সাইকেল, নগর ও সুস্বাস্থ্য
কল্পনা করুন আপনার একটি সাইকেল আছে। আপনি আপনার বাসস্থান হতে সাইকেলযোগে প্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে দোকানে বা বাজারে যান। প্রয়োজনীয় জিনিস যেমন- চাল, ডাল, রুটি কেনার পর আপনার বাজারের ব্যাগটি ভারী হয়ে গিয়েছে। আপনি হয়তো ভাবছেন ভারী ব্যাগ কীভাবে সাইকেলযোগে বহন করবেন। চিন্তার কারণ নেই। কারণ, সাইকেলের পেছনের চাকার দুই পাশে দুইটি বাক্সের মতো ক্যারিয়ার লাগানো আছে। সেগুলোতে কমপক্ষে ১০ কেজি পরিমাণ জিনিসপত্র বহন করতে পারবেন।
আবার মনে করুন, আপনি ঢাকার কমলাপুর এলাকায় বাস করেন। আপনি একটি ব্যাংকে চাকরি করেন। আপনার অফিস নারায়ণগঞ্জে। কমলাপুর থেকে নারায়ণগঞ্জে আপনি সহজেই ট্রেনে যাতায়াত করেন। কিন্তু, ট্রেন থেকে নামার পর অফিসে যেতে আরও বিশ মিনিটের রাস্তা রিকশায় যেতে হয়। সময় মতো রিকশা না পেলে অফিসে ঠিক সময়ে পৌঁছাতে পারেন না। এমন যদি হতো আপনি বাসা থেকে আপনার সাইকেলযোগে কমলাপুর গেলেন, ট্রেনে আপনিও উঠলেন এবং আপনার সাইকেলটিকেও উঠালেন। নারায়ণগঞ্জ স্টেশনে নেমে রিকশার জন্য অপেক্ষা করতে হলো না। আপনার নিজের সাইকেলযোগে অফিসে ঠিক সময়ে পৌঁছাতে পারলেন। অফিস ছুটির পর ঠিক একইভাবে বাসায় ফিরে আসলেন।
সাইকেলে চড়ে এক শহর হতে অন্য শহরে যাওয়া বাংলাদেশের নাগরিকদের জন্য কল্পনার বিষয়। কিন্তু, উন্নত দেশগুলোতে এটি একেবারেই সাধারণ বিষয়। বহু মানুষ নিজের সাইকেল নিয়ে এক শহর হতে অন্য শহরের অফিসে কাজ করছে। শিক্ষার্থীরা তাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যাচ্ছে। আমি উচ্চ শিক্ষার জন্য আয়ারল্যান্ডে অবস্থান করেছি। সেখানে দেখেছি যে আমার সহপাঠীরা বাসা থেকে সাইকেল চালিয়ে ট্রেন স্টেশনে আসে। সাইকেল ফোল্ডিং করে ট্রেনে নির্দিষ্ট জায়গায় রাখে। শুধু ট্রেনে নয়। নিজের সাইকেল নিয়ে বাসেও উঠা যায়। সাইকেলের জন্য আলাদা কোনো ভাড়া গুনতে হয় না। ট্রেন বা বাস থেকে নেমে সাইকেল চালিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসে। শুধু শিক্ষার্থীরাই নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও প্রশাসনিক কর্মকর্তারাও একইভাবে সাইকেল নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসে। সাইকেল চালানোর সঙ্গে গাড়ি থাকা বা না থাকার কোনো সম্পর্ক নেই।
আমি আয়ারল্যান্ডে থাকাকালীন দেখেছি যে অনেকেই শহরে অফিস করেন, কিন্তু বাস করেন শহর থেকে দূরে। যেমন, অনেকেই রাজধানী শহর ডাবলিন-এ অফিস করেন। তাদের অনেকেই নিজস্ব গাড়ি নিয়ে অফিসে যান না। এর একটি বড় কারণ হলো শহরে গাড়ি পার্কিং-এর খরচ তুলনামূলকভাবে বেশি। ফলে, গাড়ি থাকা সত্ত্বেও তারা সাইকেল চালিয়ে অফিসে যান। অথবা নিজস্ব গাড়ি ট্রেন স্টেশনে পার্কিং করে অফিসে যান। যেহেতু সাইকেল চালালে শরীরে ঘাম হয় এবং পোশাক ভিজে যায়, তাই তারা সাধারণ পোশাক পরে সাইকেল চালায় আর অফিসিয়াল বা ফর্মাল ড্রেস সাইকেলের ক্যারিয়ারে নিয়ে যান। অফিসে পৌঁছে ড্রেস পরিবর্তন করেন।
