আবহাওয়ার চরম বৈপরীত্যে এবার স্বাদ-গন্ধ-রঙহীন আম

  • হাসান আদিব, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, রাজশাহী
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ঘনঘন বৃষ্টি ও আর্দ্র আবহাওয়ায় আমের গায়ে মাছিপোকার হানা

ঘনঘন বৃষ্টি ও আর্দ্র আবহাওয়ায় আমের গায়ে মাছিপোকার হানা

পরিপক্ব আম পাড়ার দুই থেকে তিনদিনের মধ্যেই চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে পাকা আমের সুঘ্রাণ। আম হয়ে উঠে নরম। গায়ে ধারণ করে লাল-হলুদ বর্ণ। ছিলে ভেতরের তুলতুলে নরম ফাইবার বা আঁশ মুখে দিলেই গলে যায়। রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের ভালো জাতের আম তো বটেই, অধিকাংশ গুঁটিজাতের পাকা আমেরও চিরচারিত গুণ বা বৈশিষ্ট্য এগুলো।

কিন্তু এবারই ঘটছে ভিন্ন! নির্ধারিত সময় পেরিয়ে গেলেও পাকছে না আম। অনেক ক্ষেত্রে গাছ থেকে পাড়ার ৭ দিনেও নরম হচ্ছে না! গায়ে ধরছে না সেই লাল-হলুদ বর্ণও। সুস্বাদু জাতের আম বলে খ্যাতি থাকা পাকা আমেও মিলছে ‘মাছিপোকা’!

বিজ্ঞাপন

আম পাকার এই বৈপরীত্যে ‘ভ্যাবাচ্যাকা’ খেয়ে গেছেন অধিকাংশ বাগান মালিক ও পাইকার ব্যবসায়ী। বছরের পর বছর আম ব্যবসা করেও এবার আমের ‘মতিগতি’ কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছেন না তারা। আর এমন ঘটনা গভীরভাবে ভাবিয়ে তুলেছে ফল গবেষক ও কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তাদেরও। তারা রীতিমতো উদ্বিগ্ন।

গবেষক ও কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন- আবহাওয়ার চরম বৈপরীত্যের কারণে রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের আমের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। প্রকৃতির চরম প্রতিকূলতায় অতি লোভনীয় ও রসালো ফল আমের ঐতিহ্যবাহী স্বাদ, গন্ধ ও মিষ্টতা থেকে এবার বঞ্চিত হবেন ভোক্তারা।

বিজ্ঞাপন
ঘনঘন বৃষ্টি ও আর্দ্র আবহাওয়ায় আমের গায়ে মাছিপোকার হানা

চলতি বছর আমের ওপর দিয়ে ভয়াবহ বিপর্যয় গেছে বলে মনে করেন রাজশাহী ফল গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. আলিম উদ্দিন। দীর্ঘদিন ধরে তিনি রাজশাহী অঞ্চলে আমসহ বিভিন্ন ফল নিয়ে গবেষণা কাজ করছেন। তাঁর ধারণা- ‘আবহাওয়ার বৈপরীত্যই রসালো ফল আমের স্বাদ, গন্ধ ও মিষ্টতা কেড়ে নিয়েছে।’

ড. আলিম উদ্দিন বলেন, ‘এপ্রিল মাস থেকে রাজশাহী অঞ্চলে আম বড় হওয়া শুরু হয়। এ বছর ওই সময়টাতে ঘনঘন ঝড়-বৃষ্টি হয়েছে এ অঞ্চলে এবং তা চলছেই। আমের ফাইবার বা ভেতরের আঁশ পুষ্ট হওয়া থেকে আমের ভেতরে আঁশ পুষ্ট হওয়া থেকে ভেতরে ও বাইরের রঙ ধরার জন্য পর্যাপ্ত সূর্যকিরণ, ঝলমলে রৌদ্রতাপ আর কিছুটা শুষ্কতার প্রয়োজন হয়। যা এবার রাজশাহী অঞ্চলে ছিল না।’

জানা গেছে, আমের গুণগতমান রক্ষা ও কেমিক্যালমুক্ত আম বাজারজাত নিশ্চিত করতে গত কয়েক বছর ধরে জেলা প্রশাসন থেকে বিভিন্ন জাতের আম পাড়ার সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়। প্রশাসনের বেঁধে দেয়া সময়ের আগে রাজশাহী অঞ্চলের আমপ্রধান চার জেলায় কেউ আম পাড়তে পারে না।

