যে কারণে বিএনপির 'আন্দোলন' রূপ নিল 'বিচ্ছিন্ন নাশকতা'য়
২৮ অক্টোবরের স্মরণকালের বিশাল জনসমাবেশের এক মাসের মাথায় বিএনপির 'আন্দোলন' রূপ নিয়েছে জনসম্পৃক্তি বিহীন 'বিচ্ছিন্ন নাশকতা'য়। আন্দোলন থেকে ছিটকে পড়ছেন নেতাকর্মীরা। কল্যাণ পার্টির জেনারেল ইবরাহিমের মতো তীক্ত ও বাস্তব স্বীকারোক্তি প্রকাশ্যে অনেকেই না দিলেও, মাঠের বাস্তবতায় বিএনপি ও সমমনা দলগুলো 'আন্দোলনে কুলাতে' পারছে না। কেন বিএনপির 'আন্দোলন' রূপ নিল 'বিচ্ছিন্ন নাশকতা'য়, এই প্রশ্নের মুখোমুখি না হয়ে এবং আত্মসমালোচনা না করে আজ রোববার (২৬ নভেম্বর) থেকে আবারও বিএনপিসহ সমমনা দলগুলোর সপ্তম দফার অবরোধ শুরু করেছে।
গত এক মাসে থেমে থেমে দেওয়া শ্লথগতির আন্দোলনে বিএনপি হাতিয়ার হিসাবে যে অবরোধ ও হরতাল কর্মসূচি প্রয়োগ করেছে, তাতে তারা তাদের দাবি আদায়ের পথে বিন্দুমাত্র অগ্রসর হতে পারেনি। সরকার ন্যূনতম চাপ বোধ করেনি। নির্বাচনের পথে নির্বিঘ্নে এগিয়ে চলেছে। জনগণের পক্ষ থেকেও অবরোধ বা হরতালের পক্ষে সামান্যতম অংশগ্রহণ পরিলক্ষিত হয় নি। সবকিছুই চলছে স্বাভাবিক গতিতে।
পক্ষান্তরে, খোদ বিএনপি পড়েছে বেকায়দায়। আন্দোলনে তাদের লাভ হচ্ছে না। সরকার আন্দোলনের গায়ে বিচ্ছিন্ন নাশকতার লেবেল দিয়েছে। ফলে দলের ওপর বাড়ছে নানামুখী চাপ। যেমন:
১. ২৮ অক্টোবর মহাসমাবেশে সংঘর্ষকে কেন্দ্র করে দলটির একডজন শীর্ষ নেতাসহ ১৫ সহস্রাধিক নেতাকর্মীকে গ্রেফতার হয়েছে একমাসে।
২. গ্রেফতারের পর কর্মী ও নেতাদের দফায় দফায় নেয়া হচ্ছে রিমান্ডে।
৩. দীর্ঘ এক মাস ধরে অব্যাহতভাবে বাসায় বাসায় চলছে পুলিশি অভিযান। নেতাদের না পেয়ে গ্রেফতার করা হচ্ছে পরিবারের স্বজন, ব্যক্তিগত সহকারী, গাড়িচালককে।
৪. জেলায় জেলায় নেতাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর ও লুটপাট চলছে। সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে কোণঠাসা হয়ে পড়েছে বিএনপির জনশক্তি।
৫. একই সাথে পুরনো রাজনৈতিক মামলায় দেয়া হচ্ছে সাজা। যারা আগামীতে সংসদ নির্বাচন করবেন কিংবা মাঠে কর্মীদের ওপর প্রভাব রয়েছে- এমন নেতাদের টার্গেট করা হচ্ছে।
৬. গত এক সপ্তাহে বিএনপি’র ৪ শতাধিক নেতাকর্মীকে বিভিন্ন মেয়াদে দেয়া হয়েছে কারাদণ্ড।
৭. টার্গেট করা হয়েছে বিএনপি’র নিষ্ক্রিয়, বহিষ্কৃত ও দলছুট নেতাদেরও। তাদের দেয়া হচ্ছে নানা প্রলোভন ও নির্বাচনে যাওয়ার টোপ। অনেককে করা হচ্ছে তল্লাশি-হয়রানি।
সরকারের চাপের মুখে বিএনপি’র দলছুট ও নিষ্ক্রিয় কিছু নেতা ইতিমধ্যে নির্বাচনে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। যুগপৎ আন্দোলনে থাকা সমমনা জোটের দুই-একটি দলও একই ঘোষণা দিয়েছে।
বস্তুতপক্ষে, দীর্ঘবছর ক্ষমতায় থাকা একটি দলকে ক্ষমতাচ্যুত করতে যে শক্তি ও প্রস্তুতি থাকা দরকার ছিল, বিএনপি তা কার্যক্ষেত্রে দেখাতে পারে নি। হুঙ্কার দিয়ে চুপসে যাওয়া বিএনপি এখন রয়েছে কঠিন বিপদে। দলটি না পারছে আন্দোলন চালিয়ে যেত, না পারছে আন্দোলন ছেড়ে নির্বাচনে আসতে। স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে:
১. কেন আন্দোলনে বিএনপি দৃশ্যত ব্যর্থ হলো?
