বঙ্গবন্ধুর বেড়ে ওঠা (পর্ব ৪)
বঙ্গবন্ধুর বেড়ে ওঠা (পর্ব ১)
বঙ্গবন্ধুর বেড়ে ওঠা (পর্ব ২)
বঙ্গবন্ধুর বেড়ে ওঠা (পর্ব ৩)
বঙ্গবন্ধু কারাগারে থাকা অবস্থায় আওয়ামী মুসলিম লীগের জন্ম হয়। এ প্রসঙ্গে অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে বঙ্গবন্ধু বলেছেন, “আমার সাথে যোগাযোগ করা হয়েছিল, আমার মত নেওয়ার জন্য। আমি খবর দিয়েছিলাম, আর মুসলিম লীগের পিছনে ঘুরে লাভ নাই, এ প্রতিষ্ঠান এখন গণবিচ্ছিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। এরা আমাদের মুসলিম লীগে নিতে চাইলেও যাওয়া উচিত হবে না। কারণ এরা কোটারি করে ফেলেছে। একে আর জনগণের প্রতিষ্ঠান বলা চলে না। এদের কোনো কর্মপন্থাও নাই। আমাকে আরো জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, আমি ছাত্র প্রতিষ্ঠান করব, না রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান গঠন হলে তাতে যোগদান করব? আমি উত্তর পাঠিয়েছিলাম, ছাত্র রাজনীতি আমি আর করব না, রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানই করব। কারণ বিরোধীদল সৃষ্টি করতে না পারলে এ দেশে একনায়কতন্ত্র চলবে।”
বঙ্গবন্ধু কারাগারে থাকাকালেই তাঁকে নবসৃষ্ট আওয়ামী মুসলিম লীগের অন্যতম যুগ্ম-সম্পাদক করা হয়। সাধারণ সম্পাদক করা হয় শামসুল হককে যিনি উপ-নির্বাচনে মুসলিম লীগের প্রার্থী খুররম খান পন্নীকে পরাজিত করে এমএলএ হয়েছিলেন। আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন হওয়ার কয়েকদিন পর বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দেওয়া হয়। জেল গেটে মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে আওয়ামী মুসলিম লীগ নেতাকর্মীরা বঙ্গবন্ধুকে বিরাট সম্বর্ধনা দেয়। সেখানে বঙ্গবন্ধুর বাবা শেখ লুৎফর রহমানও উপস্থিত ছিলেন। বঙ্গবন্ধু তাঁর বাবাকে এবং মাওলানা ভাসানীকে সালাম করেন।
নানারকমের বাধা বিপত্তি সত্ত্বেও মাওলানা ভাসানী ও বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত অল্প সময়ের মধ্যেই পূর্ববাংলার প্রতিটি জেলাতে আওয়ামী মুসলিম লীগের বিরাট কর্মীবাহিনী গড়ে তুলতে সক্ষম হলেন। তাঁরা কর্মীদের বোঝালেন, কিভাবে দ্রুত পূর্ববাংলা পশ্চিমপাকিস্তানের উপনিবেশ হতে চলেছে, কিভাবে বাংলা শোষিত হচ্ছে। ভাসানী-বঙ্গবন্ধু উল্কার মতো বাংলার পথে-প্রান্তরে-জনপদে ঘুরে বেড়ালেন। বঙ্গবন্ধু ১৯৪৯ সালের ১১ অক্টোবর মাওলানা ভাসানীকে নিয়ে প্রায় পঞ্চাশ হাজার লোকের ভুখামিছিলে নেতৃত্ব দেন। সে সময় বাজারে খাদ্যদ্রব্যের চড়াদামের প্রতিবাদে আরমানিটোলা ময়দানে মাওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে আওয়ামী মুসলিম লীগের এক বিরাট জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। প্রায় পঞ্চাশ হাজার লোকের মিছিলটি নাজিরাবাজার রেলক্রসিংয়ের কাছে এলে পুলিশ লাঠিচার্জ করে এবং কাঁদুনে গ্যাস নিক্ষেপ করে। পুলিশ মাওলানা ভাসানী এবং শামসুল হককে গ্রেফতার করে। পায়ে আঘাতপ্রাপ্ত বঙ্গবন্ধু প্রথমে পাশের নর্দমায় পড়ে যান। কর্মীরা তাঁকে রিকশায় তুলে মোগলটুলি পার্টি অফিসে নিয়ে গিয়ে তাঁর চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন।
