ড্রেস রিহার্সেলে আওয়ামী লীগের স্বরূপ উন্মোচিত: ড. মঈন খান
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী ড. আব্দুল মঈন খান বলেছেন, বিএনপিতে কোনো নেতৃত্বের সংকট নেই। তিনি বলেন, শীর্ষ নেতাদের কারা অন্তরীণ করলেও জনগণের মধ্য থেকেই দলটির নতুন নেতৃত্ব উঠে আসবে। ড. খান আরও উল্লেখ করেছেন, বিএনপি সত্যিকারের নির্বাচনে জনগণের মুখোমুখি হতে ভয় পায় না। বরং ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগই সুষ্ঠু নির্বাচনে যেতে ভয় পায়, যার জন্য তারা প্রহসনের নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি নিচ্ছে।
বিএনপির এই জ্যেষ্ঠ নেতা চিহ্নিত করে বলেছেন, আসন্ন জাতীয় নির্বাচন কেমন হবে তা সদ্য অনুষ্ঠিত দু’টি উপ-নির্বাচন দেখেই বোঝা যাচ্ছে। এই দু’টি উপ-নির্বাচনকে আওয়ামী লীগের ‘ড্রেস রিহার্সেল’ উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, আওয়ামী লীগ আস্থা অর্জনের শেষ সুযোগটিও হারিয়েছে। তাদের স্বরূপ উন্মোচিত। বিএনপি এ ধরণের ধাপ্পাবাজির সাজানো নির্বাচনে যাবে না।
চলমান রাজনৈতিক সংকট ও বিএনপি-র অবস্থান নিয়ে অনলাইন নিউজ পোর্টাল বার্তা২৪.কম-কে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেছেন ড. আব্দুল মঈন খান। কথা বলেছেন পরিকল্পনা সম্পাদক আশরাফুল ইসলাম।
বার্তা২৪.কম: বিদ্যমান যে রাজনৈতিক অবস্থা, আপনার দলের শীর্ষ নেতারা কারা অন্তরীণ। জনমনে প্রশ্ন বিএনপি কি আদৌ কোন নেতৃত্ব সংকটে ভুগছে?
ড. আবদুল মঈন খান: দেশের অনেক মানুষের মনেই হয়তো এই প্রশ্ন জেগে থাকতে পারে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে এই - বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল এমন একটি রাজনৈতিক দল যে দলের মূলমন্ত্রটির উন্মেষ হয়েছিল জনগণের অধিকার রক্ষার ধ্যান ধারণা থেকে। যে কারণে বিএনপিতে আমরা শিখেছি, ব্যক্তির চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে দেশ বড় । আজকে এ প্রসঙ্গে সংক্ষেপে প্রথমে একটি কথা বলব। সেটা হচ্ছে বিএনপির মতো রাজনৈতিক দল শুধু নয়, যে কোনো রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব যেমন রাতারাতি গড়ে উঠে না ঠিক তেমনি একটি রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বও কিন্তু রাতারাতি ধ্বংস করা যায় না। কাজেই নেতৃত্ব শূন্যতার যে সংশয়টি আপনি উল্লেখ করেছেন - আমার সন্দেহ নেই দেশের অনেক মানুষের মনেই হয়তো এ ধরণের সংশয় তৈরি হতে পারে, আজকে সরকারি দল হয়তো আনন্দিতও হতে পারে যে তারা বিএনপির নেতৃত্বকে শূন্যতে নিয়ে গিয়েছে - কিন্তু এটা আসলে তাদের একটা দুরাশা মাত্র। বাস্তবতা হচ্ছে এই, বিএনপির শিকড় কিন্তু জনগণের মধ্যে প্রোথিত, এবং সেটা তৃণমূল জনগণের হৃদয়ের অনেক গভীরে। আসলে বিএনপি’র চালিকা শক্তিই হচ্ছে জনগণ এবং সে কারণেই শত বাধা বিপত্তির মুখেও নেতৃত্বহীনতার কোন প্রশ্ন বিএনপি'র বেলায় প্রযোজ্য নয়। আর আওয়ামী লীগের সঙ্গে সেটাই হচ্ছে বিএনপির প্রভেদ। আওয়ামী লীগের শক্তি আমরা যেটা দেখেছি সেটা হচ্ছে, তারা তাদের সাংগঠনিক সামর্থ্য নিয়ে গর্ব করে থাকে, আমি এটা অস্বীকার করছি না; কিন্তু এটা দুঃখজনক যে, সেই চেইন অব কমান্ডের নির্দেশে তাদের