স্ট্যাটাসেই বদলে গেল ওদের স্ট্যাটাস

  • জাহিদুর রহমান, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪. কম,ঢাকা।
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

দিনমজুরদের মধ্যে খাবার বিতরণ করছেন সাভারের সহকারী কমিশনার (ভূমি) আব্দুল্লাহ আল মাহফুজ/ছবি: বার্তা২৪.কম

দিনমজুরদের মধ্যে খাবার বিতরণ করছেন সাভারের সহকারী কমিশনার (ভূমি) আব্দুল্লাহ আল মাহফুজ/ছবি: বার্তা২৪.কম

দেশে নভেল করোনাভাইরাসের মহামারি ঠেকাতে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা এবং হোম কোয়ারেন্টিনের বিষয়টি নিশ্চিত করতে আজ থেকে কঠোর অবস্থানে সেনাবাহিনী।

তা সত্ত্বেও ঘর থেকে কোদাল আর টুকরি নিয়ে সাভারে ভাড়া বাসা থেকে বের হয়েছিল কেরামত, মোহাব্বত, ছমিরন, নাসিমার মতো অসংখ্য মানুষ। খেটে খাওয়া এইসব মানুষ জড়ো হয়েছিল সাভার বাজার বাসস্ট্যান্ডে। নিজেদের ভাষায় ‘মার্কেট’ বলে পরিচিত মানুষের হাটে।

বিজ্ঞাপন

তবে পারিপার্শ্বিক অবস্থায় সবার মধ্যেই ছিল অনিশ্চয়তা। প্রায় সপ্তাহ দুয়েক ধরেই কাজের বাজার এখন টালমাটাল। এখানে আসার আগেও শ্রমিকেরা কেউ জানেন না কাজ মিলবে কি না। এরা সবাই দিনমজুর। দিনে এনে দিনে খায়।

ইট ভাঙা, নির্মাণকাজ, রাজমিস্ত্রি, রাজমিস্ত্রির সহকারী, কাঠমিস্ত্রি, বস্তা টানা, মাটি কাটা, ড্রেন পরিষ্কার থেকে শুরু করে এমন কোনো কাজ নেই, যা তাঁরা করেন না।

বিজ্ঞাপন

শ্রমজীবী অসহায় এসব মানুষদের বুধবারের দিনটিই শুরু হলো অন্যভাবে। ভোর থেকে জমায়েত হয়ে-ও যেখানে কাজ পাচ্ছিলেন না,আচমকা সেখানে খাবার সামগ্রী নিয়ে হাজির হলেন প্রশাসনের এক কর্তা।

সাংবাদিক জাহিদুর রহমানের স্ট্যাটাস দেখে খাদ্য সামগ্রী বিতরণ করেন সহকারি কমিশনার

আর সেই খাবার নিয়ে কাজের সন্ধানে আসা অসহায় মানুষগুলো খুশিমনে বাড়ি ফিরেছে পরিবার নিয়ে  ক‘টাদিন চলার মতো অবলম্বন নিয়ে।

আর এভাবেই সাভারে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুকে এক গণমাধ্যম কর্মীর একটি স্ট্যাটাসে বদলে দেয় অসংখ্য শ্রমজীবী মানুষের দৈনন্দিন জীবনের একটি দিন। এই মানুষগুলোর প্রতি সহানুভূতি ও সহমর্মিতার হাত বাড়িয়ে দেয় প্রশাসন।

গণমাধ্যমকর্মীর স্ট্যাটাস দেখে নিজেই উদ্যোগী হয়ে তাদের কাছে ছুটে যান সাভারের সহকারী কমিশনার (ভূমি) আব্দুল্লাহ আল মাহফুজ।

তিনি জানান, করোনাভাইরাসের ব্যাপক বিস্তার ঠেকাতে গত ২৬ মার্চ থেকে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে সরকার। এই সময়ে জরুরি প্রয়োজন ছাড়া কাউকে বাইরে না বের হওয়ার নির্দেশনার পাশাপাশি বিদেশ ফেরত সবাইকে বলা হয়েছে কোয়ারেন্টিনে থাকতে।

সরকারের এই নির্দেশনা বাস্তবায়নে বেসামরিক প্রশাসনের প্রতিনিধি হিসেবে সশস্ত্র বাহিনীর সঙ্গে আমরা মাঠ পর্যায়ে কাজ করছি। উপজেলা প্রশাসনের তরফে ইউনিয়ন পর্যায়ে সামগ্রী পৌঁছে দেওয়ার পাশাপাশি আমরা নিজেরাও অসহায় দুস্থ শ্রমজীবী মানুষদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে পৌঁছে দিচ্ছি খাবার।

লাইন ধরে ত্রাণ নিচ্ছেন খেটে খাওয়া নিম্ন আয়ের মানুষগুলো

গত ১ এপ্রিল বার্তা২৪.কমের স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট জাহিদুর রহমানের দেয়া একটি স্ট্যাটাস নজর কাড়ে আমার।

