কাল রাজা ছিলেন, আজ পথের ফকির!
নড়াইল: আগুনে পুড়লে মাটি থাকে। সেখানে নতুন করে ঘর করে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে বসবাস করা যায়। কিন্তু নদী ভাঙনের কবলে পড়লে অবশিষ্ট কিছুই থাকে না। গতকাল পর্যন্ত যারা পরিবার-পরিজন নিয়ে ইটের তৈরি নিজের পাকা বাড়িতে বাস করেছে আজ তারা সব হারিয়ে পথের ফকির। তারা আশ্রয় নিয়েছে খোলা আকাশের নিচে বা কোনো আত্মীয়ের বাসায়।
বলছিলাম নড়াইলের কালিয়া উপজেলার নবগঙ্গা নদীপাড়ের শুক্তগ্রামের কথা। প্রবল স্রোতে নবগঙ্গা নদীর ভাঙনে উপজেলার শুক্তগ্রামের প্রায় ২০০ বছরের পুরনো পালা পাড়া নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। প্রায় ৫০টি পাল পরিবারসহ শতাধিক পরিবার এখন গৃহহীন হয়ে পড়েছে। বর্তমানে হুমকির মুখে রয়েছে শতাধিক পরিবারসহ বাজার, আশ্রয়ণ প্রকল্প, পানি উন্নয়ন বোর্ডের অস্থায়ী অফিস, বিদ্যালয়, ফসলি জমি।
সরেজমিনে দেখা যায়, নবগঙ্গা নদীর ভয়াল আগ্রাসনে প্রায় পাল পাড়ার সব জায়গা জমি নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। সম্প্রতি নদী ভাঙনে প্রায় দুই শতাধিক পরিবার গৃহহীন হয়ে পড়েছে। এছাড়া হুমকির মুখে রয়েছে শুক্তগ্রাম আশ্রয়ণ প্রকল্প, শুক্তগ্রাম বাজার, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ আশপাশের শতাধিক পরিবার। নদী ভাঙনে একে একে সবাই হারিয়েছে তাদের বাপ-দাদার ভিটেমাটি। যে যেভাবে পারছে বাড়িঘর ভেঙে অন্যত্র সরিয়ে নিচ্ছে। রাতারাতি নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে তাদের পারিবারিক মন্দির, কুমোর শিল্পের চাকার ঘর, হাড়ি-কলসি পোড়ানোর পাজা, নার্সারিসহ অসংখ্য ফলজ ও বনজ গাছপালা।
১নং বাবরা-হাচলা ইউনিয়নের মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ও সাবেক ইউপি মেম্বার লায়েক হোসেন মোল্যা জানান, ওই গ্রামের অরুণ পাল, রতন পাল, কালিদাস পাল, মনি মহন পাল, হরিদাস পাল, কার্তিক পাল, বিকাশ পাল, ঝন্টু পাল, লিমা বেগম, রতন শিকদার, হাসান শিকদার, আকবর খান, আকতার মণ্ডল, দিলিপ পাল, রবি পালসহ শুক্তগ্রাম বাজারের পূর্বপাশে অবস্থিত প্রায় পুরো এলাকাই নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। এভাবে যদি আর কিছুদিন চলতে থাকে তাহলে ঐতিহ্যবাহী শুক্তগ্রাম বাজার ও কয়েকশ পরিবারের ভিটেমাটি বিলীন হয়ে যাবে।
পালপাড়ার প্রবীণ ঝন্টু পাল জানান, বাবার হাত ধরেই তিনি এ পেশায় এসেছেন প্রায় ৪৫ বছর আগে। স্ত্রী ও এক অন্ধ ছেলেসহ চার সন্তান রয়েছে। তার সংসারে নাতি-নাতনিসহ পরিবারে মোট ১১ জন সদস্য রয়েছে। ১৭ শতক জমিতে চারটি ছোট টিনের ঘর ও একটি মৃৎশিল্প তৈরির চাকা এবং পোড়ানোর পাজা ছিল তাদের। তিনটি ঘর অন্যত্র সরিয়ে নিতে পারলেও বাকি সব নবগঙ্গায় বিলীন হয়ে গেছে।
তিনি আরও জানান, নতুন করে অন্যত্র জমি কিনে বাড়িঘর নির্মাণ করার সামর্থ্য নেই তার। ১৫ দিন ধরে কাজ বন্ধ। যে সকল জিনিসপত্র তৈরি করা ছিল তাও সরাতে পারেননি। এই বৃদ্ধ বয়সে তিনি এখন কী করবেন সে প্রশ্ন করে অঝোরে কেঁদে উঠলেন।
নার্সারি ব্যবসায়ী বিলায়েত হোসেন মোল্যা জানান, ১৮ বিঘা জমির মাত্র বিঘা দুয়েক আছে। বাকি সবই সর্বনাশা নবগঙ্গা খেয়ে ফেলেছে। তার ওই জমিতে ছিল ২টি আমের নার্সারি, ২টা মেহগনির নার্সারি, ১টা আমের বাগান ও ৪টা কুলের বাগান। সব হারিয়ে তিনি যেন রাজা থেকে পথের ফকির হয়ে গেলেন। তার মতো একই অবস্থা ওই গ্রামের আরও অনেকের।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী শাহ নেওয়াজ বার্তা২৪.কমকে জানান, ইতোমধ্যে শতাধিক পরিবারের বাড়ি-ঘর নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের পক্ষ থেকে ভাঙন রোধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে।
জেলা প্রশাসক মো. এমদাদুল হক চৌধুরী বার্তা২৪.কমকে জানান, নদী ভাঙ্ন কবলিত এলাকা পরিদর্শন করে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিবের সঙ্গে কথা বলেছেন। মন্ত্রণালয় থেকে পানি উন্নয়ন বোর্ডকে ভাঙন রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে বলা হয়েছে।
নড়াইল-১ আসনের সংসদ সদস্য কবিরুল হক মুক্তি বার্তা২৪.কমকে জানান, দ্রুত ভাঙন রোধে জরুরি ভিত্তিতে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বিভাগীয় কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।