সংগঠন আজকে রাজপথে নেমেছে সন্ত্রাস করার জন্য। এবং রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের সঙ্গে দলীয় সন্ত্রাস একত্রিত হয়ে তারা আজকে এদেশে বিরোধী দলকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে চায়.. কেবল বিরোধী দলকে নিশ্চিহ্ন করতে চায় তাই নয় তারা একই সঙ্গে যে আদর্শটি নিশ্চিহ্ন করেছে সেটা হচ্ছে বাংলাদেশের গণতন্ত্র। তারা অতীতে একবার চেষ্টা করেছিল বাকশাল গঠন করে বাংলাদেশের মানুষের কথা বলার স্বাধীনতা, মানুষের মৌলিক অধিকার সবকিছু হরণ করতে। কিন্তু এদেশের মানুষ তাদের সেই অপচেষ্টাকে প্রতিহত করেছিল। পরিতাপের বিষয়, আওয়ামী লীগ আজকে আবার অলিখিত বাকশাল কায়েম করে ঠিক একই কাজ দ্বিতীয়বার করতে চাচ্ছে।
কিন্তু অবাক হওয়ার কিছু নেই, তাদের সেই প্রচেষ্টা বাংলাদেশের জনগণের অন্তরের ইচ্ছার কাছে একবার পরাজিত হয়েছিল এবং আজকে দ্বিতীয়বার তাদের এই দুরাশা - বাংলাদেশের মানুষের গণতন্ত্র হরণের দুরাশা - অতি শিগগির তিরোহিত হবে এটাই আমাদের বিশ্বাস। এই বিশ্বাসের কারণ হচ্ছে যে আমরা জনগণের শক্তিতে বিশ্বাস করি। আমরা সরকারের, প্রশাসনের কিংবা পুলিশ প্রশাসনের শক্তিতে বিশ্বাসী নই। রাইফেলের শক্তিতে বিশ্বাসী নই, টিয়ার গ্যাসের শক্তিতে বিশ্বাসী নই, গণতন্ত্রের শক্তিতে বিশ্বাসী। এখানে আরও যা ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন সেটা হচ্ছে এই গণতন্ত্রই যদি না থাকে, তাহলে কিন্তু বাংলাদেশই থাকে না। আমরা পাকিস্তানের অবকাঠামোর ভেতরে একটি সত্য উপলব্ধি করেছিলাম। সেই সত্যটি কি? তা হল, পাকিস্তান এমন একটি মানসিকতায় সৃষ্টি সেখানে কোন দিন গণতন্ত্র বিকশিত হতে পারে না। এই সত্য বাংলাদেশের তৃণমূলের মানুষ উপলব্ধি করেছিল বলেই জীবনের মায়া ত্যাগ করে তারা মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। লাখ লাখ মানুষ তাদের বুকের রক্ত ঢেলে দিয়েছিল এবং তারা এই প্রতিজ্ঞা করেছিল, ‘জীবন যাবে কিন্তু গণতন্ত্র যাবে না’। আজকে স্বাধীনতার ৫২ বছর পরে এসে একি লজ্জা ও কলঙ্ক । পরিতাপের বিষয়, স্বাধীনতার পক্ষের শক্তির দাবিদার বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার গণতন্ত্রকে বিসর্জন দিয়েছে, এটা কোন দিন হতে পারে না যদি আওয়ামী লীগ সত্যিই স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি হত । পাশাপাশি বিএনপি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের একজন সেক্টর কমান্ডার শহীদ বীর উত্তম জিয়াউর রহমান নেতৃত্বে। আমরা মুক্তিযুদ্ধে বিশ্বাস রেখেই আমরা বিএনপি সৃষ্টি করেছি। এবং সেই কারণেই বলছি আপনারা যে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন সেটা কোন দিনও হতে পারে না। বিএনপি নেতৃত্ব শূন্য হতে পারে না। এই বিএনপি ছিল, আছে, থাকবে। বিএনপির নেতৃত্ব যদি শূন্য কেউ করে দেয় অন্যায়ের মাধ্যমে, তাহলে জনগণের মধ্য থেকে নতুন নেতৃত্ব গড়ে উঠবে, ঠিক যেমনটি আপনারা আজকের পরিস্থিতিতে অবলোকন করছেন।
বার্তা২৪.কম: এতো গেল সার্বিক মূল্যায়ন...যদি সুনির্দিষ্টভাবে বলি দলের সব কর্মসূচিই ভার্চুয়ালি ঘোষণা করা হচ্ছে। এতে কি কোন দ্বিধাদ্বন্দ্ব তৈরি করতে পারে কিংবা দলের ভাঙন ত্বরান্বিত করতে পারে?
