রাজনীতিতে স্বমহিমায় ‘বিজয়লক্ষ্মী নারী’
![-লেখক](https://imaginary.barta24.com/resize?width=800&height=450&format=webp&quality=85&path=uploads/news/2024/Mar/08/1709880481236.jpg)
-লেখক
তিন দশকের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশে রাষ্ট্র পরিচালনায় নেতৃত্বে রয়েছে নারী। বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশের নারী নেতৃত্ব এখন প্রশংসিত। এদেশের উন্নয়নের কেন্দ্রেও রয়েছে নারী। ১৯৯১ সাল থেকে এই দীর্ঘ সময়ে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন দুজন নারী- শেখ হাসিনা ও বেগম খালেদা জিয়া। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর এ পর্যন্ত পাঁচবার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথগ্রহণ করে বিশ্বরেকর্ড গড়েছেন। তবে বাংলাদেশের সংসদীয় রাজনীতিতে প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হলেন বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া। তিনি ১৯৯১ সালে, পঞ্চম জাতীয় সংসদের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন।
এদেশের জাতীয় সংসদে এবার দিয়ে টানা চতুর্থবারের মতো স্পিকারের দায়িত্বে রয়েছেন একজন নারী। তিনি হলেন ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী। বাংলাদেশের সংসদীয় ইতিহাসে তিনি সর্বকনিষ্ঠ স্পিকার এবং প্রথম নারী স্পিকার। এছাড়াও বিরোধীদলীয় নেতা, পররাষ্ট্রমন্ত্রীসহ সরকারের শীর্ষ অনেক পদে নেতৃত্ব দিয়েছেন, দিচ্ছেন নারীরা। যদিও বাংলাদেশের তৃণমূল সমাজ এখনো পিতৃতান্ত্রিক আবহেই বিরাজমান। তারপরও পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের নানা বাধা-প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে যোগ্যতা ও দক্ষতার সঙ্গে দেশের অর্থনীতিতেও বেড়েছে নারীর অংশগ্রহণ।
সংসদ অধিবেশনে নারী
স্বাধীনতার পর দীর্ঘ ৫৩ বছরে বাংলাদেশে গঠিত হয়েছে ১২টি সংসদ। প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ। সেই সংসদে ১৫টি সংরক্ষিত আসনে নেতৃত্ব দেওয়ার মাধ্যমে শুরু হয় এদেশের সংসদীয় রাজনীতিতে নারীর পদযাত্রা। তারপর ১৯৭৯ সালে সংরক্ষিত আসনের সংখ্যা ৩০-এ উপনীত হয়। পরে ২০০১ সালের অষ্টম সংসদে সেটি ৪৫ করা হয়। ২০১১ সালের ৩০ জুন সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংরক্ষিত আসনের বর্ধিত মেয়াদকাল ও নির্বাচন পদ্ধতি অক্ষুণ্ণ রেখে আসন সংখ্যা ৪৫ থেকে বাড়িয়ে ৫০ করার প্রস্তাব করা হয়। পরে সর্বশেষ ২০১৪ সালের দশম সংসদে সেটি বেড়ে ৫০-এ উন্নীত করা হয়।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সংসদীয় রাজনীতিতে বাড়তে থাকে নারীর অংশগ্রহণ। পরবর্তীতে ১৯৭৯ সাল থেকে সংরক্ষিত আসনের বাইরে সরাসরি রাজনীতির মাঠে ভোটযুদ্ধেও জয়ী হয়ে সংসদে আসছেন নারীরা। সে বছরের দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটের মাধ্যমে দেশের ইতিহাসে প্রথমবার নারী সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন খুলনা-১৪ আসনের সৈয়দা রাজিয়া ফয়েজ। তারপর ১৯৮৬ সালের ৫ জন, ১৯৮৮ সালে ৪ জন নারী সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হন। তবে ওই দুই নির্বাচনে কতজন নারী প্রার্থী ছিলেন তার সংখ্যা জানা যায়নি। ১৯৯১ সালে ৩৯ প্রার্থীর মধ্যে ৫ জন, ১৯৯৬ সালে ৩৬ প্রার্থীর মধ্যে ৮ জন, ২০০১ সালে ৩৮ প্রার্থীর মধ্যে ৬ জন, ২০০৮ সালে ৫৯ প্রার্থীর মধ্যে ১৯ জন এবং ২০১৪ সালের নির্বাচনে ২৯ প্রার্থীর মধ্যে ১৮ জন নারী সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হয়ে এমপি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তবে, ওই সংসদে সংসদ সদস্য স্বামীর মৃত্যুর পর উপ-নির্বাচনে তিনজন, স্বামীর ছেড়ে দেওয়া আসনে একজন এবং প্রধানমন্ত্রীর ছেড়ে দেওয়া আসনে একজনসহ আরও ৫ নারী নির্বাচিত হয়েছিলেন ।