অসহায় শ্রমজীবী মানুষদের দুটি ছবি পোস্ট করে তিনি লিখেছিলেন, "সামাজিক দূরত্ব কি- এটা ওরা জানে না। সরকারি বিধি নিষেধ মানার মতোও খুব একটা গরজ নেই ওদের। কেবল জানে, কাজ না করলে পেট চলবে না। আর এটাও শুনেছে, নতুন করোনাভাইরাস নামের অদৃশ্য এক দৈত্য লন্ডভন্ড করে দিচ্ছে স্বাভাবিক জীবনের সবকিছু। প্রাতঃভ্রমণে পথ চলতে দেখা অসহায় মানুষগুলোর সঙ্গে কথা হলো। না। তারা কারও কোনো সাহায্য সহযোগিতা পায়নি।

অথচ  করোনায় ছুটি ঘোষণার কারণে দিনমজুর ও খেটে খাওয়া এই মানুষগুলোর সমস্যাটাই জটিল। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি সবাইকে তাদের পাশে দাঁড়াতেই নির্দেশ দিয়েছেন,মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বলেছেন,কেউ যেন বাদ না পড়ে। এই দুঃসময়ে কেউ সুযোগ নিলে, কোনো অভিযোগ পেলে আমি ছাড়ব না। বিন্দু পরিমাণ অনিয়ম সহ্য করা হবে না।

দিনের আলো ফোটার সঙ্গে দেখবেন "মানুষের হাটে" জড়ো হয়েছেন এমন অসংখ্য শ্রমজীবী।

এরা কাজের সন্ধানে আসা উত্তর জনপদের মানুষ। যাদেরকে এই সমাজ ব্যঙ্গ করে ডাকে "মফিজ"।

নিজ এলাকায় ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে তালিকা করলে বাস্তবে এদের দেখা পাবেন না। আবার কাজের সন্ধানে ঢাকা ও আশপাশের অঞ্চলের বিভিন্ন ওয়ার্ডের ভোটার তালিকায় এদের নাম নেই। তাহলে এরা সাহায্য পাবে কি করে?

তাই শ্রমজীবী এই মানুষগুলো কাজের সন্ধানে যেখানে এসেছেন সেখানেই আমাদের তৎপরতা বাড়াতে হবে।

কাজ নেই, তাই দিনে এনে দিনে খাওয়া এই মানুষদের হাতে সঞ্চিত অর্থ-ও নেই।

সামর্থের মধ্যে আপনার-আমার মহানুভবতা ও সহমর্মিতার হাত বাড়িয়ে দেই। এই সংকটের পেট চালানোর মত কিছু সাহায্য পেলেই এ মানুষদের মুখে হাসি ফুটবে।"

গণমাধ্যমকর্মীর এই স্ট্যাটাসটা আমাদের নজরে আসা মাত্রই সিদ্ধান্ত নেই এই মানুষদের পাশে আমাদের দাঁড়ানো প্রয়োজন।

খেটে খাওয়া এসব মেহনতি মানুষের জন্য আমরা মাথাপিছু ১০ কেজি চাল ৩ কেজি আলু, ১ কেজি পেঁয়াজ, ১ লিটার সয়াবিন তেল,১ কেজি মসুর ডাল ও একটা সাবান,  বড় একটি প্যাকেটে করে তাদের হাতে তুলে দিয়েছি। আমাদের উদ্দেশ্য, একটি মানুষ-ও যেন না খেয়ে থাকে।

দেশে নভেল করোনাভাইরাসের মহামারি ঠেকাতে  সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা এবং হোম কোয়ারেন্টিনের বিষয়টি নিশ্চিত করতে বেসামরিক প্রশাসনকে সহায়তায় মাঠে রয়েছে সেনাবাহিনী।

আমরা চাই সবাই ঘরে থাকুক। প্রয়োজনে আমরা ঘরে ঘরে খাবার পৌঁছে দেব। এই রোগটির যাতে আর বিস্তৃতি না ঘটে সেজন্য আমাদের সকলকে একযোগে কাজ করতে হবে।

অপ্রত্যাশিত ত্রাণ পেয়ে খুশি ইটভাটার শ্রমিক মমিন মিয়া। তিনি জানান, তিনদিন ধরে কাজের সন্ধানে এসেও কোন কাজ পাই নাই। ঘরে চাল নাই।

অভিন্ন কথাই বলছিলেন রাজমিস্ত্রির যোগালি দেওয়া শ্রমিক আব্দুল হাই (৩২)। তিনি জানান, গত পাঁচ দিন ধরে কোন কাজ পান নি। অবরুদ্ধ প্রতিদিন খরচ হয়ে গেছে ৬০ টাকা। কোন সাহায্য সহযোগিতা না পাওয়ায় ধারদেনা করে চলছিলেন তিনি।

প্রশাসনের তরফে পাওয়া খাদ্য সামগ্রী হাতে নিয়ে বাড়ি ফেরার পথে তিনি বলছিলেন, হঠাৎ দেখি প্রশাসনের লোক আইছে। প্রথমে ডরাই ছিলাম। ভাবছিলাম ঘরে না থাইকা কাজের সন্ধানে আসাতে আমাগো বুঝি ধইরে নিবো। কিন্তু দেখলাম, আমাগো লাইনে দাঁড় করাইয়া প্রত্যেকের হাতেই চাল, ডাল, তেল, পিঁয়াজ,আলু আর সাবান দিছে।

সরকার যদি আমাগো দিকে একটু তাকায় তাইলে আমাগো আর কষ্ট থাকবো না- যোগ করেন আব্দুল হাই।