নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক দেখানো গেলেও কী সহিংসতা ঠেকানো যাবে?

  • নজরুল ইসলাম, নিউজরুম এডিটর, বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

দুয়ারে কড়া নাড়ছে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। আর মাত্র ৩৫ দিন পর আগামী ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হবে নির্বাচন। এ নির্বাচনকে ঘিরে যেমন রয়েছে উৎসাহ উদ্দীপনা, তেমনি রয়েছে উৎকণ্ঠাও। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ টানা চতুর্থবারের মত সরকার গঠনের লক্ষ্য নিয়ে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। এদিকে বিএনপি ও সমমনা দলগুলোর এক দফা দাবি পূরণ না হওয়ায় তারা নির্বাচনে আসছে না।    

সংসদ নির্বাচন নিয়ে দেশের রাজনৈতিক দলগুলো দু'ভাগে বিভক্ত, একপক্ষ আসন্ন নির্বাচনকে বর্জন করে নির্বাচনে না যাওয়ার প্রতিজ্ঞা করেছে অপর পক্ষ ক্ষমতাসীনদের অধীনে নির্বাচনকে স্বাগত জানিয়েছে। রাজনৈতিক দলের ন্যায় বাংলাদেশের সংসদ নির্বাচন নিয়ে বিশ্ব মোড়লরাও দুইভাগে বিভক্ত। গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের প্রশ্ন তোলে পশ্চিমা শক্তিধর রাষ্ট্র যুক্তরাষ্ট্র দেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের তাগিদ দিচ্ছে। এরই মধ্যে গণতন্ত্রে বাধা দানকারীদের ভিসা নিষেধাজ্ঞার আওতায় নিয়ে আসার ঘোষণা দিয়ে রেখেছে দেশটি। তাদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কথা বলছেন অন্যান্য মিত্র দেশসমূহ।

বিজ্ঞাপন

ভিন্ন অবস্থানে রয়েছে প্রতিবেশী অপর শক্তিধর দেশ ভারতসহ চীন ও রাশিয়া। বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে পশ্চিমাদের এমন তৎপরতাকে দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ বলছে চীন ও রাশিয়া। 

দলীয় সরকারের অধীনে ২০১৪ সালের নির্বাচনে অংশ নেয়নি বিএনপিসহ তাদের মিত্ররা। ফলে সে নির্বাচনে ১৫৩ জন সংসদ সদস্য বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়। এরপর ২০১৮ সালের নির্বাচনে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে ঐক্যফ্রন্ট গঠন করে নির্বাচনে আসে বিএনপিসহ বিরোধীরা। এ নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ তুলে ভোট বর্জন করেন বিএনপির অনেক প্রার্থী। ৭ আসনে জয় পেয়ে সংসদেও যায় বিএনপি। শেষ পর্যন্ত তারাও সংসদ থেকে বের হয়ে এসে আওয়ামী লীগ সরকারের পদত্যাগ চেয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবির আন্দোলন জোরদারের চেষ্টা করেন।

বিজ্ঞাপন

এমতাবস্থায় দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ না হলে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার হুমকিসহ যারা সুষ্ঠু নির্বাচনে বাধা দিবে তাদের জন্য অগ্রীম ভিসা নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রেখেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন না হলে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞাসহ কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার হুশিয়ারি দিচ্ছে পশ্চিমা দেশ সমূহ। বিষয়টি নিয়ে সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, সরকারি দলের নেতারাসহ খোদ নির্বাচন কমিশনও চিন্তিত।

বিএনপি ও সমমনারা নির্বাচনে না আসায় তাদের ছাড়া কিভাবে অংশগ্রহণমূলক, সুষ্ঠু দেখানো যায় তা ঠিক করেছে আওয়ামী নীতি নির্ধারকরা। এ জন্য বিএনপি থেকে যারা নির্বাচনে অংশ নিতে চায় তাদের স্বাগত জানিয়েছে দলটি। এর বাইরে অন্যান্য দলকেও কাছে টানছে সরকার। এছাড়া ভোটের দিন ভোটার উপস্থিতি বাড়াতে দলের মনোনয়নবঞ্চিতরা ‘স্বতন্ত্র প্রার্থী’ হলে বাধা দেওয়া হবে না-এমন ইঙ্গিত আসার পর জেলায় জেলায় নৌকার বিরুদ্ধে ভোট করতে মনোনয়ন জমা দিয়েছে আওয়ামী লীগ নেতারা। এদের মধ্যে মনোনয়ন না পাওয়া বর্তমান সংসদ সদস্য যেমন আছেন, তেমনি আছেন কেন্দ্রীয় নেতারাও। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, অধিকাংশ আসনেই স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোয়নপত্র জমা দিয়েছেন আওয়ামী লীগের মনোনয়নবঞ্চিতরা; অনেক আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী একাধিক।