গাছে ঝুলছে ল্যাংড়া

গত ৩ বছরে গাছে আম পেকে পড়ে গেলেও কেউ সেই আম প্রশাসনের নির্দেশিত সময়ের আগে বাজারে তুলতে পারেনি। করোনার মধ্যেও চাষিরা এ বছরও সেইভাবে আম পাড়ার প্রস্তুতি নেন। কিন্তু আম পাড়া ও পাকা নিয়ে বিড়ম্বনায় পড়েছেন চাষি ও বাগান মালিকরা।

রাজশাহীর মোহনপুরের আমচাষি মোকিম বিশ্বাস বলেন, ‘১৫ মে গুঁটিসহ দেশি আঁটিজাতের আম পাড়ার সময় দিয়েছিল প্রশাসন। বিগত বছরগুলোতে ওই সময়ে আগেই আম পেকে ঝরে পড়ে। কিন্তু এবার জুনের আগে গুটি আম-ই পাকে নি। গাছে আম পেকে যেভাবে রঙিন হয়ে থাকে, তেমনটিও দেখা যায় নি।’

পবা উপজেলার বড়গাছি গ্রামের আমচাষি সোলেমান সরদার বলেন, ‘আমার কিছু গাছের আম পাড়ার পর ৭ দিন ঘরে রেখেও পাকেনি। বরং নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। কোনো ঘ্রাণ নেই, রঙও নেই। আবার গোপালভোগ, ক্ষিরসাপাত আমের মধ্যেও পোকা।’

বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রশাসনের নির্দশেনা অনুযায়ী এখন পর্যন্ত বাজারে এসেছে গোপালভোগ (শেষের পথে), ক্ষিরসাপাত বা হিমসাগর ও ল্যাংড়া। তবে ল্যাংড়া এখনও সেভাবে বাজারে আসেনি। ১৫ জুন থেকে ফজলি ও আম্রপালি জাতের আম বাজারে আসার কথা থাকলেও অপরিপক্ক থাকায় আরও এক সপ্তাহ দেরি হবে।

পরিপক্ব ল্যাংড়া

পবা উপজেলার ধর্মহাটার আমবাগান মালিক মোমিনুল বলেন, ‘সময় হয়ে গেছে, পুষ্ট ভেবে গাছ থেকে আম নামাচ্ছি। কিন্তু পাকছে না, রঙ আসছে না; নেই সুমধুর ঘ্রাণও। অন্য বছরগুলোতে বাগানে আম পাকলে পাশের রাস্তা দিয়ে পথচারীরা গেলেও ঘ্রাণ পেতেন। এবার বাগানে ঢুকে গাছে চড়েও আমরা তা পাচ্ছি না।’

আরেক আমচাষি ফখরুল ইসলাম বলেন, ‘বাড়িতে খাওয়ার জন্য তিন/চারদিন আগে কিছু ক্ষিরসাপাত বা হিমসাগর আম নিয়ে যাই। কিন্তু এখনও পর্যন্ত একটা আমও পাকেনি। টিপে দেখছি সব শক্ত। দীর্ঘ ৫০ বছরেও আমি আমের এমন অবস্থা দেখিনি।’

আমের সহজাত স্বাদ-গন্ধহীনতা ছাড়াও জাত আমে পোকা হওয়ার বিষয়ে বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. আলিম উদ্দিন বলেন, ক্ষিরসাপাত বা হিমসাগর ও ল্যাংড়া আমে পোকার আক্রমণ সাধারণত হয় না। কিন্তু এ বছর তাও ঘটেছে, আমি নিজেও পরীক্ষা করে সত্যতা পেয়েছি।

আম বাগান

ড. আলিম উদ্দিনের ধারণা- ঘন ঘন বৃষ্টি আর অধিক আর্দ্র আবহাওয়ার কারণে অধিকাংশ সময় আম ভিজে থাকছে। ‘মাছি পোকা’ নামে যে পোকাটি আমকে আক্রমণ করে, সেটি সহজেই ছোট ফুটা করে আমের ভেতরে ঢুকে পড়ছে। ফলে প্রায় প্রতিটা আমের গায়ে কালো দাগ পাওয়া যাচ্ছে। আর আমের ফাইবারকে নষ্ট করে দিচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, ‘পোকা ধরার সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়ার দুটি উপায়। প্রথমটি হলো- আমকে ফ্রুটব্যাগ দিয়ে ঢেকে দেয়া, যাতে পোকা ঢুকতে না পারে। আর দ্বিতীয়টি হলো- হট ওয়াটার প্ল্যান্টের মাধ্যমে আমে ভাপ দেয়া।’ তবে প্রাকৃতিক বিড়ম্বনা এড়ানো কঠিন চ্যালেঞ্জ বলে মনে করেন ফল গবেষক ড. আলিম উদ্দিন।