প্রায় ৪ মাস আগের পতিত স্বৈরাচার সরকারের প্রধান ও বিভিন্ন নেতাদের ভারতে অবস্থান ও দেশটির বিভিন্ন ষড়যন্ত্রমূলক অপপ্রচারের বিরুদ্ধে ঐক্যমত গড়ে তোলায় একাট্টা হয়েছে বাংলাদেশের ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় থাকা সকল রাজনৈতিক দল।
বৈঠকে সরকারের পক্ষ থেকে বাংলাদেশকে নিয়ে ভারতসহ সারা বিশ্বে চলা প্রোপাগান্ডা, আগরতলায় সহকারী হাইকমিশন অফিস ভাঙচুর ও পতাকা অবমাননা এবং বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন নিয়ে যে মিথ্যা অপপ্রচার চলছে এই তিনটি বিষয়কে সামনে রেখে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে মতামত চাওয়া হলে তারা এই মতামত ব্যক্ত করেন।
বুধবার (৪ ডিসেম্বর) রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে বিকাল সাড়ে ৪টায় শুরু হয় এই বৈঠক। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে প্রায় দুই ঘণ্টাব্যাপী চলা এই বৈঠক শেষ হয় সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায়। বৈঠকে সরকারে পক্ষে তিনটি বিষয়ে মতামত চাওয়া হলেও নির্বাচন সহ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নানা বিষয় নিয়ে বক্তব্য তুলে ধরেন দলগুলোর শীর্ষ নেতারা। পরে সে সব বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ারও আশ্বাস দেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
সম্প্রতি ঘটতে থাকা দেশি-বিদেশি বিভিন্ন অপপ্রচার ও ষড়যন্ত্র মোকাবিলায় গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যায় যমুনায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন প্রধান উপদেষ্টা। আগামীকালও একই বিষয়ে ধর্মীয় সম্প্রদায়ের নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে বসার কথা রয়েছে।
বাংলাদেশ নিয়ে সম্প্রতি ভারতের বিভিন্ন প্রোপাগান্ডার ইঙ্গিত করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আমরা যে মুক্ত স্বাধীন বাংলাদেশ তৈরি করলাম, তারা এটাকে মুছে দিয়ে আগেরটায় ফিরে যেতে চায়। মুখে বলছে না যে আগেরটা, কিন্তু ভঙ্গী হলো আগেরটা ভালো ছিল। তাদের শক্তি এতো বেশি যে তারা মানুষকে এর ভেতরে ভেড়াতে পারছে। তাদের কল্পকাহিনীর কারণে মানুষ সন্দেহ প্রকাশ করছে যে এটা কী ধরনের সরকার হলো।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, এখন আমাদের সাড়া দুনিয়াকে বলতে হবে যে, আমরা এক, আমরা যেটা পেয়েছি সেটা একজোট হয়ে পেয়েছি, কোনো মতবাদের কারণে পাইনি, ধাক্কাধাক্কি করে পাইনি, যারা আমাদের ওপর চেপে ছিল, তাদের উপড়ে ফেলেছি। এটাই সবার সামনে তুলে ধরতে হবে, সবাই মিলে যেন এটা করতে পারি। আমাদের নতুন বাংলাদেশের যাত্রাপথে এটা মস্ত বড় একটা বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে, অস্তিত্বের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বৈঠক শেষে বের হয়ে ডান, বাম সহ ইসলামী দলগুলোও সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে এই পরিস্থিতি মোকাবিলার কথা জানিয়েছেন। বৈঠকে অংশ নিয়েছিলো বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক কমিটি, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির, গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টির, জাতীয় পার্টির (জাফর), বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ), নাগরিক ঐক্যে, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, গণসংহতি আন্দোলন, গণ অধিকার পরিষদ, এবি পার্টি, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, জমিয়তে ওলামায়ে ইসলাম, এনপিপি সহ আরও বেশ কিছু রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি দল।