ড. আবদুল মঈন খান: আপনি বর্তমান বাস্তবতার নিরিখে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। দেখুন আপনি নিজেই বলছেন এবং আমিও সেটা স্বীকার করছি...আমাদের মহাসচিবকে মিথ্যা মামলায় কারারুদ্ধ করে রেখেছে..একে একে আমাদের একাধিক স্থায়ী কমিটির সদস্যদের কারা অন্তরীণ করে রেখেছে, আমাদের ভাইস-চেয়ারম্যানদের কারারুদ্ধ করেছে, আমাদের সাংগঠনিক গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের কারারুদ্ধ করে রেখেছে, জেলা কমিটির সভাপতি-সম্পাদকদের কারারুদ্ধ করে রেখেছে; আমি যদি পাল্টা প্রশ্ন করি তাতে করে কি সরকার আমাদের আন্দোলনকে বন্ধ করতে পেরেছে? পারেনি। বিএনপি'র বাস্তবতা হচ্ছে, আমাদের দলের অভ্যন্তরীণ যে স্ট্রাকচার বা গঠন পদ্ধতি রয়েছে সেটা এমনি একটি স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা যখন আমার ওপরের নেতৃত্ব যখন চলে যাবে, আমি তখন সেই ঝাণ্ডা নিয়ে দাঁড়িয়ে যাব। আপনারা দেখেছেন, আজকে ১০ দিন অতিবাহিত হয়ে গেছে, আজকেও কিন্তু আমরা অবরোধ পালন করে যাচ্ছি। ঢাকা থেকে দূরপাল্লার বাসগুলি কিন্তু আজও ছেড়ে যায়নি। মিডিয়াকর্মীরা যে খবর আজ তুলে ধরেছে সেখানে একজন বাস মালিক বলেছেন, কাকে নিয়ে বাস চালাব? সারাদিনে একজন মাত্র যাত্রী এসেছেন। এতে প্রমাণিত হয়, আজকে আমরা সরকারের গণতন্ত্র হরণের এবং বাংলাদেশের মানুষের কথা বলার অধিকার, যারা খেটে খায় যারা সত্যিকার্থে দেশ গড়ে তুলছে, তারা বিদেশে অর্থপাচার করে না, তারা ৫ বছরে একবার নিশ্চিন্তে ভোট দিতে চায়...তারা উপলব্ধি করেছে, আজকে যে সংগ্রাম তা কেবল বিএনপি'র সংগ্রাম নয়..বিএনপি ক্ষমতায় যাবে সে কারণে আজকে অবরোধ বা হরতাল দিচ্ছে না। আন্দোলন হচ্ছে জনগণের অধিকার ফিরিয়ে আনার জন্যে। গত এক বছর যাবত আমরা শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালন করে আসছি একটি মহৎ উদ্দেশ্যে। বাংলাদেশের মানুষের মৌলিক অধিকার এই অধিকার মানুষের কাছে ফিরিয়ে দেব। যাদের ভোটের অধিকার তাদের কাছে পৌঁছে দেব। এটাই কি সাধারণ মানুষের মধ্যে বড় চাওয়া নয়? ৫ বছর অন্তরে একবারের জন্য নিশ্চিন্তে নির্বিঘ্নে ভোট দিবে। মানুষের সাইকোলজিই হচ্ছে এই। তারা মনে করছে, তারা তাদের ভোট দিতে পারছে না, বাংলাদেশের মানুষের ভোটের সরকার হরণ করা হয়েছে। আজকের যে সময়, এই সময় বিএনপি ক্ষমতায় যাবে সে কারণে সংগ্রাম নয় ...আমরা এই আন্দোলন পরিচালনা করেছি একটি দেশের মানুষের ভোটের অধিকার তাদের কাছে ফিরিয়ে দেব। সাধারণ মানুষের কাছে কি এটি বড় চাওয়া নয়? মোগল সাম্রাজ্যের সময় থেকে দেখুন, বাংলাদেশকে তারাও পুরোপুরি পদানত করতে পারেনি। তাই আজকে নেতৃত্ব বড় প্রশ্ন নয়। বড় কথা মানুষের ন্যায়সঙ্গত অধিকার। তাই এই সংগ্রাম জণগণের আন্দোলনে রূপ পেয়েছে। যতক্ষণ না মানুষের এই মৌলিক অধিকার ফিরিয়ে দিতে পারছি, ততক্ষণ আমাদের আন্দেলন চলবে। পাশাপাশি, এই মুহূর্তে চ্যালেঞ্জের মুখে দলে ভাঙনের বিপরীতে বরঞ্চ নবীন শক্তির সঞ্চার হয়েছে।
বার্তা২৪.কম: দেশের সাধারণ মানুষ, একেবারের প্রান্তিকদেরও জিজ্ঞাসা, বিএনপি কি আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে শেষ অবধি যাচ্ছে?