২০১৮ সালে, একাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়া ৬৮ নারীর মধ্যে এ যাবতকালে সর্বাধিক ২২ জন সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হন। তারপর জাতীয় নির্বাচনের ইতিহাসে এবারই (দ্বাদশ সংসদ) ভোটের মাঠে ১ হাজার ৮৯৫ প্রার্থীর মধ্যে সর্বোচ্চসংখ্যক ৯৪ জন নারী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। তাদের মধ্যে ২৬ জন মাঠে ছিলেন স্বতন্ত্র হিসেবে। ভোটে জয়ী হন ১৯ নারী। এই নির্বাচনে আসা ২৭ রাজনৈতিক দলের মধ্যে ১৪টি দল ৬৮ নারীকে মনোনয়ন দেয়। তবে সেই সংখ্যা পুরুষ প্রার্থীর তুলনায় মাত্র ৫ শতাংশ।
বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, গতবারের তুলনায় এবার বিজয়ীর সংখ্যা কমলেও অংশগ্রহণ বাড়ার দিক থেকে এই পরিস্থিতি খুবই আশাব্যঞ্জক। এ বিষয়ে মানবাধিকার কর্মী খুশি কবির খবরের কাগজকে বলেন, ‘পিতৃতান্ত্রিক এই সমাজব্যবস্থায় নারীর অগ্রযাত্রার পথ কখনোই মসৃণ ছিলো না। রাষ্ট্র পরিচালনার কাঠামোয় নারীর অংশগ্রহণ যত বেশি বাড়বে, ততই নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার পথ সহজ হবে। কারণ পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে সম-অংশীদারিত্ব ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় নারীদের লড়াই-সংগ্রাম এখনো বিরাজমান। আর সমাজের সর্ব স্তরের নারীদের সামনে থেকে এগিয়ে নিতে অগ্রণী ভূমিকা রাখেন রাজনীতিতে অংশ নেয়া নারীরা’।
দলীয় রাজনীতিতে নারী
রাষ্ট্র পরিচালনার শীর্ষে এদেশে নারীর অবস্থান। তারপরও রাজনীতিতে জাতীয় পর্যায়ে নেতৃত্ব দেয়া নারীর সংখ্যা এখনো আশানুরূপ নয়। কেন? সেই প্রশ্নের উত্তর মিলবে বিগত ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী প্রার্থীর মধ্যে নারী প্রার্থীদের সংখ্যার দিকে তাকালে। মোট প্রার্থীর মধ্যে নারী প্রার্থী ছিলো ৫ শতাংশেরও কম!
নির্বাচন কমিশনের প্রার্থী তালিকা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ৩শ’ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা ২৮টি রাজনৈতিক দলের ১,৮৯১ জন প্রার্থীর মধ্যে নারী প্রার্থী মাত্র ৯৪ জন। তাদের মধ্যে ১৪টি দলের ৬৮ নারী প্রার্থী আর ২৬ জন নারী মাঠে ছিলেন স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে। দলগত হিসাবে দেখা যায়, আওয়ামী লীগের ৩৬৩ প্রার্থীর ৭ দশমিক ৬০ শতাংশ নারী প্রার্থী। জাতীয় পার্টির ২৬৪ প্রার্থীর ৩ দশমিক ৩৯ শতাংশ নারী প্রার্থী। স্বতন্ত্র ৩৮২ প্রার্থীর ৬ দশমিক ৫২ শতাংশ নারী প্রার্থী।
বিশ্লেষকরা বলছেন, নারী-পুরুষে বৈষম্য সমাজে এখনো বিরাজমান। পুরুষ নেতারা নারীদের এগিয়ে যেতে দিতে চায় না। অল্প কিছু আসনে ভোটে বিজয়ী হয়ে নারীদেরও তারা অলঙ্কার হিসেবে ভাবার মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি। তারা মনে করে, নারী নেতৃত্ব দিতে পারবে না, ওই কাজ পুরুষের। অথচ সুযোগ পেলে নারীরা যে রাজনীতিতেও সাহসী ভূমিকা রাখতে পারে- তার উজ্জ্বল উদাহরণ হলো আমাদের প্রধানমন্ত্রী। তারপরও আমাদের সমাজে, রাজনৈতিক দলগুলোতে নারীদের অগ্রাধিকার দেওয়া হয় না। নারীদের রাজনীতিতে এগিয়ে যাওয়ার পথে ধর্মীয়-সামাজিক নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি, বিত্তশালীদের পেশীশক্তি ও পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব- এসব বাধা দূর করা করা জরুরি।
লেখক: সাংবাদিক