বৈঠক শেষে বের হয়ে আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল গণমাধ্যমকে বলেন, সবাই একটা কথা বলেছেন, আমাদের আর শক্তিহীন, দুর্বল, নতজানু ভাবার কোনো অবকাশ নেই। যেকোনো ধরনের অপপ্রচার এবং উসকানির বিরুদ্ধে আমরা ঐক্যবদ্ধ থাকব এবং আমাদের ঐক্য অটুট রাখব। আমরা সাহসী থাকব, ভবিষ্যতে যেকোনো অপপ্রচার বা উসকানি দিলে আমরা আমাদের ঐক্যকে আরো বেগবান রাখার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখব।
সরকারের সঙ্গে ঐক্যমতে আসার কথা জানিয়েছে দেশের অন্যতম বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বিএনপিও। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, আমরা অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে ঐকমত্য প্রকাশ করেছি। যেভাবে আগস্ট মাসে গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে সরকারকে বিদায় করা হয়েছে এবং এখন তাদেরকে যারা সহযোগিতা করছে তাদের সবাইকে আমরা মোকাবিলা করব। প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, জাতীয় ঐক্য সৃষ্টি করার জন্য তিনি যথাযথ পদক্ষেপ নেবেন। আজকে আমরা যারা রাজনৈতিক দলগুলো এখানে ছিলাম তারা সবাই জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার জন্য একমত হয়েছি।
গণতান্ত্রিক বাম জোটের পক্ষে ওয়ার্কাস পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, স্বৈরাচারের পলায়নকে ভারত সরকার তাদের নিজের পরাজয় হিসেবে বিবেচনা করে আসছে। তাই এই দেশের বিরুদ্ধে ভয়ানকভাবে তৎপর। হিন্দু মুসলমান দাঙ্গা তৈরি করার চেষ্টা করছে। সরকারে কাছে স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে আমাদের ঐক্যমত ব্যক্ত করেছি। আমরা সমতা, ন্যায্যতা ও সমঅধিকারের ভিত্তিতে ভারতের সঙ্গে সকল অমিমাংসিত বিষয়গুলো ন্যায্যভাবে সমাধান করতে চাই।
দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব একমত প্রকাশ করেছে ইসলামী দলগুলো। বৈঠক শেষে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেন, একটি জায়গায় সবাই একমত হয়েছি, আমাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের ব্যাপারে কোনো ছাড় নয়। এখানে আমরা একমত থাকব। যেমন অতীতে ছিলাম। ৫ আগস্টেও যেমন ছিলাম।
উল্লেখ্য, গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে স্বৈরাচার সরকার আওয়ামী লীগের পতন হলে দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা সহ দলটির অনেক নেতা ভারতে পালিয়ে চলে যান। এরপর থেকে ভারতীয় বিভিন্ন মিডিয়া বাংলাদেশ নিয়ে নানা মিথ্যা ও অপতথ্য ছড়াতে থাকতে। কোন রকম যাচাই-বাছাই ছাড়াই পুরনো ফটো ও ভিডিও দিয়ে হিন্দুদের উপর আক্রমণ হচ্ছে এমন সংবাদ প্রকাশ করে আসছে। একই সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে বার বার দেশে এসে তথ্য সংগ্রহের আহ্বান জানানো হলেও তাতে সাড়া দেয়নি তারা।
এরই ধারাবাহিকতায় ইস্কনের বহিষ্কৃত নেতা চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে পতাকা অপমানের রাষ্ট্রদোহ মামলায় গ্রেফতারকে কেন্দ্র করে ভারতের সরকার ও বিভিন্ন মিডিয়া একজোট হয়ে নানা গুজব ছড়ায়। একই সঙ্গে দেশটিতে সনাতনী ধর্মের অনেক সংগঠনও বাংলাদেশের বিরুদ্ধে বিভিন্ন আন্দোলন করে।
এর জেরে গত সোমবার দুপুরে আগরতলায় বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশনে হামলা হয়। সেখানে হামলা, ভাঙচুর, ফ্ল্যাগস্ট্যান্ড ভেঙে বাংলাদেশের মর্যাদার প্রতীক জাতীয় পতাকা খুলে নিয়ে পোড়িয়ে দেয়া হয়।