হাওরাঞ্চলে আদিম বর্বরতার রক্তাক্ত চিহ্ণ!

  • ড. মাহফুজ পারভেজ, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর, বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

হাওরে দাঙ্গার দৃশ্য। ছবি:বার্তা২৪

হাওরে দাঙ্গার দৃশ্য। ছবি:বার্তা২৪

কিশোরগঞ্জ: প্রতিবছরেই এমন নৃশংসতম দু-চারটি ঘটনা ঘটে, যা শুনে মনে হবে, আদিম সমাজের কিছু উন্মত্ত মানুষের কাণ্ড। কিংবা প্রাচীন ও অন্ধকার আফ্রিকার হিংস্র জাতিগোষ্ঠির পশ্চাৎপদ গোত্রীয় বর্বর তৎপরতা। এমন ঘটনা প্রায়শ ঘটছে কিশোরগঞ্জের প্রত্যন্ত হাওরাঞ্চলে। যে ভয়াবহ ঘটনা রেখে যাচ্ছে রক্ত, মৃত্যু আর আদিম বর্বরতার রক্তাক্ত চিহ্ণ।

ঈদের মাত্র দু‘দিন পর। শুক্রবার (২৪ আগস্ট) সকাল। ঈদপ্রীতি ফুটবল খেলায় তুচ্ছ ঘটনা নিয়ে শত শত লোক সশস্ত্র সংঘাতে লিপ্ত হয় হাওরাঞ্চলীয় উপজেলা মিটামনের কাটখাল গ্রামে। নিহত হয় একজন। আহত হয় ৩০জন।

বিজ্ঞাপন

এমনই সংঘর্ষ হয়েছিল ২০১৭ সালে। সেদিন ছিল ৯ নভেম্বর বৃহস্পতিবার। কিশোরগঞ্জের হাওরাঞ্চলের সেই মিটামন উপজেলার চারিগ্রাম নামক স্থানে গণদাঙ্গায় মারা যায় একাধিক মানুষ। আহত হয় শতাধিক নারী ও পুরুষ।

হাওরাঞ্চলে প্রায়ই সংঘটিত দাঙ্গা-হাঙ্গামার ঘটনা নিয়ে দুটি প্রশ্ন ওঠে। এক) মানবিকতা ও সামাজিকতার স্তরের দিক থেকে আমরা কোথায় আছি যে, আদিম গোত্রের মতো দিনে-দুপুরে হানাহানি করে হত্যাকাণ্ড করছি? এবং দুই) আইন ও প্রশাসন এই দীর্ঘ সংঘাতের সময় কোথায় থাকে? রাষ্ট্র ও সমাজের মধ্যে এমন একটি নৃশংসতা ঘটলো তবু সেটা প্রতিহত করা হলো না কেন?

চলমান একবিংশ শতাব্দীর বিজ্ঞান-শিক্ষা-প্রযুক্তি ও প্রগতির তীব্র সময়েই ঘটেছে এসব মারামারি। দুই দল মানুষ প্রকাশ্যে পরস্পরের বিরুদ্ধে আক্রমণ-প্রতিআক্রমণ করেছে। সংঘবদ্ধ যুদ্ধের মতো প্রতিপক্ষকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে। আহত করেছে অবলীলাক্রমে। এবং সরকারি ও বেসরকারি পযায়ের একজনকেও পাওয়া গেল না, যিনি উন্মত্ত জনতাকে থামানোর জন্য এগিয়ে এসেছেন। না সমাজ, না প্রশাসন, কেউই না।

২০১৭ সালের ৯ নভেম্বর চোখের সামনে পাঁচ জন মানুষ নিহত হলেন। ৩০/৪০ আহত হলেন। ২০১৮ সালের ২৪ আগস্টের ঘটনায় এক মারা গেলেন আর আহত হলেন ৩০ জন। দুটি ঘটনাতেই শত শত লোক লড়াই করলো বন্য ও আদিম হিংস্রতায়। প্রকাশ্যে খুন-জখম করলো পরস্পরকে। কেউ কোনও প্রতিকার, প্রতিরোধ করতে পারলো না?

