পালিয়ে নিরাপদ স্থানে আয়েশি জীবন-যাপনে কাটানো আওয়ামী লীগের এমপি-মন্ত্রী ও নেতাদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগড়ে দিচ্ছেন মাঠে থেকে নির্যাতন ভোগ করা কর্মী-সমর্থকরা। দলের দুঃসময়ে কর্মীদের পাশে না দাঁড়ানো এসব দুধের মাছিদের আগামীতে আর নেতৃত্বে দেখতে চান না তারা।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অনেক মন্ত্রী-এমপি ও কেন্দ্রীয় নেতা বিদেশে আশ্রয় নিয়েছেন। তাদের অধিকাংশই সেখানে এখন বিলাসী জীবনযাপন করছেন। কিন্তু দেশে থাকা তৃণমূল নেতাদের খোঁজখবর পর্যন্ত রাখছেন না তারা।
নিজেদের ফোনসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম রেখেছেন বন্ধ। ব্যতিক্রমও কেউ কেউ আছেন। পট পরিবর্তনের পর দলের অনেক কর্মী সংকটে পড়েছেন। বিলাসী জীবনযাপনকারী নেতাদের উদ্দেশে তৃণমূল কর্মীরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন।
সূত্রমতে, আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের অধিকাংশই গা ঢাকা দিয়েছেন। এর মধ্যে বড় অংশ এখন বিদেশে গেছেন। কেন্দ্রীয় নেতা ছাড়াও সাবেক মন্ত্রী-এমপি রয়েছেন। উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নেতা বিদেশে স্থায়ী হওয়ার চেষ্টা করছেন। কেউ কেউ দেশে ফেরার জন্য ‘সুসময়’ খুঁজছেন। এদের কেউ কেউ টেলিফোনে এলাকার নেতা-কর্মীদের খোঁজখবর রাখছেন।
ক্ষমতায় থাকাকালে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশ সক্রিয় ছিলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি ‘খেলা হবে’ কিংবা ‘পালাব না’ ইত্যাদি বলে নিয়মিত গণমাধ্যমের শিরোনাম হতেন।
জুলাই-আগস্ট গণ অভ্যুত্থানের পর কোথাও তাঁর উপস্থিতি টের পাওয়া যায়নি। অতি সম্প্রতি তিনি ভারতে পাড়ি জমিয়েছেন। এ ছাড়াও ভারতে থাকা নেতাদের মধ্যে রয়েছেন, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী তাজুল ইসলাম, সাবেক বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক, সাবেক বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু।
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের মধ্যে আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, মির্জা আজম, এস এম কামাল হোসেন, অ্যাডভোকেট আফজাল হোসেন, শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল, সুজিত রায় নন্দী, অসীম কুমার উকিল, মৃণাল কান্তি দাস ভারতে রয়েছেন।
সাবেক শিক্ষামন্ত্রী ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল ভারত হয়ে অন্য দেশে গেছেন বলে জানা গেছে। এ ছাড়া সাবেক মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী আবদুর রহমান, সাবেক যুব ও ক্রীড়ামন্ত্রী নাজমুল হাসান পাপন, সাবেক নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী এবং সাবেক প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী শফিকুর রহমান চৌধুরী লন্ডনে রয়েছেন।
দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ কানাডায় অবস্থান করছেন। সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদও ক্ষমতায় থাকাকালে দলের সাধারণ সম্পাদকের মতো প্রতিদিন গণমাধ্যমের শিরোনাম হতেন। বিরোধী দলের তীব্র সমালোচনা করে আলোচনায় থাকতেন। ক্ষমতাচ্যুতির পর দলের এই যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকও আত্মগোপনে চলে যান। তিনি দীর্ঘদিন চুপচাপ থাকার পর একটি গণমাধ্যমে নিজের অবস্থান জানান দিলেও কোথায় আছেন, তা স্পষ্ট করেননি।
অনেকেই বলছেন, তিনি আছেন বেলজিয়ামে। বাংলাদেশে সরকার পরিবর্তনের পর ব্রিটেনে এসে রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়েছেন আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন সাবেক সংসদ সদস্য ও নেতা। নারায়ণগঞ্জের সাবেক এমপি নজরুল ইসলাম বাবু আছেন সুইজারল্যান্ডে। পর্তুগালসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশেও আছেন আওয়ামী লীগের অনেক নেতা।
