আর মাত্র দুই দিন পর একুশে ফেব্রুয়ারি। ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে প্রস্তুত চট্টগ্রামের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার। এবারই প্রথমবারের মত নগরীর কে সি দে রোডস্থ নবনির্মিত শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা জানাবে নগরবাসী।
এতদিন মিউনিসিপ্যাল মডেল হাইস্কুল মাঠের অস্থায়ী শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা জানানো হলেও এবার মূল শহীদ মিনারে একুশের আয়োজন ঘিরে নগরজুড়ে বাড়তি উচ্ছ্বাস কাজ করছে। শিক্ষার্থী, শিক্ষক, মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ মানুষ সবার মধ্যেই রয়েছে ভিন্ন এক অনুভূতি। ভাষা শহীদদের স্মরণে নতুন স্থাপনায় প্রথম শ্রদ্ধা জানানো হবে- এই ভাবনাই তৈরি করছে এক অন্যরকম আবেগ।
শহরের কে সি দে সড়কে লাগোয়া সবুজ গাছগাছালির আবরণে ঘেরা, পাথরের বাঁধানো প্রশস্ত সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠলেই দেখা মিলবে চট্টগ্রামের নবনির্মিত শহীদ মিনারের। সুউচ্চ সাদা স্তম্ভের মাঝে স্মৃতির আলো জ্বেলে দাঁড়িয়ে আছে এই ঐতিহাসিক মিনার, যা ভাষা আন্দোলনের আত্মত্যাগের প্রতীক হয়ে উঠেছে।
চারপাশে লাল ইটের দেয়ালে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে ভাষা আন্দোলনের নানা দৃশ্য। শহীদদের প্রতিকৃতি ও ভাষা সংগ্রামের ভাস্কর্যসমূহ এটির গৌরবময় ইতিহাসকে জীবন্ত করে তুলেছে। সামনের খোলা চত্বরজুড়ে রয়েছে বেশ কয়েকটি ছোট আকারের গাছের টব, যা পুরো স্থানটিকে সুশৃঙ্খল ও নান্দনিক আবহ দিয়েছে। পাশেই রয়েছে একটি উঁচু দেয়াল, যেখানে ভাষা আন্দোলনের স্মরণীয় মুহূর্তগুলো খোদাই করা হয়েছে। এর পাদদেশে রয়েছে কালো পাথরের বেদি, যেখানে দাঁড়িয়ে একুশের প্রথম প্রহরে শ্রদ্ধা জানাবে চট্টগ্রামবাসী।
শহীদ মিনার উন্মুক্ত হওয়ার খবরে সবচেয়ে বেশি আনন্দিত শিক্ষার্থীরা। চট্টগ্রাম কলেজের শিক্ষার্থী রাফসান জুবায়ের বলেন, প্রতিবছর অস্থায়ী শহীদ মিনারে ফুল দিতাম, এবার ইতিহাসের অংশ হতে যাচ্ছি।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী মেহজাবিন সুলতানা বলেন, অনেকদিনের অপেক্ষার পর আমরা মূল শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা জানাতে পারবো, যা আমাদের জন্য দারুণ এক মুহূর্ত।
একুশে ফেব্রুয়ারি শুধু একটি দিন নয়, এটি চেতনার প্রতীক। চট্টগ্রাম কলেজের ইতিহাস বিভাগের সহকারী অধ্যাপক কামরুন নাহার সালমা বলেন, শহীদ মিনার শুধু স্থাপনা নয়, এটি আমাদের ভাষা আন্দোলনের স্মারক। এখানে প্রথমবার শ্রদ্ধা জানানো এক অন্যরকম অনুভূতি হবে।
ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে শহীদ মিনারের রয়েছে গভীর সম্পর্ক। মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ নওশের আলী বলেন, আমরা সেই সময় দেখেছি কীভাবে ভাষার জন্য সংগ্রাম করতে হয়েছে। নতুন প্রজন্ম এখন এই শহীদ মিনারে এসে সেই ইতিহাসের অংশ হতে পারবে। এটি আমাদের আন্দোলনের চেতনাকে আরও শক্তিশালী করবে।
চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন বলেন, নবনির্মিত চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে জনসাধারণের প্রবেশ বন্ধ ছিল এবং এতদিন অস্থায়ী শহীদ মিনার ব্যবহার করা হয়েছে। চট্টগ্রামের মানুষ ২০২৫ সালে এসে ২১ ফেব্রুয়ারি নতুন যে স্থাপনা আগের যে জায়গা সেই ঐতিহ্যবাহী জায়গায় তারা ফুল দেবে এবং এটা উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে। সার্বিকভাবে সিটি করপোরেশন যেহেতু আগে থেকেই এটার ব্যবস্থাপনায় ছিল এবারও আমরা করব, আর নিরাপত্তাসহ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে পুলিশ আমাদের সার্বিক সহযোগিতা করবেন।
আশা প্রকাশ করে মেয়র বলেন, এবার আলাদা একটা আমেজে হবে। কারণ অতি আগ্রহ নিয়ে চট্টগ্রামের মানুষ অপেক্ষায় আছে, শহীদ মিনারটি কী রকম হয়েছে। প্রথমবার তারা এখানে আসবে। এটার প্রতি নগরবাসীর আলাদা একটা আগ্রহ তৈরি হয়েছে।
শহীদ মিনারের ডিজাইন পরিবর্তনের সম্ভাবনা সম্পর্কে জানতে চাইলে মেয়র বলেন, মানুষ তো চায় এখানে আসতে। তাদের যে আগ্রহ আছে সেটাকে আমরা বন্ধ করে রাখব কেন। এটা আমাদের একটা ঐতিহ্য। এই জায়গাতেই সবাই আসতে চায়। আশা করছি এবার তাদের আশা পূর্ণ হবে। আপাতত আমরা এ বছর এখানে শ্রদ্ধা জানাই। এটার যিনি ডিজাইন করেছেন, আর্কিটেক্ট উনি এখন আমেরিকাতে আছেন। এখানে মিনারটা আরও বাড়িয়ে দেওয়ার (উচ্চতা) একটা প্ল্যান আছে। কিন্তু আমরা কাজ শুরু করিনি। উনি যদি আসেন বাড়ানোর কাজ বেশি সময় লাগবে না। সেটার জন্য ডিও লেটার দিয়েছি। আল্টিমেটলি সেটার কাজও হবে।
১৯৬২ সালে নগরের কে সি দে রোডে পাহাড়ের পাদদেশে প্রথম শহীদ মিনারটি নির্মাণ করা হয়। ১৯৭৪ সালে এটি নতুন রূপ পায়। এরপর ২০২১ সালে সংস্কৃতিকর্মীদের সঙ্গে আলোচনা করে পুরনো শহীদ মিনার ভেঙে নতুন স্থাপনা নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
২০২২ সালের জানুয়ারিতে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের গণগ্রন্থাগার অধিদফতরের অধীনে সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্স প্রকল্পের আওতায় নতুন শহীদ মিনারের নির্মাণকাজ শুরু হয়। তখন থেকে নগরবাসী মিউনিসিপ্যাল মডেল হাই স্কুল মাঠের অস্থায়ী শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা জানিয়ে আসছিল।
পরবর্তীতে ২০২৪ সালের ২৩ মার্চ নগরের উত্তর কাট্টলীতে সাগর তীরে একটি অস্থায়ী স্মৃতিসৌধের উদ্বোধন করা হয়। ওই বছরের ২৬ মার্চ মিউনিসিপ্যাল মাঠের পরিবর্তে সেখানে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন নগরবাসী।