বিভিন্ন জেলায় খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নিজের অনুসারীদের নিয়ে প্রকাশ্যে নৌকার মনোনিত প্রার্থীর বিপক্ষে অবস্থান নিচ্ছেন স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। যদিও তাদেরকে ডামি প্রার্থী বলা হচ্ছে কিন্তু তারা কেউ কাউকে ছাড় দিতে নারাজ। এতে তৃণমূল আওয়ামী লীগে দল, উপদলে বিভক্ত হয়ে পড়ছে। সংসদ নির্বাচন ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে এসব বিরোধ প্রকাশ্যে আসতে শুরু করেছে। এর আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থীর বিপক্ষে স্বতন্ত্র হয়ে নির্বাচন করে শাস্তির মুখে পড়েছে অনেকে। সে সময় শাস্তির ভয়ে অনেক আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী স্বতন্ত্র প্রার্থীর হয়ে কাজ করেনি। এসব নির্বাচনে সারা দেশেই আওয়ামী লীগের দুই পক্ষের মধ্যে সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। 

এমতাবস্থায় বিভিন্ন জেলায় আওয়ামী লীগের দলীয় কোন্দল স্পষ্ট হতে শুরু করেছে। জেলা, উপজেলায় দলীয় শীর্ষ পদে থাকা নৌকা বঞ্চিতরা স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন। অনেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে জেলা-উপজেলা চেয়ারম্যানের পদও ছেড়েছেন। এতে অনুসারীদের নিয়ে বিভক্ত হয়ে পড়েছেন বিভিন্ন আসনের নেতারা।

যেহেতু দলীয় পদে থেকে ডামি প্রার্থী হিসেবে স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচন করতে বাধা নেই, তেমনি দলীয় পদে থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থীর হয়ে কাজ করতেও দল থেকে বাধা দেওয়া হবে না এমনটাই ভাবছে তৃণমূলের নেতাকর্মীরা। বিভিন্ন আসনে ছাড় না দেওয়ার কথাও জানিয়েছেন নৌকাবঞ্চিতরা।

ইসি জানায়, দ্বাদশ নির্বাচনে ৩০০ সংসদীয় আসনে ৩০ টি নিবন্ধিত দলের ১৯৬৬ জন প্রার্থী মনোনয়ন দাখিল করেছে। এছাড়া অধিকাংশ আসনে মোট স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছে ৭৪৭ জন। এদের মধ্যে বর্তমান জেলা-উপজেলা ৫৪ জন চেয়ারম্যান নৌকার বিপক্ষে ভোটে লড়বেন বলে জানা গেছে। স্বতন্ত্র প্রার্থীদের ডামি বলা হলেও মাঠ না ছাড়ার কথা বলছেন অনেকে।  

এমন পরিস্থিতিতে নিজ দলের মধ্যে সহবস্থান বজায় রেখে শান্তিপূর্ণ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্পন্ন করাটাই মূখ্য বিষয়।

এ বিষয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) এর সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, নির্বাচনে শুধু প্রার্থীরা অংশগ্রহণ করলেই পুরো নির্বাচন ‍সুষ্ঠু নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য বলা যাবে না। ২০১৮ সালের নির্বাচনে সবাই অংশগ্রহণ করেছিল সেটাকে কি গ্রহণযোগ্য বলা হয়েছিল? সেটাও গ্রহণযোগ্য হয়নি। তারা নিজেদের পছন্দের প্রতিদ্বন্দ্বি প্রার্থী নিয়ে নির্বাচন করবে সেটা গ্রহণযোগ্য হবে না।

তিনি বলেন, নির্বাচনে তারা নিজেরা যেভাবে প্রার্থী হচ্ছে সেখানে একটা সংঘাতের সম্ভাবনা আছে। তবে এটা তাদের কৌশলের অংশ। দ্বন্দ্ব সংঘাত এড়ানোর জন্য তারা কি ব্যবস্থা রেখেছে এটা তারাই বলতে পারবে।

জামালপুর জেলার পাঁচ আসনের মধ্যে বর্তমান এমপিসহ আওয়ামী লীগের ১০ জন স্বতন্ত্র প্রার্থীর মনোনয়ন দাখিল করেছেন। এদের মধ্যে কেউ কাউকে ছাড় দিতে নারাজ। তবে দল থেকে সরে দাঁড়ানোর জন্য বলা হলে নমনীয় হওয়ার কথা জানিয়েছেন জামালপুর-২ (ইসলামপুর) আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা জিয়াউল হক জিয়া। তিনি বলেন, ডামি প্রার্থীর বিষয়টা আমি জানি। আমি সিনিয়র নেতাদের সাথে কথা বলে সিদ্ধান্ত নিব। এর আগে উপজেলা নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থী হয়ে আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কার হয়েছিলেন তিনি।