অনেকে আছেন সৌদি আরব, সারা বছরের ভিসা নিয়ে। দুবাইসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতেও সাম্প্রতিক সময়ে দেখা গেছে আওয়ামী লীগের অনেক দাপুটে নেতাকে। এখন পর্যন্ত অন্তত তিন নেতার ব্রিটেনে রাজনৈতিক আশ্রয় চাওয়ার ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া গেছে। তারা হলেন- আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি রনজিত চন্দ্র সরকার, বিধান কুমার সাহা ও সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের উপ-প্রচার সম্পাদক সুয়েব আহমদ। সাবেক নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরীর মেয়ে আগে থেকেই লন্ডনে পড়াশোনা করতেন। এ সুবাদে যুক্তরাজ্যে আসা-যাওয়া ছিল। তার স্ত্রীও ব্রিটেনে নিয়মিত আসা-যাওয়া করেন। তারা আছেন লন্ডনে।
সাবেক মন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদও আছেন সেখানে। আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য আবদুর রহমানও যুক্তরাজ্যে অবস্থান করছেন। তার ছেলেও ব্রিটেনে পড়াশোনা করেছেন। সিলেটের সাবেক এমপি ও প্রতিমন্ত্রী শফিকুর রহমান চৌধুরী লন্ডনে অবস্থান করছেন। এ ছাড়াও যুক্তরাজ্যে অবস্থান করছেন সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব কবির বিন আনোয়ার, সিলেট সিটির সাবেক কাউন্সিলর আজাদুর রহমান আজাদ। সিলেটের সাবেক মেয়র আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী, সিলেট-৩ আসনের সাবেক এমপি হাবিবুর রমান হাবিব লন্ডনে অবস্থান করছেন।
সূত্র জানায়, শেখ হাসিনা সরকার পতনের দিন বিকালে সিলেটের তামাবিল সীমান্ত দিয়ে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের বেশ কয়েকজন নেতা ভারতে পাড়ি জমান। পরবর্তীতে ইমিগ্রেশন করে বৈধপথে ভারতে যাওয়া ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠায় আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের কয়েক শ নেতা-কর্মী সিলেটের গোয়াইনঘাট, কোম্পানীগঞ্জ ও কানাইঘাটের বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে অবৈধভাবে ভারতে চলে যান। ভারত হয়ে এদের অনেকেই দুবাই, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য, বেলজিয়াম, কানাডা, সুইজারল্যান্ডসহ নানান দেশে পাড়ি জমান।
সাবেক ছাত্রলীগের একাধিক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে গণমাধ্যমকে বলেন, আমরা সংকটের সময় দলের জন্য জীবনবাজি রাখি। এখন কেন্দ্রীয় নেতা, মন্ত্রী-এমপিদের অনেকেই বিদেশে গিয়ে আয়েসি জীবনযাপন করছেন। কর্মীদের ন্যূনতম খোঁজখবর রাখছেন না। পট পরিবর্তনের পর তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা বাড়ি ছাড়া। হামলা-মামলার শিকার হচ্ছি। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সংক্ষিপ্ত মিছিল, বিভিন্ন দিবস পালন করছি। এতে জীবনের ঝুঁকি আছে। তারপরও একজন কেন্দ্রীয় নেতা কিংবা মন্ত্রী-এমপি আমাদের খোঁজখবর নিচ্ছেন না। তারা বিদেশে আয়েসি জীবনযাপন করছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা মহানগর দক্ষিণের এক নেতা বলেন, জেলজুলুম নির্যাতন সহ্য করি আমরা। আর মধু খান কতিপয় নেতা-এমপি-মন্ত্রী। দলের সুদিনে আমাদেরকে দূরে রাখা হয়। হাইব্রিডরা দলের জায়গা পায়। আমরা বঞ্চিত থাকি। এখন যেসব এমপি-মন্ত্রী নেতারা পালিয়ে থেকেও দলীয় নেতা-কর্মীদের খোঁজখবর নিচ্ছেন না-আগামীতে তাদের আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে দেখতে চাই না। সূত্র: বাংলাদেশ প্রতিদিন