https://img.imageboss.me/width/700/quality:100/https://img.barta24.com/uploads/news/2018/Aug/25/1535167000437.gif

বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজ ও ক্ষমতা কাঠামোয় এখনও আইন আর শৃঙ্খলার বিকাশ সেভাবে ঘটে নি, এই বর্বরতা তারই প্রমাণবহ। প্রত্যন্ত হাওরে, চরাঞ্চলে, দ্বীপে বিভিন্ন সুযোগ ও সম্পদ এবং ক্ষমতার জন্য এমন লড়াই প্রায়ই হচ্ছে। দেশীয় অস্ত্র ও হাতিয়ার নিয়ে গ্রামে গ্রামে, পাড়ায় পাড়ায়, অঞ্চলে অঞ্চলে দাঙ্গারূপী লড়াই চলছে। কখনো হয়ত এ পাড়ার কেউ ও পাড়ার কাউকে মেরেছে কিংবা এর মুরগী ওর ক্ষেতের ধান খেয়েছে, তাতেই সংঘবদ্ধভাবে রক্তাক্ত লড়াই শুরু হয়ে যাচ্ছে। অকাতরে মানুষ আহত, নিহত হচ্ছে। উন্মত্ততা দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ছে রক্তাক্ত পথে।

এমনই সামাজিক সহিংসতার সময় প্রশাসন, শিক্ষা ব্যবস্থা, সামাজিক নেতৃত্ব কোথায় থাকে? আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সংঘাত থামানোর কোনও ব্যবস্থাও কি তখন থাকে না? নাকি সবাই পেছন থেকে এইসব উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে হাওয়া দিয়ে ফায়দা লুটার তালে থাকে? নইলে এই মোবাইল, ইন্টারনেটের যুগে একটি এলাকায় শত শত লোক লড়াই করবে, এ খবরটি পুলিশ, প্রশাসন, চেয়ারম্যান, মেম্বারদের কাছে যেতে তো কয়েক মিনিট সময়ও লাগার কথা নয়! এতোসব সামাজিক সংযোগ ও যোগাযোগের সময়ে কোথাও উত্তেজনা দানা বাধলে সেটাও তো আগে-ভাগে জেনে যাওয়ার কথা!

কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, দায়িত্বশীলরা ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় কেউ যেন কিছুই  জানে না। জানতে চায় না। বর্বর লড়াই চলার সুযোগ দেয়।

হাওরের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বছরের পর বছর এমনই ভয়াবহতা ঘটে চলেছে। ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর সবাই সক্রিয় হয়। শত শত মানুষকে আসামী করে পাল্টা-পাল্টি মামলা হয়। উভয় পক্ষের পুরুষরা হয় জেলে যায়, নয় তো মামলার ভয়ে গ্রাম ছেড়ে পালায়। বৃদ্ধ, নারী ও শিশুরা দিন কাটায় চরম নিরাপত্তাহীনতায়। হাসপাতালের মর্গে চাটাই দিয়ে মোড়ানো সারি সারি লাশ ঘিরে চলে পরিবারের ক্রন্দন। জেলখানা, থানা, পুলিশ, কোর্ট, কাচারিতে আটক পুরুষদের বাঁচাতে তদবিরে নেমে পরিবারের নারী সদস্যরা ঘাটে ঘাটে লাঞ্ছিত ও নিগৃহীত হয়। আর্থিক, সামাজিক, ব্যক্তিগত দিক থেকে একজন বা দুইজন নয়, অসংখ্য পরিবারের শত শত মানুষ বিপণ্ন ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সংঘাতে প্রাণহানির ক্ষতি টানতে গিয়ে আরও বহু মানুষ বিরাট ক্ষতির সম্মুখীন হতে থাকে। মৃত্যুর কষ্টের সঙ্গে এসে মিশে যায় পরবর্তী যন্ত্রণার মাতম।