মাওলানা ভাসানী বঙ্গবন্ধুর কাছে সংবাদ পাঠালেন, যেভাবেই হোক লাহোর গিয়ে সেখানে অবস্থানরত সোহরাওয়ার্দীকে পূর্ববাংলার রাজনৈতিক অবস্থা অবহিত করতে হবে। পূর্ববাংলার পুলিশের দৃষ্টি ফাঁকি দিয়ে বঙ্গবন্ধু অতিকষ্টে ১৯৪৯ সালের অক্টোবরের শেষদিকে লাহোর পৌঁছলেন। লাহোরে অবস্থানের সুযোগে বঙ্গবন্ধু পশ্চিমপাকিস্তানের রাজনীতিবিদ এবং সমগ্র পাকিস্তানের রাজনীতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত হন। বাঙালি যে পাকিস্তানের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক, সেটাও তিনি ওই সময় প্রথম উপলব্ধি করেন। বঙ্গবন্ধুর এই উপলব্ধি তাঁর রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনার ক্রমবিকাশে, বিশেষ করে তাঁর রাজনৈতিক আদর্শ ও লক্ষ্য বাঙালি রাষ্ট্রসাধনাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। তখন থেকেই ৬-দফার মতো একটা কিছু তিনি ভাবতে শুরু করেন। পশ্চিমপাকিস্তানি নেতাদের সাথে কথাবার্তা বলার ফলে এই ধারণা তাঁর মনে বদ্ধমূল হয়েছিল যে, পাকিস্তান পূর্ববাংলার মানুষের স্বাধীনতা আনেনি, বরং ব্রিটিশ প্রভুদের বদলে পাকিস্তানি প্রভুদের ঔপনিবেশিক দাসত্বে শৃঙ্খলিত করেছে, পরিণত করেছে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে।
লাহোরে বঙ্গবন্ধু প্রথম দুদিন মিয়া ইফতিখার উদ্দিনের বাড়িতে এবং পরে সোহরাওয়ার্দীর ব্যাবস্থাপনায় এক হোটেলে ছিলেন। সোহরাওয়ার্দীর মাধ্যমে অনেক পশ্চিমপাকিস্তানি নেতার সাথে বঙ্গবন্ধুর আলাপ-পরিচয় হয়। সীমান্ত প্রদেশ আওয়ামী মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক খান গোলাম মোহাম্মদ খান লুন্দখোর বঙ্গবন্ধুকে তার গাড়িতে করে রাওয়ালপিন্ডি, ক্যাম্বেলপুর, আটক প্রভৃতি স্থানে নিয়ে যান এবং রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সাথে আলাপ-পরিচয় করিয়ে দেন। সোহরাওয়ার্দী সাহেবের সাথেও বঙ্গবন্ধু কয়েকটি সভায় যোগ দেন। লাহোরেও গোয়েন্দা বিভাগের লোকেরা বঙ্গবন্ধুর অনুসরণ করতে থাকে।
লাহোরে অবস্থানকালে একদিন বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান টাইমস অফিস থেকে বেরিয়ে সোহরাওয়ার্দী সাহেবের কাছে হাইকোর্টে যাচ্ছিলেন। পথে চারজন যুবক হান্টার ও ছোরা নিয়ে বঙ্গবন্ধুকে আক্রমণ করে। একজন জিজ্ঞেস করে বাড়ি কোথায়। বঙ্গবন্ধু উত্তর দেন, “পূর্ব পাকিস্তানে।” তখন যুবকদের একজন বঙ্গবন্ধুর হাত, আরেকজন তাঁর জামা ধরে আক্রমণ করে এবং বলে, “তোম পাকিস্তান কা দুশমন হ্যায়।” একজন বঙ্গবন্ধুকে ঘুষি মারলে তিনি হাত দিয়ে আটকান। ইতোমধ্যে লোকজন এসে পড়লে তারা সরে পড়ে। বঙ্গবন্ধু হাইকোর্টে গিয়ে সোহরাওয়ার্দীকে ঘটনার বর্ণনা দেন। পরে খোঁজখবর নিয়ে দেখা যায় এ আক্রমণ করেছিল মুসলিম লীগের গুণ্ডারা।
প্রায় দেড়মাস লাহোরে অবস্থান করার পর বঙ্গবন্ধু পূর্ববাংলায় ফিরে আসতে চাইলে সোহরাওয়ার্দী সাহেব তাঁকে বলেন, “ঢাকায় পৌঁছার সাথে সাথেই তারা তোমাকে গ্রেফতার করবে। লাহোরে গ্রেফতার নাও করতে পারে।” বঙ্গবন্ধু বলেন, “এখান থেকেও গ্রেফতার করে আমাকে ঢাকায় পাঠাতে পারে। কারণ লিয়াকত আলী সাহেবও ক্ষেপে আছেন। পূর্ব বাংলার সরকার নিশ্চয়ই চুপ করে বসে নেই। তারা কেন্দ্রীয় সরকারকে খবর পাঠিয়েছে পাঞ্জাব সরকারকে হুকুম দিতে। সে খবর এসে পৌঁছাতেও পারে। এখানেও আমি তো চুপ করে নাই। তাই যা হবার পূর্ব বাংলায় হোক, পূর্ব বাংলার জেলে ভাত পাওয়া যাবে, পাঞ্জাবের রুটি খেলে আমি বাঁচতে পারব না। রুটি আর মাংস খেতে খেতে আমার আর সহ্য হচ্ছে না। আর জেলে যদি যেতেই হবে, তাহলে আমার সহকর্মীদের সাথেই থাকব।”