২. বিএনপির তাৎপর্যহীন আন্দোলনের শেষ পরিণতি কী হতে পারে?
এসব প্রশ্নের প্রধান কারণ নিহিত রয়েছে খোদ বিএনপির মধ্যেই। কারণ, বিএনপি একটি নির্বাচনমুখী দল। দলের নেতাকর্মীরা নির্বাচনে সরব হতে পারঙ্গম। অতীতে সবসময়ই দল না চাইলেও বহু নেতা নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন। বিএনপি তার নির্বাচনমুখী জনশক্তিকে আন্দোলনমুখী করতে পারে নি।
দলের শীর্ষ নেতারাও বড় বড় কথা বললেও আন্দোলনের কৃতিত্ব দেখাতে পারেন নি। তারা কেউই মাঠ, ময়দান বা মিছিল থেকে গ্রেফতার হন নি। পালিয়ে গিয়ে বাড়ি থেকে বা আত্মগোপনে থাকতে থাকতে এক পর্যায়ে পুলিশের জালে আটক হয়েছেন। নেতাদের এই শিক্ষা গ্রহণ করেছে কর্মীরা। তারাও অধিকাংশ চলে গেছেন আত্মগোপনে। ফলে মাঠেময়দানে বিএনপির আন্দোলন চালানোর মতো জনশক্তির উপস্থিতি নেই। বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা ঘটছে বটে। তবে সেগুলো আন্দোলন নাকি নাশকতা, তা নিয়ে বিতর্ক হচ্ছে।
ফলশ্রুতিতে ২৮ অক্টোবর হতে ২০ নভেম্বর (সোমবার) পর্যন্ত ২৪ দিনে উচ্ছৃঙ্খল জনতার দেওয়া আগুনে ১৮৫টি যানবাহন ও ১৫টি স্থাপনা পোড়ানোর ঘটনা ঘটেছে। সবচেয়ে বেশি গাজীপুরে, উপজেলা হিসেবে বগুড়া সদরে আগুনের ঘটনা ঘটেছে। এগুলোকে সরকারের পক্ষে জনবিচ্ছিন্ন নাশকতার তকমা দেওয়া হচ্ছে।
গত এক মাসের আন্দোলনের ফলাফল পর্যালোচনায় বিএনপির কী লাভ হলো তা দৃশ্যমান নয়। বিএনপি দাবি আদায়ের পথে একচুল পরিমাণ এগিয়েছে বলা যাবে না। দলটি যেখানে ছিল, তারচেয়ে আরও কোণঠাসা হয়েছে বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। তারপরেও সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ে বিএনপি গভীর চিন্তিত হয়ে পর্যালোচনা করছে বলে মনে হয় না। ফলহীন হবে জেনেও আবার আরেক দফা অবরোধ দিয়েছে দলটি। বিএনপির সাথে সমমনা জোটের শীর্ষ নেতারাও আছেন। তারা হয়ত মনে করছেন, কিছু লোক দল ছেড়ে চলে গেলেও চলমান আন্দোলনে তেমন প্রভাব পড়বে না। এ ছাড়া এসব দল নির্বাচনে অংশ নিলেও সরকার বৈধতা পাবে না। বিএনপি’র সঙ্গে থাকা সমমনা শরিক দল ও জোটগুলো যুগপৎভাবে আন্দোলন চালিয়ে যাবে। এ ছাড়া যুগপৎ আন্দোলনে থাকা ৩৬টি দলের বাইরে থাকা জামায়াত, ইসলামী আন্দোলনসহ বেশ কয়েকটি ইসলামী দলও নির্বাচনে না যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে।
আন্দোলনের পাশাপাশি নির্বাচনের প্রস্তুতি থাকলে বিএনপির জন্য ভালো হতো নাকি একতরফা আন্দোলন করতে করতে ক্ষয়িষ্ণু হয়ে যাওয়া ভালো হয়েছে, সে প্রশ্নের উপর এখনই পাওয়া যাবে না। সামনের দিনগুলোতে এসব প্রশ্নের মীমাংসা হবে। একই সঙ্গে বাংলাদেশের রাজনীতি ও বিএনপির রাজনৈতিক ভাগ্যও নির্ধারিত হবে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে আসন্ন দিনগুলোতে।