলেন মদন কুমার। তখন ঘড়ির কাটায় সকাল ১০টা। আগ বাড়িয়ে জানতে চাই ‘কেমন চলছে’ লাইব্রেরির কাজ? একটু হেসে বললেন, ‘বিক্যাল বেলা আইসেন। চাইরট্যার সময় লাইব্রেরি খুলবে। তখন ভেতরোত ঢুকি দ্যাইকেন ক্যামন চলছে। অবস্থা খুবই খারাপ। কোনো আয় উন্নতি নাই।
মদন কুমারের এমন কথায় রংপুর পাবলিক লাইব্রেরির অবস্থা যে ভালো নেই তা বুঝতে বাকি রইল না। লাইব্রেরির সামনে ঝাড়ু দেয়া শেষে ডেকে আনলেন কেয়ারটেকারকে। তিনি বয়সে বৃদ্ধ। ১২ বছর ধরে রংপুর পাবলিক লাইব্রেরিকে আগলে ধরে আছেন।
আজিজুল ইসলাম সানু নামে এই বৃদ্ধ কেয়ারটেকারসহ লাইব্রেরির ভেতরে বসে কথায় কথায় জানা গেল, দেড়শ বছরেরও বেশি পুরাতন এ পাবলিক লাইব্রেরির বেহাল দশার বিবরণ। ওই সময় একজন হকার এসে কিছু পত্রিকা রেখে গেলেন টেবিলে।
পত্রিকাগুলো হাতে নিয়ে আজিজুল বললেন, ‘এই ৪টি পত্রিকা দিয়ে লাইব্রেরি চলছে। এখানে আগের মতো বেশি করে পত্রিকা রাখা হয় না। টাকা নেই। অর্থ সংকট চেপে বসেছে। বই নেই। আলমারিগুলো ফাঁকা হয়ে আছে। বহু পুরাতন বইগুলো নষ্ট হয়ে গেছে।’
চেয়ার থেকে উঠে হেঁটে হেঁটে লাইব্রেরির পুরো কক্ষ দেখা শেষ। চোখে পড়ল লাইব্রেরির গায়ের ফাটল। দেয়ালে জমেছে শেওলা। ২০টি আলমারির ৮টি নষ্ট হয়ে গেছে। একটা অন্ধকার কক্ষে আলমারিতে মাকড়সার জালে আটকে আছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, মাইকেল মধুসূদন, জসিম উদ্দিন, আব্দুল্লাহ আল মামুন, সৈয়দ শামসুল হকসহ বহু লেখকের বই। গল্প, উপন্যাস, ইতিহাস, জীবনী, কাব্য, সাহিত্য নির্ভর বই মিলে মোট দেড় হাজার হবে। এসব বইয়ের কভার নষ্ট। কালার নষ্ট। পোকা খেয়েছে, ধুলাবালি পড়েছে। বেশ কিছু আলমারি পত্রিকা দিয়ে ভরা।
আজিজুল জানালেন, লাইব্রেরিতে নতুন বই নেই। আর পুরনো যে বইগুলো আছে তা পড়ার মতো অবস্থা নেই। এখন পাঠকের ভরসা ৪টি পত্রিকা। জনবল না থাকায় বই পড়ার ব্যবস্থা করা সম্ভব হয়ে উঠছে না।
জরাজীর্ণ অবস্থায় পড়ে এ লাইব্রেরিতে অনেক কিছুই নেই। ১৮৫৪ সালে প্রতিষ্ঠিত রংপুর পাবলিক লাইব্রেরির ভেতর দেখে মনে হবে জ্ঞানের ঘরে আলোর অভাব। লাইব্রেরিয়ান নেই। বই নেই। পত্রিকা নেই। আলো নেই। ভালো পরিবেশ নেই। বাথরুম নেই। এসব দেখভালের অভিভাবক নেই। কমিটি নেই। সংস্কার নেই।
নেই শব্দে সমৃদ্ধ এই লাইব্রেরিতে আধুনিকতা বা ডিজিটালের ছোঁয়াও নেই। এখানে কম্পিউটার, ইন্টারনেটসহ তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার কী তা জানেন না কেয়ারটেকার আজিজুল। তার দাবি, এখানে অনেক কিছু করা সম্ভব। কিন্তু কে করবে, কে উদ্যোগ নেবে? পাঁচ বছর আগে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে লাইব্রেরির সংস্কারের জন্য আবেদন করেছেন জেলা প্রশাসক। এখন পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা হয়নি। পত্রিকার হকারও পাওনাদার। এভাবে আর কতদিন চলবে?
আরও পড়ুন: ‘লাইফ সাপোর্টে’ ১৬৫ বছরের লাইব্রেরি