সে সময় সিএসএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ বঙ্গবন্ধুর কয়েকজন পূর্ববঙ্গের বন্ধু লাহোরের সিভিল সার্ভিস একাডেমিতে প্রশিক্ষণরত ছিলেন। বঙ্গবন্ধু তাদের সাথে দেখা করতে যান। এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে বলেছেন, “অনেকের সাথে দেখা হলো। একজন সরকারি দলের ছাত্রনেতা ছিলেন, তিনি বাংলা ভাষা আন্দোলনের বিরোধিতা করেছিলেন। আমার সাথে তার পরিচয় ছিল। আমাকে বললেন, ‘আপনি আমার কাছে চা খাবেন। কারণ আমি বুঝতে পেরেছি লাহোরে এসে, যে বাংলা ভাষার দাবি আপনারা করেছিলেন তা ঠিক ছিল, আমিই ভুল করেছিলাম। বাঙালিদের এরা অনেকেই ঘৃণা করে।’ আমি কোনো আলোচনা করলাম না সেখানে বসে, কারণ সেটা উচিত নয়।”
বঙ্গবন্ধু লাহোর থেকে বিমানে দিল্লি এবং সেখান থেকে ট্রেনে কলকাতা হয়ে খুলনা যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। সে সময় ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে যাতায়াতের জন্য পাসপোর্ট চালু হয়নি, তবে ভারতের ভেতর দিয়ে যাতায়াতের জন্য পারমিট নিতে হতো। মিয়া ইফতিখার উদ্দিনের চেষ্টায় বঙ্গবন্ধু সহজেই ভারতের ভেতর দিয়ে যাওয়ার পারমিট পেলেন। কিন্তু পারমিটে লেখা ছিল, ভারতে তিন দিনের বেশি থাকা যাবে না। তিন দিনের মধ্যে ভারত ত্যাগ করতে হবে। শহীদ সোহরাওয়ার্দী বঙ্গবন্ধুর লাহোরে অবস্থানকালীন হোটেলের বিল মিটিয়ে দিয়ে লাহোর-দিল্লি বিমানের টিকিট করে দিলেন এবং তাঁর হাতেও কিছু নগদ টাকা দিলেন।
সোহরাওয়ার্দী সাহেব নবাবজাদা জুলফিকারকে বললেন, বঙ্গবন্ধুকে বিমানে তুলে দিতে। কারণ তিনি খবর পেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুকে এয়ারপোর্টে গ্রেফতার করতে পারে। বঙ্গবন্ধুকে এয়ারপোর্টে গ্রেফতার করা হলে যাতে তিনি দ্রুত খবর পেতে পারেন, সেজন্যই নবাবজাদা জুলফিকারকে সাথে দেওয়া হয়। লাহোর এয়ারপোর্টে বঙ্গবন্ধুর মালপত্র আলাদা করে রাখা হয়। একজন কর্মচারী তাঁকে উপরের একটা ঘরে নিয়ে গিয়ে সেখানে বসতে বলে এবং কোথাও যেতে নিষেধ করে। তারা বঙ্গবন্ধুর পারমিট ভালোভাবে যাচাই করে এবং মালপত্রও ভালোভাবে তল্লাশি করে। অন্য যাত্রীদের একবার বিমানে উঠিয়ে আবার নামিয়ে নিয়ে আসে। নবাবজাদা জুলফিকার বঙ্গবন্ধুকে বলেন, “মনে হয় কিছু একটা করবে। প্লেন ছাড়ার সময় হয়ে গেছে, কিন্তু প্লেন ছাড়ছে না। আপনার ব্যাপার নিয়েই প্লেন দেরি করছে। মনে হয় উপরের সিদ্ধান্তের জন্য অপেক্ষা করছে।”
বঙ্গবন্ধু তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে এ ঘটনার বর্ণনায় বলেছেন, “এক ঘণ্টা পর প্লেন ছাড়ার অনুমতি দেওয়া হয় এবং আমাকে যেতে বলা হয়। আমি নবাবজাদার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে প্লেনে উঠলাম এবং তাকে অনুরোধ করলাম, সোহরাওয়ার্দী সাহেবকে ঘটনাটা বলতে। আমি বুঝতে পারলাম, আমাকে যেতে দিবে না আটক করবে এই নিয়ে দেরি করছে। বোধহয় শেষপর্যন্ত দেখল, বাংলার ঝঞ্ঝাট পাঞ্জাবে কেন? তিন দিনের মধ্যেই ভারত ত্যাগ করতে হবে। পূর্ব বাংলা সরকারকে খবর দিলেই আমাকে হয় দর্শনায়, নয় বেনাপোলে গ্রেফতার করতে পারবে। আমি যে ভারতবর্ষে থাকতে পারব না, এ কথা পারমিটে লেখা আছে।” [চলবে]