নরসিংদী জেলার পাঁচ আসনের মধ্যে সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যানসহ আওয়ামী লীগের ১৩ জন স্বতন্ত্র প্রার্থীর মনোনয়ন দাখিল করেছেন।

নরসিংদী সদর-১ আসনে আওয়ামী লীগ মনোনীত বর্তমান সংসদ সদস্য মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম হিরুর (বীর প্রতিক) পক্ষে বুধবার এক মতবিনিময় সভায় নরসিংদী জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি আহসানুল ইসলাম রিমন বলেছেন, কোন স্বতন্ত্র মতন্ত্র চিনি না, মাইরের ওপর ঔষধ নাই। ছাত্রলীগের কোনো পোলাপান স্বতন্ত্ররে মানতো না। স্বতন্ত্ররে কেমনে পিডাইতে হয় তা জানা আছে। হেরে আমরা এমনেই পিডামু। সদরের কোন এলাকায় তাদেরকে জায়গা দেয়া যাবে না। তারা নৌকার বিরোধী, মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী, তারা দেশ বিরোধী।

পরে অবশ্য তার এই বক্তব্যের জন্য তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

এ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দিয়েছে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কাজী মোহাম্মদ আলী ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, সাবেক পৌর মেয়র কামরুজ্জামান।

ফেনী জেলার তিন আসনের মধ্যে স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে মনোনয়ন দাখিল করেছেন ১২ জন। ফেনী-৩ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী সাবেক সংসদ সদস্য রহিম উল্ল্যাহ বলেন, আমি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এমপি নির্বাচিত হয়ে সব সময় সুখে-দুঃখে এলাকাবাসীর পাশে ছিলাম। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘোষণা দিয়েছেন ডামি প্রার্থী হয়ে বিজয়ী হতে পারলে তিনি পুরস্কৃত করবেন। তিনি বলেই দিয়েছেন দলীয়ভাবে কোন চাপ আসবেনা। সেক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা যে কেউ চাইলে স্বতন্ত্র প্রার্থীর পক্ষে কাজ করতে পারবে, এতে দল থেকে কোন নিষেধাজ্ঞা নেই। 

নীলফামারী-৩ আসনে গোলাম মোস্তফার বিপরীতে মনোনয়ন নিয়েছেন আওয়ামী যুবলীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ বিষয়ক সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন পাভেল, বঙ্গবন্ধু পরিষদ নীলফামারী জেলা শাখার সদস্যসচিব মো. রোকনুজ্জামান জুয়েল, জলঢাকা উপজেলা যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক হুকুম আলী ও জলঢাকা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবু সাঈদ শামীম।

গাজীপুর-৩ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনীত নৌকা প্রার্থী প্রয়াত রহমত আলীর কন্যা রুমানা আলী টুসির বিপক্ষে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে লড়বেন বর্তমান সংসদ সদস্য ও গাজীপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হোসেন সবুজ। হাজার হাজার নেতাকর্মী এবং অনুসারী নিয়ে গত বুধবার মনোনয়ন জমা দিয়েছেন তিনি।

স্বতন্ত্র প্রার্থীদের বিষয়ে আওয়ামী লীগের এ যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দীন নাছিম বলেন, স্বতন্ত্র প্রার্থীদের নিয়ে ১৭ তারিখের মধ্যেই পরিষ্কার হবে। সুনির্দিষ্ট জায়গা ছাড়া যে কোন জায়গায় ইচ্ছামত দাঁড়িয়ে নির্বাচন করার সুযোগ নেই। ইতিমধ্যে এটি পরিষ্কার করে জানানো হয়েছে।

স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মনোনয়ন প্রত্যাহারের বিষয়ে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ একটি সুশৃঙ্খল রাজনৈতিক দল। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। তিনি যে নির্দেশনা দেন আওয়ামী লীগের প্রতিটা নেতাকর্মী সে নির্দেশনা অক্ষরে অক্ষরে পালন করে। 

স্বতন্ত্র প্রার্থীর বিরুদ্ধে দলগতভাবে কোন ব্যবস্থা নেয়া হবে কি না এমন প্রশ্নের উত্তরে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, অ্যাকশনের ব্যাপারটা ভিন্ন। আমাদের কৌশলগত দিক আছে। আমাদের নেত্রীর বক্তব্য যেটা উনি গণভবনে দিয়েছিলেন, আমাদের প্রার্থীদের উদ্দেশে। সেখানে আমরা ঢালাওভাবে সবাই ইলেকশন করব বিষয়টা এমন না। দলীয় শৃঙ্খলার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ১৭ তারিখের মধ্যে আমরা বিষয়টা নতুন করে দেখবো। অ্যাডজাস্টমেন্ট, অ্যাকুমুডেশন আমরা দলীয়ভাবে বিষয়টি দেখব।