আয়ারল্যান্ডের ছোট কিংবা বড় শহরগুলোর রাস্তা কয়েকভাবে সাজানো। রাস্তার দুই পাশেই যন্ত্রচালিত যানবাহন, সাইকেল ও পথচারীদের জন্য পৃথক পৃথক লেন রয়েছে। অর্থাৎ, প্রতিটি পাশেই সাইকেল চালানোর জন্য পৃথক লেন রয়েছে। ফলে, দুর্ঘটনার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। মায়েরা তাদের শিশু সন্তানকে নিয়েই সাইকেল চালাচ্ছে। মা তার শিশুদেরকে চাকাযুক্ত ট্রলির মধ্যে বসিয়ে সেই ট্রলি তার সাইকেলের সঙ্গে লাগিয়ে ঘুরতে বেরিয়েছে কিংবা শপিং করতে যাচ্ছে - এরূপ চিত্র নিত্যদিনের। এইভাবে তারা প্রচুর সময় ও অর্থ ব্যয় করা হতে বিরত থাকে। তাছাড়া, সাইকেল চালালে ভাড়াযুক্ত যানবাহনের উপর নির্ভরশীলতা কমে আসে। সময় ও কাজ নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হয়।
বাংলাদেশের শহরগুলোতে সাইকেল চালিয়ে অফিসে যাওয়া অনেকখানি ঝুঁকির। এর বড় কারণ হচ্ছে বাংলাদেশে যন্ত্রচালিত ও যন্ত্রহীন যানবাহনের পৃথক রাস্তা নেই। বাস, টেম্পু, ট্রাক, রিকশা, বাইসাইকেল ও মোটরবাইক একই রাস্তায় অনিয়ন্ত্রিতভাবে চলছে। পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোতে এই চিত্রটি দেখা যায় না। সেখানে ট্রাফিক সিগনালের লাল, সবুজ ও হলুদ বাতির পাশাপাশি পথচারী ও সাইকেল চালকদের সংকেত দেয়ার জন্য পৃথক বাতির ব্যবস্থা আছে। ট্রেন স্টেশনগুলোতে গাড়ি পার্কিং-এর পাশাপাশি সাইকেল রাখার পৃথক জায়গা আছে। এমনকি আমাদের দেশের স্টিলের আলমারির মতো দেখতে লকারও আছে। সেই লকারের ভেতরে সাইকেল লক করার ব্যবস্থা আছে। অনেককে দেখেছি বাড়িতে একাধিক দামি গাড়ি আছে কিন্তু অফিসে যাওয়ার সময় সাইকেল চালিয়ে সেটি ট্রেন স্টেশনে লক করে তারপর ট্রেনে করে অফিসে যায়। অফিস ছুটির পর আবার একইভাবে বাড়িতে ফিরে আসে।
বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে একটি ধারণা আছে যে শুধুমাত্র নিম্ন আয়ের মানুষরাই সাইকেল চালায়। এ সম্পর্কে একটি গল্প শেয়ার করছি। আমার এক সহকর্মী জাপানে পিএইচডি করতে গিয়েছিলেন। তার গবেষণার সুপারভাইজার সাইকেল চালিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসা সম্পর্কে একটি গল্প বলেছিলেন। তিনি মনে মনে ভাবতেন যে তার সুপারভাইজার জাপানের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর। তিনি কিনা সাইকেল চালিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসেন! তিনি ভেবেছিলেন তার সুপারভাইজারের গাড়ি কেনার সামর্থ্য হয়তো নেই। তার সুপারভাইজার তাকে একদিন নিমন্ত্রণে ডাকলেন। তিনি গেলেন। গিয়ে দেখেনে তার বাড়িতে একাধিক গাড়ি। তিনি খুবই অবাক হয়েছেন ও মনে মনে লজ্জিত হয়েছেন।
বাংলাদেশের গ্রাম ও ছোট শহরগুলোতে সাইকেলের ব্যবহার চোখে পড়ার মতো। যেমন, আমি রাজশাহীতে দেখি যে বহু মানুষ ভোর হতেই সাইকেল চালিয়ে শহরে প্রবেশ করে। তাদের বেশিরভাগই দিনমজুরের কাজ করেন। কাজ শেষে বিকেল বেলায় তারা নিজ নিজ গ্রামে ফিরে যান। সম্প্রতি, ঢাকা শহরের কর্মজীবী যুবকদের মধ্যে সাইকেল চালানোর চিত্রটি লক্ষ্যণীয়। তাদের মধ্যে অনেকেই ব্যাংক ও অন্যান্য বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন। তবে, শহরে কর্মজীবী নারীদেরকে সাইকেল চালাতে খুব একটা দেখা যায় না। এর পেছনে কারণ বহুবিধ। রাস্তায় অনিরাপত্তার ব্যাপারটি তো