গ্রামীণ সমাজ ব্যবস্থায় এবং ক্ষেত্র বিশেষে শহরেও এমন সংঘবদ্ধ শক্তির মহড়া সমাজকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে? সভ্য সমাজ ও আইনের শাসনের দাবি করা তখন কিভাবে সম্ভব হয়? প্রায়ই যে গ্রাম বা শহরে, এমন কি রাস্তায়, কোনও সমস্যা হলেই আলাপ-আলোচনার বদলে মারপিট ও সংঘাতে জড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে, জ্বালাও-পোড়াও করা হচ্ছে, তা কিসের আলামত? সব সময় যে বিরোধী পক্ষই এসব করছে, তথ্য তেমন বলে না। ক্ষমতার ভাগীদাররাও নিজের হাতে ক্ষমতা তুলে নিয়ে চরম অরাজকতার সৃষ্টি করছে। এতে সমাজের শান্তি, স্থিতি, নিরাপত্তার বারোটা বেজে যাচ্ছে। এই নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি তৈরি করে কে লাভবান হচ্ছে?

নিশ্চয় সাধারণ মানুষ এসব ঘটনায় উপকৃত হয় না। উপকৃত হয় মাফিয়া ও দুর্বৃত্তরা। এদের হাতে সকল কিছু চলে গেলে সুশাসনের কিছুই আর অবশিষ্ট থাকে না। প্রশাসনের নির্লিপ্ততা ও ইচ্ছা বা অনিচ্ছাকৃত ব্যর্থতা এই অরাজকতা ও নৈরাজ্যকে আরও প্রলম্বিত ও অসহনীয় করছে। এইসব ঘটনা মানুষের মধ্যে শক্তি প্রয়োগ করার প্রবণতা বাড়াচ্ছে। মানুষ উগ্র ও সশস্ত্র হয়ে একে অপরের দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। আইন ও নিয়মের তোয়াক্কা করছে না। আইন, প্রশাসন ও রাজনীতি হয়ে যাচ্ছে এই শক্তিমত্ত গোষ্ঠির অধীনস্থ।

শক্তির চর্চা ও শক্তির পূজা করার কুফল সমাজের নানা স্থানে প্রতিনিয়তই একটি-দুইটি করে দেখা যাচ্ছে। এই কুপ্রবণতা ক্রমে ক্রমেই বাড়ছে। কিছু হলেই আইন হাতে তুলে মারপিট বা রাস্তা-ঘাট বন্ধ করে জ্বালাও-পোড়াও করা হচ্ছে। এইসব খারাপ উদাহরণ সমাজ ও মানুষের মধ্যে শক্তিচর্চার মানসিকতা বাড়িয়ে পরিস্থিতিকে আরও অসহনীয় করে তুলছে। ক্রমশই যেন সবাই এই বলদর্পী গোষ্ঠির কাছেই জিম্মি হয়ে যাচ্ছে। কেউই জানে না, এই আদিম বর্বরতার শেষ কোথায়?

বিশেষত দেশের কেন্দ্র থেকে দূরপ্রান্তে অবস্থিত হাওরের নিভৃত ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে দিনে দিনে আধুনিকতা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ছোঁয়া লাগলেও সমাজ আর সংস্কৃতিতে বিরাজ করছে বন্যতা, উন্মত্ততা ও আদিম গোষ্ঠিতান্ত্রিক শক্তি প্রদর্শনের মদমত্ততা। সমাজের মধ্যে এহেন পশ্চাৎপদ হানাহানির ধারা চললে সেখানে উন্নয়ন ও অগ্রগতি বিশেষ কোনও কাজে আসবে না। বস্তু ও অবকাঠামোগত উন্নয়নের পাশাপাশি মানুষের মন ও মাননিকতার উন্নয়ন করা সম্ভব না হলে আদিম বর্বরতার রক্তাক্ত চিহ্ণ সহজেই মুছে যাবে না। কমবে না রক্ত, মৃত্যু আর লাশের মিছিল।