মন্ত্রী-এমপির স্বজনদের নির্বাচনে মানা ক্ষমতাসীনদের, অনড় প্রার্থীরা

  • রুহুল আমিন, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

আসন্ন উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যদের সন্তান ও নিকটাত্মীয়দের প্রার্থী না হওয়ার নির্দেশনা দিয়েছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। তবে সে নির্দেশনা উপেক্ষা করে এখনো নির্বাচনি কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন মন্ত্রী, সংসদ সদস্যদের অনেক স্বজনেরা।

মন্ত্রী-সংসদ সদস্য ও প্রার্থীদের এ বিষয়ে তাগাদা দিতে দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরকে নির্দেশনা দেন। সে নির্দেশনা অনুযায়ী গত বৃহস্পতিবার (১৮ এপ্রিল) ধানমন্ডির সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ে দায়িত্বশীল যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক ও সাংগঠনিক সম্পাদকরা বৈঠক করেন। বৈঠকে আত্মীয়দের তালিকা করারও নির্দেশনা দিয়ে এই বার্তা সবার কাছে পৌঁছে দেওয়ার কথা বলা হয়।

বিজ্ঞাপন

তবে এমন কঠোর বার্তাও নির্বাচন থেকে সরাতে পারছে না প্রার্থীদের। প্রার্থীরা বলছেন, আমরা মন্ত্রী-এমপিদের রাজনীতি করি না। তাহলে আমাকে কেন এমপি সাহেবদের জন্য সরে দাঁড়াতে হবে? আমরা আমাদের যোগ্যতায় নিজেদের রাজনীতির মাঠ তৈরি করেছি কিন্তু আমার স্বজন কেউ এমপি বা মন্ত্রী হলেন বলেই আমি সব কিছু ছেড়ে দেব, এটা সম্ভব না।

মন্ত্রী-সংসদ সদস্যদের নিকটাত্মীয়দের বিষয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছেন প্রায় দুই ডজনেরও অধিক স্বজন। তাদের মধ্যে আছেন, মাদারীপুর-১ আসনের সংসদ সদস্য শাহজাহান খানের ছেলে আসিবুর রহমান খান, বগুড়া-১ আসনের সংসদ সদস্য সাহাদারা মান্নানের ছেলে মোহাম্মদ সাখাওয়াত হোসেন ও ছোট ভাই মিনহাদুজ্জামান ওরফে লিটন (তারা ভিন্ন ভিন্ন উপজেলায় চেয়ারম্যান প্রার্থী হয়েছেন), টাঙ্গাইল-১ আসনের সংসদ সদস্য ও সাবেক কৃষিমন্ত্রী মো. আব্দুর রাজ্জাকের খালাত ভাই, পিরোজপুর-১ আসনের সংসদ সদস্য শ ম রেজাউল করিমের ছোট ভাই নূর-ই আলম, বরিশাল-১ আসনের সংসদ সদস্য আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর ছোট ছেলে আশিক আব্দুল্লাহ, শরীয়তপুর-১ আসনের সংসদ সদস্য ইকবাল হোসেন অপুর চাচাত ভাই বিল্লাল হোসেন নিপু।

বিজ্ঞাপন

এছাড়াও নরসিংদী-২ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ার আশরাফ খানের শ্যালক মো. শরিফুল হক, প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলকের শ্যালক লুৎফুল হাবীব রুবেল, মাগুরা-২ আসনের সংসদ সদস্য বীরেন শিকদারের ছোট ভাই বিমল শিকদার, সুনামগঞ্জ-৩ আসনে সংসদ সদস্য এম এ মান্নানের ছেলে শাহাদাত মান্নান, সুনামগঞ্জের সংরক্ষিত আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শামসুন্নাহার বেগমের ছেলে ফজলে রাব্বি, মানিকগঞ্জ-৩ আসনের সংসদ সদস্য জাহিদ মালেকের ফুপাত ভাই ইসরাফিল হোসেন, কুষ্টিয়া-৩ আসনের সংসদ সদস্য আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো. মাহাবুব-উল আলম হানিফের চাচাত ভাই আতাউর রহমান, নোয়াখালী-৬ আসনের সংসদ সদস্য মোহাম্মদ আলীর ছেলে আতিক আলী অমি, এমপি মোহাম্মদ আলীর স্ত্রী ও সাবেক এমপি আয়েশা আলীও উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছেন।

আবার নোয়াখালী-৪ আসনের সংসদ সদস্য মোহাম্মদ একরামুল করিম চৌধুরী এক জনসভায় গিয়ে তার ছেলের পক্ষে দেওয়া বক্তব্য হয়েছে ভাইরাল। সেখানে তিনি বলেছেন, নোয়াখালীর সুবর্ণচরে তার ছেলেকে ভোট না দিলে উন্নয়নকাজ করবেন না তিনি। তার ছেলে আতাহার ইশরাক শাবাব চৌধুরী সুবর্ণচর সদর উপজেলা নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছেন।

স্বজনদের প্রার্থিতার বিষয়ে কঠোর হওয়ার বার্তা দিয়ে শনিবার (২০ এপ্রিল) এক সংবাদ সম্মেলনে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, 'একটা দলে আমি এমপি, আমি মন্ত্রী, আবার আমার ভাই, ছেলে এরাও পদ নিয়ে যাবে সব, তাহলে তৃণমূলের কর্মীরা কী করবে? তাদের পদে যাওয়ার কোনো অধিকার নেই? সে সুযোগটা করে দেওয়ার জন্যই এই সিদ্ধান্ত।