আছেই। এছাড়া,অন্যতম কারণ হলো সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বাধা। তবে, গ্রামাঞ্চলে বহু নারী এনজিও কর্মীদেরকে দেখা যায় যে তারা সাইকেল বা মোটরসাইকেলে অফিসে ও ফিল্ডে আসা-যাওয়া করেন। উন্নত দেশগুলোতে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সাইকেল চালিয়ে স্কুলে, বিশ্ববিদ্যালয়ে ও অফিসে যাতায়াত করছে। আমার মতে বাংলাদেশের নারীরা সাইকেল চালিয়ে যদি স্কুলে কিংবা কর্মস্থলে আসা-যাওয়া শুরু করে তাহলে তাদের শারীরিক ও মানসিক ক্ষমতায়নের বৃদ্ধি ঘটবে দ্রুতবেগে, গুণগতভাবে ও লক্ষ্যণীয়ভাবে। সাইকেলের ব্যবহার গণপরিবহনের প্রতি মানুষের অতি নির্ভরশীলতাকে কমিয়ে আনবে। বাসে গাদাগাদি করে অস্বাস্থ্যকরভাবে যাতায়াত করার প্রবণতাকে কমিয়ে আনবে। পরিবেশ দূষণ কমে আসবে। শরীরে স্থূলত থাকবে না। হার্টের অসুখ কমে আসবে। শরীরের ওজন ও কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে থাকবে। ফলে, মানুষ শারীরিক ও মানসিকভাবে দক্ষ হবে।
মূল প্রশ্ন হলো বাংলাদেশের সড়ক ব্যবস্থা মানুষকে সাইকেল চালাতে আগ্রহী করে কী? এর উত্তর আমরা সবাই জানি। সড়কের কাঠামোই বলে দিচ্ছে যে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এই ব্যাপারে তৎপর নয়। যে শহরগুলো এখনো ঢাকা শহরের মতো ব্যস্ত হয়ে উঠেনি সেগুলোতে নির্দিষ্ট কিছু এলাকাকে পরিকল্পিতভাবে সাইকেল জোন করা যেতে পারে। সেখানে শুধু পায়ে হেঁটে বা সাইকেলযোগে যাওয়া যাবে। উক্ত জোনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যন্ত্রযান ছাড়া অন্য কোনো গাড়ি প্রবেশ করতে পারবে না - এরূপ নিয়ম করতে হবে এবং তা মানতে হবে। সেখানে হাঁটা ও সাইকেল চালানোর জন্য পৃথক পৃথক লেন থাকবে। বেঞ্চিতে বসা যাবে। আহার ও পান করার জন্য প্রয়োজনীয় ফুড কোর্ট থাকবে। বিভিন্ন জেলার ঐতিহ্যবাহী খাবার পাওয়া যাবে। দেশের ইতিহাস সম্পর্কিত ভাস্কর্য থাকবে। সহজেই অনুমান করা যায় যে সেই স্থানগুলো ধীরে ধীরে স্থানীয় টুরিস্ট প্লেস বা দর্শনীয় স্থান হিসেবে রূপ নেবে। এই ধরনের টুরিস্ট প্লেসে মানুষ বেড়াতে আসতে পারবে। দেশের সব জায়গাতে তো আর পাহাড় বা সমুদ্র নেই। এ সব জায়গাগুলোতে যাওয়া সময় ও ব্যয়সাপেক্ষ। নগরের ভেতরে পরিকল্পিতভাবে সাইকেল জোন করলে সাধ্যের মধ্যেই সব বয়সী মানুষ অবসর সময়ে আনন্দ উপভোগ করতে পারবে। বয়স্কদের মধ্যে অনেকেই ডায়াবেটিস রোগে ভুগেন এবং তাদের নিরাপদে হাঁটার জন্য জায়গা নেই বললেই চলে। যা আছে তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই স্বল্প, অপরিকল্পিত, অপরিচ্ছন্ন ও অনিরাপদ। সাইকেল নগরীতে তারা হাঁটতে পারবেন। এতে তাদের মন প্রফুল্ল থাকবে। করোনা পরিস্থিতিতে সরকার জনস্বাস্থ্যের প্রতি আগের চাইতে ব্যাপকভাবে নজর দিচ্ছে। বিভিন্ন ধরনের ইতিবাচক ও প্রশংসনীয় উদ্যোগ নিয়েছে। নগরের মানুষের সুস্বাস্থ্যের কথা চিন্তা করে রাষ্ট্র যদি নগরসমূহের কেন্দ্রেই সাইকেল জোন ও বিনোদন স্থান স্থাপনে গুরুত্ব দেয় তাহলে জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা আরও শক্তিশালী হবে।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।