দেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের অন্তত ১০ হাজার শিক্ষককে বিনামূল্যে অনলাইনে ক্লাস নেওয়ার পদ্ধতিগত ও প্রযুক্তিগত প্রশিক্ষণ দেওয়ার কার্যক্রম হাতে নিয়েছে কোডার্স ট্রাস্ট। প্রযুক্তি প্রশিক্ষণ ও জ্ঞান বিতরণে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানটি তাদের ঢাকাস্থ সদর দফতর ও অন্যান্য প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে এই প্রশিক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনা করবে। প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে সম্পূর্ণ অনলাইনে। প্রশিক্ষণার্থী ১০ হাজার শিক্ষক এরই মধ্যে তাদের নিবন্ধন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছেন।
এরই উদ্বোধনী হয়ে গেলো শনিবার (২০ জুন)। এক ওয়েবিনারের মাধ্যমে আয়োজিত এই কর্মসূচির উদ্বোধন করেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি।
এতে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর সাবেক মুখ্যসচিব আবদুল করিম, সাবেক শিক্ষাসচিব নজরুল ইসলাম খান, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. ফসিউল্লাহ। যুক্তরাষ্ট্র থেকে যোগ দেন কোডার্সট্রাস্টের কো-ফাউন্ডার ও ইউটিসি অ্যাসোসিয়েটসের প্রতিষ্ঠাতা আজিজ আহমদ। এছাড়াও ছিলেন, কোডার্সট্রাস্ট বাংলাদেশ’র উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব) আবদুল হালিম, শিক্ষাডটকম এর সম্পাদক সিদ্দিকুর রহমান খান এবং কোডার্সট্রাস্ট বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর আতাউল গনি ওসমানি।
শিক্ষাডটকম এই প্রশিক্ষণ কর্মসূচি বাস্তবায়নে সহায়ক প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করছে। উদ্বোধনীর পরপরই শুরু হয় দিনের প্রশিক্ষণ কার্যক্রম।
উদ্বোধনী বক্তৃতায় শিক্ষামন্ত্রী বলেন, বৈশ্বিক সঙ্কটে আমাদের সকল ক্ষেত্রেই স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। আপদকালীন অবস্থায় আমরা কি করে শিক্ষাব্যবস্থাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারি, যাতে আমাদের শিক্ষার্থীরা পিছিয়ে না পড়ে সরকার সে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
সকল সঙ্কট শুধুমাত্র সঙ্কট নয়, তার মধ্য দিয়েই কিছু সম্ভাবনার দিকও উন্মোচিত হয়, এমন মত দিয়ে শিক্ষমন্ত্রী বলেন, তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে শিক্ষা ব্যবস্থাকে এগিয়ে নেওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে। এটাকে আমাদের কাজে লাগাতে হবে। আর তেমনই একটি উদ্যোগ এই প্রশিক্ষণ কর্মসূচি। এ জন্য আমি কোডার্সট্রাস্ট ও শিক্ষাডটকমকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
শিক্ষামন্ত্রী বলেন, অনলাইন শিক্ষা ব্যবস্থায় আমাদের একসময় যেতেই হবে সে ভাবনা আমাদের ছিলো এবং সে লক্ষ্যে প্রস্তুতিও চলছিলো। বিশ্ব যতই চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে ততই আমাদের এসব বিশেষ দক্ষতা অর্জন জরুরি হয়ে পড়েছে। তবে হঠাৎ করে করোনা পরিস্থিতির কারণে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ রাখতে হচ্ছে ফলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে যা আমরা করতে চেয়েছিলাম তা এখনি শুরু করতে হচ্ছে।
শিক্ষকরা যারা নিজেরা এমন প্রশিক্ষণের প্রয়োজন বোধ করে তা গ্রহণে আগ্রহ দেখিয়েছেন এজন্য তাদের অভিনন্দন জানিয়ে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, আমি আশা করি এই প্রশিক্ষণের মাধ্যমে শিক্ষকরা অনলাইনে আরও ভালো করে পাঠদান করতে পারবে।
স্বাগত বক্তব্যে মানব সম্পদ বা মানব পূঁজি গঠনে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে সমৃদ্ধ করে তোলার কথা বলেন আজিজ আহমদ। তিনি বলেন, আমার বাবাও ছিলেন একজন স্কুল শিক্ষক। শিক্ষার উন্নয়নে যেখানে যতটুকু সুযোগ পাই করার চেষ্টা করে আসছি। কোভিড-১৯ এর বিদ্যমান পরিস্থিতিতে আমরা থেমে থাকতে পারিনা, এর মধ্যেই কিভাবে শিক্ষা কার্যক্রমকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায় সেটাই আমাদের এই কর্মসূচির লক্ষ্য। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগে যে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার প্রক্রিয়া চলছে, তারই অংশ হিসাবে আমরা দেশে অনলাইনে প্রশিক্ষণ দেওয়ার পদ্ধতি নিয়ে আসতে পেরেছি। শিক্ষকরা তাদের অনলাইনে ক্লাস নেওয়ার মৌলিক জ্ঞান ও প্রশিক্ষণ এর মাধ্যমে পাবেন।