তবে মন্ত্রী-এমপিদের স্বজনরা বলছেন ভিন্ন কথা। তাদের ভাষ্যমতে, শুধু স্বজন হওয়ার কারণেই প্রার্থী না হওয়ার বিষয়টি তারা মানতে নারাজ। তাদের কথা, আমরা তো মন্ত্রী-এমপিদের ভরসায় নির্বাচন করছি না। আমরা আমাদের পরিচয়ে নির্বাচন করছি। তাহলে স্বজন হওয়া কি অপরাধ? তারাও তাই অনড় নির্বাচনি মাঠে; দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে হলেও নির্বাচনি মাঠে থেকে দেখতে চান শেষটা।

আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নির্দেশনা অনুযায়ী সংসদ সদস্যদের নিকটাত্মীয়রা উপজেলা নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবেন না, সে ক্ষেত্রে যেহেতু আপনার বোনের স্বামী নরসিংদী-২ আসনের সংসদ সদস্য (আনোয়ার আশরাফ খান), আপনি কি মনোনয়ন প্রত্যাহার করবেন এমন প্রশ্নের জবাবে পলাশ উপজেলার চেয়ারম্যান প্রার্থী মো. শরিফুল হক বার্তা২৪.কমকে বলেন, আমি উইথড্র করব কারণ কী? আমি তো এমপি সাহেবের রাজনীতি করি না।

শরিফুল হক বলেন, ঘোড়াশাল-পলাশে আমরা রাজনৈতিক পরিবার। আমার রাজনৈতিক পরিচয় তো শালা-সম্বন্ধী না। আমার রাজনৈতিক পরিচয় হচ্ছে পলাশের আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হাসানুল হক হাসান সাহেবের ভাতিজা। ছাত্র সংসদের নির্বাচনের মাধ্যমে আমার রাজনৈতিক জীবনের শুরু। আমার ভগ্নীপতি তখন কোনো রাজনৈতিক নেতাও ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন ডাক্তার। আমি কি আমার বোনের স্বামীর জন্য আমার তিলে তিলে গড়া রাজনীতি ধ্বংস করে দেব? অবশ্যই আমি আমার নির্বাচন চালিয়ে যাব।

পিরোজপুর-১ আসনের সংসদ সদস্য শ ম রেজাউল করিমের ছোট ভাই নূর-ই আলম নাজিরপুর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান প্রার্থী। তার সংসদ সদস্য ভাইয়ের সাথে সরাসরি কোন সম্পৃক্ততা নেই দাবি করে বার্তা২৪.কমকে বলেন, আমি ৩০ বছর থেকে আলাদা সংসার মেনটেইন করি। আমার মতাদর্শ আলাদা। আমি বঙ্গবন্ধুকে ভালবাসি, শেখ হাসিনাকে ভালোবাসি। আমার ভাই যে সংসদ সদস্য তিনি চিকিৎসার জন্য থাইল্যান্ডে আছেন গত ১৫ দিন। আমি দীর্ঘদিন ধরে সামাজিক নানা কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত। করোনার সময়ে সামাজিক কাজ করেছি, বিভিন্ন সময়ে আর্থিক সাহায্য করেছি। সে কাজের ক্ষেত্রে আমাকে নিয়ে একটা বলয় তৈরি হয়েছে। তারা আমাকে নির্বাচনের জন্য উদ্বুদ্ধ করেছে, সেজন্য আমি নির্বাচন করি।

নূর-ই আলম বলেন, আমি রাজনৈতিক মতাদর্শে আওয়ামী লীগের একজন সমর্থক, কিন্তু অফিসিয়ালি দলের সাথে সংশ্লিষ্ট না। কোনো ইউনিটের সঙ্গে আমি সম্পৃক্ত না। এমনকি আমি এমপি সাহেবের রাজনীতির সাথেও সরাসরি সম্পৃক্ত না। আমি দূর থেকে যতটা পারি সহযোগিতা করি। তার সাথে আসলে আমার রাজনৈতিকভাবে তেমন কোন সম্পৃক্ততা নেই।

তবে দলের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা বলছেন, দলের বার্তা সব জায়গায় পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। তারপরও যদি দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে স্বজনরা নির্বাচনে থাকেন তাহলে তাদের বিরুদ্ধে নেওয়া হবে সাংগঠনিক ব্যবস্থা। এমনকি তাদের পক্ষে সমর্থনও করতে পারবেন না দলীয় কোনো ব্যক্তি। এ বিষয়ে কঠোর নজরদারি করা হচ্ছে এবং সে অনুযায়ী তালিকাও প্রস্তুত করা হচ্ছে।

মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যদের নিকটাত্মীয়দের উপজেলা নির্বাচনে প্রার্থী না হওয়ার বিষয়ে আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দীন নাছিম বার্তা২৪.কমকে বলেন, ছেলে, স্ত্রী, কন্যা, ভাগিনা, শ্যালক সরাসরি ঘনিষ্ঠ আত্মীয়দেরকে প্রার্থী করা যাবে না। আমরা অংশগ্রহণমূলক একটি সুন্দর নির্বাচন চাই। এই নির্বাচন যেন কোনোভাবে প্রশ্নবিদ্ধ না হয় সেজন্যই আমরা আওয়ামী লীগ থেকে দলীয় কোন প্রতীক দিইনি। এটা সবাই মানবে, মানার জন্যই বলা হয়েছে। দলের সিদ্ধান্ত কেউ মানবে না বলে আমরা মনে করি না।

নাছিম বলেন, আমাদের দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের দু'চারজন প্রার্থী আছে বিভিন্ন বিভাগে, তারা দায়িত্বশীল মানুষ, দায়িত্বশীল নেতা, তারা দলের অভিমতকে, সিদ্ধান্তকে অবশ্যই মানবেন, সম্মান দেবেন, প্রতিপালন করবেন।