এখনো অন্ধকারেই এরশাদের ‘আমার জীবনের অবশিষ্ট অধ্যায়’ পাণ্ডুলিপি
জীবদ্দশায় অসমাপ্ত আত্মজীবনী (‘আমার জীবনের অবশিষ্ট অধ্যায়’) প্রকাশ করতে চেয়েছিলেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। সবকিছু চূড়ান্ত করে এনেছিলেন। আর কয়েকটা দিন সময় পেলে প্রকাশনা উৎসব করে যেতে পারতেন তিনি। কিন্তু তা আর করে যেতে পারেননি এরশাদ।
জীবদ্দশায় কেন এত তাড়াহুড়ো করেছিলেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, তা সমর্থকেরা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতে পারছেন এখন।
যে বইটির প্রচ্ছদ থেকে সবকিছু চূড়ান্ত, শুধু ছাপানো বাকি, সেই কাজটুকু করার কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি গত ৫ বছরে।
এরশাদের প্রতিষ্ঠিত জাতীয় পার্টি (জাপা) নিয়ে যতটা টানাহেঁচড়া চলছে, তার সিকিভাগও আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না এরশাদের লিখিত ‘আমার জীবনের অবশিষ্ট অধ্যায়’ বইটি নিয়ে।
হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ নিজেই বইটির নামকরণ করেন- আমার জীবনের অবশিষ্ট অধ্যায়।
এতে স্থান পেয়েছে, জেল থেকে বের হওয়ার পর তার রাজনীতি, বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রেক্ষাপট। থাকছে, নানান রকম ঘটনা প্রবাহ ও জাপার ভাঙাগড়ার নানা রকম উত্থান-পতন। বইটির প্রচ্ছদে এরশাদের কোট, টাই পরা পোর্টেট ছবি। আর পেছনের প্রচ্ছদে গোধূলিলগ্নে চিন্তমগ্ন এরশাদের সাদাকালো ছবি প্রয়াত এই রাষ্ট্রপতি নিজেই পছন্দ করেছিলেন। বইটির পৃষ্ঠা সংখ্যা নির্ধারণ করা হয়েছিল ৮শ ৩২।
হুসেইন মহুম্মদ এরশাদের প্রেস ও পলিটিক্যাল সেক্রেটারি সুনীল শুভরায় বইটির অনুলিখন করেছেন।
এরশাদের দীর্ঘ সময়ের এ সহযোগী বার্তা২৪.কমকে বলেছেন, ‘স্যারের (এরশাদ) মৃত্যুর পর বইটির পাণ্ডুলিপি জিএম কাদেরের হাতে দেওয়া হয়। তিনি নিজেও বের করলেন না আবার আমাদেরকেও বের করতে দিলেন না। অথচ তার নিজের (জি এম কাদের) লেখা অখাদ্য-কুখাদ্য বই প্রকাশ করেছেন। অবশেষে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ট্রাষ্ট থেকে বইটি প্রকাশের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আশা করছি, কয়েক মাসের মধ্যেই প্রকাশিত হবে’!
কী কী বিষয় স্থান পাচ্ছে বইটিতে এমন প্রশ্নের জবাবে সুনীল শুভ রায় বলেন, 'জেল থেকে মুক্তির পর ২০১৮ সালের নির্বাচন পর্যন্ত অনেক অজানা সত্য জানতে পারবেন পাঠক। তবে এরপরও কিছু সেন্সর থেকেই যায়। কারণ, সব কথা বলা সম্ভব হয় না!’