মো. ফসিউল্লাহ বলেন, অনলাইনের মাধ্যমে শিক্ষকদের জন্য এই প্রশিক্ষণের উদ্যোগ এ মুহূর্তে আমাদের জন্য খুব দরকারি ও খুবই ভালো উদ্যোগ। বিনামূল্যে এই প্রশিক্ষণ দিতে এগিয়ে আসার জন্য কোডার্সট্রাস্টকে ধন্যবাদ।
প্রাথমিক পর্যায়ে দেশে চার লাখ শিক্ষক রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, অনলাইনের মাধ্যমে তাদের সকলকে প্রশিক্ষণ দেয়া সম্ভব হলে তা অবশ্যই কাজে লাগবে এবং সে দিকেই আমরা যাচ্ছি। এই প্রশিক্ষণ আমাদের সে প্রচেষ্টায় বড় অবদান রাখবে।
আবদুল করিম বলেন, এক সঙ্গে দশ হাজার শিক্ষককে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা একটি কঠিন কাজ। তবে প্রযুক্তির ব্যবহারে দেশের অগ্রগতির কারণেই এখন তা সম্ভব হচ্ছে। শিক্ষকদের আইটিভিত্তিক প্রশিক্ষণ দেয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখ করে তিনি বলেন, আশা করি কোডার্সট্রাস্টের এই প্রশিক্ষণ নিয়ে তারা এ বিষয়ে সে দক্ষতা অর্জন করবেন। এর মাধ্যমে কোভিড-১৯ এর কারণে সৃষ্ট ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করেন আবদুল করিম।
নজরুল ইসলাম খান বলেন, প্রযুক্তির নতুন নতুন সুবিধা এত রয়েছে যে শিক্ষকরা চাইলেই তার ব্যবহার করে তাদের অনলাইন ক্লাসকে অনেক বেশি লাইভলি ও কার্যকর করে তুলতে পারবেন। যেগুলো খুব সহজ পদ্ধতি। তবে নিশ্চিতভাবেই ধারণা করছি, অনেক শিক্ষকের এখন সেটা জানা নেই। আমি মনে করছি, কোডার্সট্রাস্ট তার প্রশিক্ষণের মাধ্যমে শিক্ষকদের সেটা বুঝিয়ে দিতে ও শিখিয়ে দিতে সক্ষম হবে। আর তাতেই সার্বিকভাবে আমাদের অনলাইন শিক্ষণ ব্যবস্থা জোরদার হবে। শিক্ষকরা যারা এই প্রশিক্ষণ নেবেন, তাদের কাছ থেকে ফিডব্যাক নিয়ে ভবিষ্যতে কোন ধরনের প্রশিক্ষণ দেওয়া প্রয়োজন তা জেনে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে কোডার্সট্রাস্টের প্রতি আহবান জানান তিনি।
কোডার্সট্রাস্ট বাংলাদেশ’র উপদেষ্টা অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবদুল হালিম বলেন, করোনা দুর্যোগ কোনো কোনো ক্ষেত্রে আমাদের সুযোগও তৈরি করে দিয়েছে। এ কারণেই আমরা অপেক্ষাকৃত দ্রুত শিক্ষাক্ষেত্রে ডিজিটাল পদ্ধতির প্রয়োগে যেতে পারছি।
কোডার্সট্রাস্টের এই প্রশিক্ষণের মাধ্যমে শিক্ষকরা বিভিন্ন টুলস সম্পর্কে জ্ঞান ও ধারণা নিতে পারবেন। যার মাধ্যমে তারা নিজেদের ক্লাস পরিচালনা করবেন। আবদুল হালিম বলেন, এই দশ হাজার শিক্ষক যখন প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করবেন, তখন স্কুল যদি খুলে দেওয়া না যায় আমাদের শিক্ষা কার্যক্রম থেমে থাকবে না।
সিদ্দিকুর রহমান প্রশিক্ষণের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য তুলে ধরে বলেন, কোভিড-১৯ শুরু হওয়ার পর সরকার যখন টেলিভিশনের মাধ্যমে, অনলাইনে ক্লাস নেওয়ার নির্দেশনা দিলো তখন একটি বিষয় স্পষ্ট হলো দেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের অধিকাংশ শিক্ষকের এ বিষয়ক প্রযুক্তিগত ধারণা নেই। আর সেটা সমাধানেই এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কোডার্সট্রাস্টকে ধন্যবাদ এমন একটি মহতী উদ্যোগে বিনামূল্যে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে।
তিনি বলেন, কোডার্সট্রাস্ট বাংলাদেশে এরই মধ্যে তার আইটি প্রশিক্ষণে স্থান করে নিয়েছে। এর নিয়মিত প্রশিক্ষণগুলোর মেয়াদকাল বড় ও ব্যয়সাপেক্ষ। কিন্তু এই প্রশিক্ষণের জন্য তারা সংক্ষিপ্ত কোর্সের মডেল তৈরি করে তবেই এগিয়ে এসেছে এবং তা বিনামূল্যে।
আতাউল গনি ওসমানি জানান, এরই মধ্যে ১০ হাজার শিক্ষক এই প্রশিক্ষণের জন্য তাদের নিবন্ধন সম্পন্ন করেছেন। এদের সকলকেই এই প্রশিক্ষণের আওতায় আনা হবে। জুম ও গুগল মিট’র মাধ্যমে যেভাবে প্রশিক্ষণ পরিচালিত হবে তার কারিগরি দিকগুলো ব্যাখ্যা করেন। তিনি বলেন, শিক্ষকরা জুম ও গুগল মিটের মাধ্যমে নিজের প্রশিক্ষণ নেবেন। এবং পরে এই পদ্ধতিতেই তারা নিজেরাও শিক্ষার্থীদের পড়াবেন। প্রতিদিন তিনটি করে ব্যাচের প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করা হবে। প্রতিটি ব্যাচে ৫০ জন করে শিক্ষক প্রশিক্ষণ পাবেন।
উদ্বোধনের পর প্রথম দিনেই তিনটি ব্যাচে ১৫০ জন শিক্ষক প্রশিক্ষণ নেন।