স্টেশনে উপচেপড়া ভিড়, ট্রেনযাত্রী নয় ত্রাণের কাঙাল ওরা!

  • স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, রাজশাহী
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

রাজশাহী স্টেশনে ত্রাণ সহায়তা নিতে মানুষের ভিড়/ছবি: বার্তা২৪.কম

রাজশাহী স্টেশনে ত্রাণ সহায়তা নিতে মানুষের ভিড়/ছবি: বার্তা২৪.কম

শুক্রবার (৩ এপ্রিল) সকাল থেকেই রাজশাহী স্টেশনে ভিড়। বেলা সাড়ে ১০টা বাজতেই লোকারণ্য পুরো স্টেশন এলাকা। দেখলেই মনে হবে- যেন দুই সপ্তাহ ধরে বন্ধ থাকা ট্রেন সচল হওয়ায় যাত্রীদের ভিড়!

কিন্তু না! খোঁজ নিয়ে জানা গেল- বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাক-এর অর্থ সহায়তা পেতে স্টেশনে হতদরিদ্র মানুষের এমন জমায়েত! তবে শেষ পর্যন্ত তাদের ভাগ্যে জোটেনি সহায়তা। মানুষের ভিড় ও নিরাপদ দূরত্ব নিশ্চিত না হওয়ায় অর্থ সহায়তা বিতরণ বন্ধ ঘোষণা করে ব্র্যাক। ফলে খালি হাতে নিরাশ হয়ে ফিরে গেছেন সহস্রাধিক মানুষ।

বিজ্ঞাপন

অথচ রাজশাহী নগরীসহ উপজেলা পর্যায়েও শুক্রবার (৩ এপ্রিল) জনসমাগম রুখতে চলছে সেনাবাহিনী, পুলিশ ও র‌্যাবের কড়া টহল। কিন্তু স্টেশনে হাজারেরও বেশি মানুষের সমাগম হলেও তা জানেই না জেলা প্রশাসন।

খবর পেয়ে পুলিশ সদস্যরা সেখানে ছুটে গেলেও ততক্ষণে ধাক্কাধাক্কি আর ঠেলাঠেলি করে লাইনে সামনে আসতে মরিয়া খেটে খাওয়া মানুষেরা। প্রাণঘাতী করোনা আতঙ্ক, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার প্রশাসনিক নির্দেশনা বা জারি করা আইনের কোনো তোয়াক্কা করছিলেন না তারা। হয়তো সেই ভাবনা বা বিবেকতাড়িত হওয়ার ফুসরত নেই তাদের!

বিজ্ঞাপন
অভাবের তাড়নায় বিবেকতাড়িত হওয়ার ফুসরত নেই অসহায় এসব মানুষের

তেমনটা বলছিলেন নগরীর জামালপুর বস্তি থেকে আসা ৬৭ বছর বয়সী রাবেয়া বেওয়া। মানুষের ভিড়ে হাঁফিয়ে ওঠা বৃদ্ধা বসে পড়েছিলেন স্টেশনে। তবে পুলিশ সেখান থেকে সরিয়ে দিয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘বাবা, ওরা পয়সা দিল না। শুনছিলাম ১৫০০ টাকা করে দিবে। কত কষ্ট করে লাঠি ভর দিয়ে হেঁটে হেঁটে এসেছি। এখন গাড়ি ভাড়াও নেই। আবার হেঁটে যেতে হবে..!’

বৃদ্ধা রাবেয়া বলেন, ‘পোলাডার কাম-কাজ নেই, বাড়িতে টাকা-পয়সাও নেই। মেয়র পাঁচ কেজি চাল দিছে। ছয় জনের সংসার। তা দিয়ে দু’দিনের বেশি যাবে না। তারপর খাওন দেবে ক্যাডা?’

পবা উপজেলা থেকে সকালে স্বামী পরিত্যক্তা মেয়েকে নিয়ে বাইসাইকেল চালিয়ে এসেছেন রফিকুল ইসলাম। মেয়ে ও স্ত্রীকে ব্র্যাকের সদস্য করে লোন নিয়ে ক্ষুদ্র ব্যবসা করেন তিনি। সপ্তাহের কিস্তি মওকুফ হলেও ব্যবসা নেই রফিকুলের। ব্র্যাকের অন্য সদস্যদের মাধ্যমে জেনেছেন রাজশাহী স্টেশনে জনপ্রতি ১৫০০ টাকা দিবে। সেই টাকা নিতে পুরোনো ভাঙা সাইকেলে চড়ে এসেছেন বাবা-মেয়ে।

কিন্তু মানুষের ভিড় বেশি হওয়ায় সহায়তা বিতরণ বন্ধ ঘোষণা করা হয়। পুলিশের মারমুখী অ্যাকশনে বাধ্য হয়ে বেরিয়ে এসে শিরোইল বাসস্ট্যান্ডের রাস্তায় বাবা-মেয়ে। মেয়ে মুখে কাপড় দিয়ে স্টেশনে দিকে তাকিয়ে মেয়ে। আর সাইকেল রেখে বাবা বসে পড়েছেন সড়কের পাশে। তিনি বলেন, ‘খুব আশা নিয়ে এসেছিলাম। খালি হাতে বাড়িতে যাবো কীভাবে? ছোট মেয়ে, নাতনি আছে। ওদের জন্য এক প্যাকেট বিস্কুট কিনে নিয়ে যাওয়ার টাকাও নেই।’

মানুষের ভিড় বেশি হওয়ায় সহায়তা বিতরণ বন্ধ ঘোষণা করে পুলিশ

নগরীর হড়গ্রাম থেকে আসা সুফিয়া পারভীন বলেন, ‘ব্র্যাক সমিতি করি। লোন নিয়েছি, কিস্তি পরিশোধ করি। গতকাল রাতে শুনলাম ব্র্যাকের টাকা দেবে। তাই আমাদের পাড়া থেকে যারা সদস্য সবাই এসেছি। কিন্তু টাকা দিল না। মানুষের ভিড় বেশি হওয়ায় পুলিশ তাড়িয়ে দিয়েছে।’

এ বিষয়ে জানতে ব্র্যাকের রাজশাহী ব্রাঞ্চের ব্যবস্থাপকসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাথে মোবাইলে কয়েক দফা যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও কেউ-ই কল রিসিভ করেন নি। অধিকাংশ কর্মকর্তার মোবাইল বন্ধ পাওয়া গেছে।

তবে ঘটনাস্থলে থাকা ব্র্যাকের কর্মী রেজাউল ইসলাম বলেন, ‘ত্রাণ সহায়তা হিসেবে জনপ্রতি ১৫০০ টাকা করে দেয়ার কথা ছিল। এজন্য স্টেশনকে ভেন্যু হিসেবে বেছে নেওয়া হয়। যাতে মানুষকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে লাইনে দাঁড় করানো যায়। কিন্তু আমাদের ধারণার চেয়ে কয়েকগুণ মানুষ স্টেশনে চলে আসে। কোনোভাবে তাদের নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছিল না। ফলে প্রশাসন থেকে কার্যক্রম বন্ধ রাখার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।’

রাজশাহী জেলা প্রশাসক হামিদুল হক বার্তা২৪.কম-কে বলেন, ‘ব্র্যাক আমাদেরকে ভালোভাবে বিষয়টি অবগত করেনি। তারা এটা ভুল করেছে। এভাবে সহায়তা দিতে গেলে মারাত্মক ক্ষতি হবে। আমরা ব্র্যাক কর্তৃপক্ষের কাছে এ ধরনের কাজের কারণ দর্শাতে বলেছি। যৌক্তিক জবাব না দিতে পারলে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’