বইটির সঙ্গে জড়িত এমন একজন নাম প্রকাশ না-করার শর্তে বার্তা২৪.কমকে জানিয়েছেন, ‘আমার জীবনের অবশিষ্ট অধ্যায়’ বইটির বিশাল অংশ জুড়ে রয়েছে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট। কীভাবে জাতীয় পার্টিকে ভাঙা হয়েছে। তাঁর দলের সদস্যের মন্ত্রিসভায় থাকা না থাকার বিষয়। এরশাদ কী চেয়েছিলেন আর কী হয়েছে অনেকখানি, খোলাসা করার চেষ্টা হয়েছে বইটিতে।
তিনি বলেন, অবশ্য ওই বইটি এরশাদের প্রথম জীবনীগ্রন্থ নয়। ২০১৬ সালে প্রকাশিত হয়েছে আমার কর্ম আমার জীবন।
এই বইয়ে স্থান পেয়েছে তাঁর বেড়ে ওঠা, স্কুলজীবন, সেনাবাহিনীতে প্রবেশ, রাষ্ট্রপতি হওয়া, ক্ষমতা হস্তান্তরের পর জেলে যাওয়া এবং জেল থেকে মুক্তি পর্যন্ত। ৮শ ৬৪ পৃষ্ঠার বইটিতে অনেক অজানা তথ্য তুলে ধরেছেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ।
প্রথম বইয়ে নায়িকার নাম প্রকাশ না-করলেও অকপটে স্বীকার করেছেন তার প্রথম প্রেমপত্রের চিঠির অনুভূতি। সেই চিঠির ভেতরে থাকা গোলাপের পাঁপড়ির ঘ্রাণ। চিঠির সেই নায়িকার প্রতি আকর্ষণের কারণে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু সেই প্রেয়সীর সাড়া না মেলায় বেশিদূর এগুতে পারেননি এরশাদ।
তিনি অকপটে তুলে ধরেছেন তার সেসব অনুভূতির কথা। আবার জীবনে প্রথম অন্যের টাই পরে চাকরির ইন্টারভিউ দেওয়া, চাকরিতে যোগদান, রওশনের বাবার সঙ্গে টেনিস খেলা থেকে কীভাবে পরিণয়, সবই তুলেছেন তার প্রথম বইয়ে।
হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ জীবদ্দশায় বইটি চূড়ান্ত করেছিলেন। কিন্তু হঠাৎ হাসপাতালে চলে যাওয়ায় বইটির প্রকাশনা থেমে যায়। দেখতে দেখতে পরলোকগমনের পাঁচ বছর পেরিয়ে গেল, তবুও সেই বইটি আলোর মুখ দেখছে না।
প্রথমদিকে অর্থ সংকটের কথা বলা হলেও সাধারণ কর্মীরা এটি মানতে নারাজ। তারা মনে করছেন, এরশাদ অনেকটা অনাদরে থাকছেন শীর্ষনেতাদের কাছে। যতটুকু নিজেদের জন্য প্রয়োজন, সেটাই করছেন।
জাতীয় পার্টির একজন প্রেসিডিয়াম সদস্য নাম প্রকাশ না-করার শর্তে বলেছেন, দেখেন, আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে সামনে রেখে রাজনীতি করছে। বিএনপির জিয়ার আদর্শকে ‘ক্যাশ’ (পুঁজি) করে রাজনীতি করছে।
জাতীয় পার্টিকেও বাঁচতে হলে এরশাদের আদর্শকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। জাতীয় পার্টি কিন্তু সেই কাজটি যথাযথভাবে করতে পারছে না। এমন অবস্থা অব্যাহত থাকলে জাতীয় পার্টি ধীরে ধীরে হারিয়ে যাবে।
জাতীয় পার্টি প্রতিষ্ঠার পর থেকে এরশাদকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়ে এসেছে। আয়-ব্যয় সবই ছিল এরশাদকেন্দ্রিক। এরশাদ প্রয়াত যাওয়ার আগেই তার সব স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ ট্রাস্টের নামে লিখে দিয়েছেন। সেই ট্রাস্টও এখন পুরোপুরি জাতীয় পার্টি তথা জিএম কাদেরের হাতছাড়া। আবার নানা কারণে বিশেষ অনুদানের প্রবাহও কমে গেছে। প্রকৃত অর্থেই জাপা কিছুটা আর্থিক সংকটের মধ্যে রয়েছে। তবে বই প্রকাশ করতে পারবে না, এতটা খারাপ নয়। সদিচ্ছার অভাব দেখছেন নেতাকর্মীরা।