ড. আব্দুল মঈন খান: অনেক দেশি-বিদেশি মিডিয়াই আমাকে এই প্রশ্ন করেছেন, আমি প্রাঞ্জল ভাষায় এই প্রশ্নের উত্তর দিতে চাই। অনেকে প্রশ্ন করেন বিএনপি কেন নির্বাচনে যেতে চাচ্ছে না? বিএনপি কেন নির্বাচন বিরোধী? বিএনপি কেন নির্বাচন বর্জন করছে? আপনারা যারা এসব কথাগুলো বলছেন তারা সম্পূর্ণ ভুল কথা বলছেন। বিএনপি কোন দিন নির্বাচন বিরোধী নয়। বিএনপি কোন দিন বলেনি তারা আগামী নির্বাচনে যাবে না। কোনদিন বিএনপি বলেনি, তারা আগামী নির্বাচন বর্জন করবে। বিএনপি বলেছে, আগামীতে যদি ২০১৪ ও ২০১৮ সালের মতো সাজানো ভুয়া নির্বাচন হয়, তাহলে বিএনপি সেই নির্বাচনে কোন অবস্থাতেই অংশগ্রহণ করবে না। বিএনপি নিশ্চয়ই নির্বাচনে যাবে, বিএনপি নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের মুখোমুখি হতে ভয় পায় না, যে ভয়টা আজকে আওয়ামী লীগ পাচ্ছে। এবং এটা অত্যন্ত স্পষ্ট, আওয়ামী লীগ যেটা চাচ্ছে সেটা হচ্ছে তারা নির্বাচনের নামে একটা প্রহসন করতে। যে প্রহসনের মাধ্যমে তারা ভুয়া নির্বাচন দেখিয়ে..একটি সাজানো নির্বাচনের মাধ্যমে একটি সাজানো সংসদ ইচ্ছে মতো গড়ে তুলবে। যে নির্বাচন তারা ইতিপূর্বে করেছে, তার উদাহরণ ৫ নভেম্বর অনুষ্ঠিত (২০২৩) দুটি উপ-নির্বাচন আপনারা দেখেছেন। ৫ নভেম্বর উপনির্বাচনে যে ঘটনা সেটা হচ্ছে-আগামী নির্বাচনের জন্য আওয়ামী লীগ সরকারের ড্রেস রিহার্সেল। সেই ড্রেস রিহার্সেল তারা সম্পন্ন করেছে এবং এভাবেই তারা আগামী সাধারণ নির্বাচন করতে চায়। আওয়ামী লীগ আস্থা অর্জনের শেষ সুযোগটিও হারিয়েছে। তাদের স্বরূপ আজ নতুন করে উন্মোচিত। বলাবাহুল্য, বিএনপি এ ধরণের নির্বাচনে..ধাপ্পাবাজির সাজানো নির্বাচনে যাবে না। সে কারণেই আজকে জনগণকে সম্পৃক্ত করে-জনগণকে আস্থায় নিয়ে, জনগণের সহযোগিতায় জনগণের সরকার গঠন করার জন্য বিএনপি সংগ্রাম চালিয়ে যাবে…নিজেদের ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য নয়।