কিসের সামাজিক দূরত্ব! কিসের কী! চিরচেনা ছন্দেই ফিরেছে সাভার!
সকাল না হতেই আফরোজা বেগম খাবারের বাটি নিয়ে বেরিয়েছিলেন কর্মস্থলের উদ্দেশে। টেলিভিশনে দেখেছেন, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার নির্দেশনা। ছুটির সময়টায় বাসাতেও সাধ্যমতো চেষ্টা করেছেন বারবার হাত ধুয়ে নিজেকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে। যথাসম্ভব সামাজিক দূরত্বও বজায় রাখতে চেষ্টা করেছেন প্রতিবেশীদের সঙ্গে।
তবে রোববার (৫ এপ্রিল) সকালে কর্মস্থলের উদ্দেশে বের হতেই খটকা লাগে আফরোজার। গা বাঁচিয়ে চলার চেষ্টা করেও শেষ রক্ষা হয়নি তার। গিজগিজে মানুষের ভিড়ে গায়ে গায়ে ধাক্কা লেগেছে অনেকের সাথে। বাসেও গাদাগাদি করে পুরনো অভ্যাসে দাঁড়িয়ে যেতে হয়েছে কর্মস্থলে।
কেবল আফরোজা বেগম একা নন, তার মতো অনেককেই এ দৃশ্য দেখতে হয়েছে সাভারে। রোববার সকালে শহরের চেহারাটাই ছিল চিরচেনা। মনে হয়েছে কার্যত অঘোষিত লকডাউন ছেড়ে মুক্ত হয়েছে সাভার। পুরনো ছন্দে চলছিল যানবাহন। সড়কে গিজগিজে ভিড় ছিল তৈরি পোশাক শ্রমিকদের।
যে কারণে নোভেল করানোভাইরাসের সংক্রমণ এড়াতে কঠোর প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণের মধ্যেই সাভার ও আশুলিয়ায় ভেঙে পড়েছে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার ব্যবস্থাপনা।
রোববার পূর্ব ঘোষণা দিয়ে তৈরি পোশাক শিল্প মালিকরা তাদের কারখানা খুলে দেয়ায় এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে বলে জানিয়েছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক প্রশাসনের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা।
পোশাক শিল্প মালিকদের দুই সংগঠন বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ ১১ এপ্রিল পর্যন্ত অধিকাংশ কারখানা বন্ধের সিদ্ধান্ত দিলেও সাভারে কীভাবে পোশাক কারখানা চালু হলো, সে ব্যাপারেও কোনো হিসেব মেলাতে পারছেন না সংশ্লিষ্টরা।
এভাবে হাজার হাজার শ্রমিক একযোগে ঘর থেকে বেরিয়ে আসায় মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হয়েছে বলে জানিয়েছেন ডক্টর আনোয়ারুল কাদির নাজিম নামের একজন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ।
তার মতে এমন পরিস্থিতি “বজ্র আঁটুনি ফস্কা গেরোর” মতো এতদিন কোনো মতে বজায় রাখা প্রচেষ্টাকে বিনষ্ট করে দিয়েছে।
যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও কার নির্দেশে তৈরি পোশাক কারখানাগুলো আবার খুলে দেয়া হলো সে বিষয়ে সুস্পষ্ট কোনো তথ্য দিতে রাজি হননি শিল্প মালিকরা।
সকাল থেকেই বিভিন্ন পাড়া-মহল্লার অলিগলিতে হাজার হাজার মানুষের বিচরণ দেখা যায়।
এদের অধিকাংশ ছিলেন তৈরি পোশাক কারখানার শ্রমিক।
হাজার হাজার শ্রমিকের পদচারণার কারণে স্বাভাবিক ছন্দে ফিরতে দেখা যায় সাভার ও আশুলিয়ার নগর জীবনে।
ব্যস্ততম ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক দেখা গেছে অসংখ্য যানবাহন।
এসব যানবাহনে গাদাগাদি করে শ্রমিকরা কারখানা অভিমুখে রওনা হওয়ায় জনস্বাস্থ্য নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে ঘরে থাকা মানুষদের মাঝে। কেউবা গাড়ি না পেয়ে পায়ে হেঁটেই কর্মস্থলের পথ ধরেছেন। সেখানেও দেখা গেছে গিজগিজে মানুষের ভিড়।
করোনাভাইরাস সংকটের মধ্যে বিভিন্ন পোশাক কারখানা চালুর সিদ্ধান্ত নেয়ায় শ্রমিকদের বাড়ি থেকে বের করার ফলে রোগ ছড়ানোর ঝুঁকি তৈরি হয়েছে
এবং মানুষকে ঘরে থাকার সরকারি আহ্বান কার্যত অচল হয়ে পড়েছে বলে জানিয়েছেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা।
যে কারণে সকাল থেকেই সাভার এবং আশুলিয়ায় আইন অমান্য করার ব্যাপারে প্রশাসনের কোনো তৎপরতা চোখে পড়েনি।
সরকার ঘোষিত সাধারণ ছুটি ৪ এপ্রিল থেকে ১১ এপ্রিল পর্যন্ত বাড়ানো হলেও অধিকাংশ শিল্প কারখানা খুলে দেয়ায় অঘোষিত লকডাউন কার্যত অচল হয়ে পড়েছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
যোগাযোগ করা হলে শিল্প-পুলিশের একজন পরিচালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, শিল্প মালিকরা কারখানা খোলা রেখেছেন। হাজার হাজার শ্রমিক কারখানার উদ্দেশে পথে নেমেছেন। এখানে আমাদের করার কিছুই নেই।
এদিকে সমগ্র বিষয় নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা গেছে নাগরিকদের অনেককে।
সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার ব্যবস্থাপনা আরও কঠোর করতে সাভারে সকাল ৭টা থেকে ১০টার পর নিত্য প্রয়োজনীয় সব পণ্যের দোকানপাট বন্ধ রাখার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
অত সকালে কি দোকান খোলে? পাইকারি বাজার থেকে খুচরা বিক্রেতারা বাজার নিয়ে এসে তা সাজাতে সাজাতে বেজে যায় ১০টা।
এ সময়সীমা ঘোষণায় নাগরিক বিড়ম্বনা যেখানে চরমে উঠেছে সেখানে তৈরি পোশাক কারখানার হাজার হাজার শ্রমিকের ঘর থেকে বের হয়ে যাওয়াকে এক রকম প্রহসন বলেই মনে করছেন সরকারি বিধি নিষেধ মেনে চলা সাধারণ নাগরিকরা।
সরকারি সব আইন কি তাহলে আমাদের সাধারণ নাগরিকদের জন্য- এমন প্রশ্ন তুলে ফেসবুকে জামাল উদ্দিন নামে একজন লিখেছেন, কোন সাহসে তৈরি পোশাক কারখানাগুলো খুলে দেয়া হলো? এভাবে জনস্বাস্থ্যকে হুমকির মুখে ঠেলে দেয়ার দায় কে নেবে?
জানি এর কোনো উত্তর নেই।