আওয়ামী লীগ নেতাদের মাঠে না থাকার নেপথ্যে পদ বাণিজ্য
কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সহিংসতার সময় প্রতিরোধে মাঠে দেখা যায়নি অনেক আওয়ামী লীগ নেতাকে। অভিযোগ, ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ আওয়ামী লীগের যে প্রস্তাবিত কমিটি কেন্দ্রে জমা দেওয়া হয়েছে, সেখানে রয়েছে অনেক বিতর্কিতের নাম। এছাড়াও প্রকাশ্যে আসছে পদ-বাণিজ্যের অভিযোগ। এতে মাঠে নামতে অনাগ্রহ দেখা দিয়েছিল ত্যাগী নেতাকর্মীদের।
জানা যায়, ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় ২০১৯ সালের ৩০ নভেম্বর। এরপর প্রায় ৫ বছর পার হলেও থানা ও ওয়ার্ড কমিটি দিতে ব্যর্থ হন মহানগরের দুই কমিটির দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা। পরে দুই সভাপতিমণ্ডলীর সদস্যকে তদারকির দায়িত্ব দেওয়া হলে ব্যর্থ হন তারাও।
এরপর ২০২৩ সালের ২০ মার্চের মধ্যে থানা ও ওয়ার্ডের কমিটি চূড়ান্ত করতে সময় বেঁধে দেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। বেঁধে দেওয়া সময়েও কমিটির কাজ শেষ না হওয়ায় সময় বাড়িয়ে চলতি বছরের ৩১ মে পর্যন্ত করা হয়।
অবশেষে গত ৪ জুন ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ বজলুর রহমান ও সাধারণ সম্পাদক এস এম মান্নান কচি ২৬ থানা ও ৬৪ ওয়ার্ডের এবং ১৬ জুন মহানগর দক্ষিণের সভাপতি আবু আহমেদ মন্নাফী ও সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন কবির ২৪ থানা ও ৭৫ ওয়ার্ডের প্রস্তাবিত কমিটি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের হাতে জমা দেন।
ঢাকা-৯ আসনভুক্ত খিলগাঁও, সবুজবাগ ও মুগদা থানার জন্য আলাদা কমিটি জমা দেন মন্নাফী ও হুমায়ুন। এসব কমিটি চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে পাঠানো হয়।
দীর্ঘ সময়ে কোন নতুন কমিটি দিতে না পারা, আবার প্রস্তাবিত কমিটির সদস্যদের নামও প্রকাশ্যে চলে আসায় মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে দলে। অনেকেই মনে করছেন, তাদের প্রাপ্য মূল্যায়ন করা হয়নি। প্রস্তাবিত কমিটিতে পদ-বাণিজ্যের মাধ্যমে বিতর্কিতদের নাম প্রস্তাব করা হয়েছে, এমন ক্ষোভ থেকেও আন্দোলনের সময় অনেকে বের হননি।
মহানগরের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে এমন প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেছে। এসময় নেতাকর্মীরা অভিযোগ করে বলেন, দীর্ঘদিন যাবত আমরা যারা দলের জন্য কাজ করছি, দলের সুখে-দুঃখে আছি, তারা কমিটিতে জায়গা পাইনি, কিন্তু বিএনপি-জামায়াতের নেতারা টাকা দিয়ে নেতা হয়ে যাচ্ছেন, হাইব্রিডরা এসে নেতা হয়ে যাচ্ছেন; তাহলে দলে আমাদের মূল্যায়ন কোথায়?
এনিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছেন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের দফতর সম্পাদক রিয়াজ উদ্দিন রিয়াজ। কোটা সংস্কার আন্দোলনে ব্যর্থতার কারণ হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের অভিযুক্ত করে স্ট্যাটাসে লেখেন, যাদেরকে সাংগঠনিক দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, কমিটি করার ব্যাপারে সহযোগিতা করার তারাই ওই এলাকার এমপি প্রার্থী হয়েছে। যার কারণে ত্রিমুখী হয়ে গিয়েছে নেতাকর্মীরা। ইউনিট কমিটিতে অনেক বিএনপি জামায়াতের লোক রাখা হয়েছে, সঠিক তদন্ত করলে বের হয়ে যাবে।
এছাড়াও কমিটি নিয়ে পদ-বাণিজ্য, ত্যাগীদের অবমূল্যায়নসহ বিএনপি-জামায়াতের নেতাদের ঢুকানোর অভিযোগ তুলে শতাধিক চিঠি জমা পড়েছে আওয়ামী লীগের দফতরে। এর মধ্যে প্রায় ২০টি চিঠি বার্তা২৪.কমের হাতে আছে। যা বিশ্লেষণ করেও এর সত্যতা পাওয়া যায়। একই সাথে ঢাকার উত্তরা, রামপুরা, যাত্রাবাড়ীসহ যে সব এলাকায় কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীরা বেশি সংঘটিত হয়েছে সেখানে প্রায় মাসখানেক আগেই কমিটি নিয়ে এমন অভিযোগের কথা জানিয়ে দফতরে চিঠি পাঠিয়েছিলেন নিজেদের অবমূল্যায়িত মনে করা নেতাকর্মীরা।
বার্তা২৪.কমের হাতে আসা এমনই এক চিঠিতে দেখা যায়, ৪৮ নং ওয়ার্ড (সায়েদাবাদ-যাত্রাবাড়ী) সভাপতি গিয়াস উদ্দিন গেসু দলের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক বরাবর লেখা চিঠিতে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের বিরুদ্ধে ত্যাগী নেতাদের বাদ দিয়ে বিপুল অর্থের বিনিময়ে নাম প্রস্তাব করার অভিযোগ তুলেন।
চিঠিতে গিয়াস উদ্দিন অভিযোগ করে বলেন, দক্ষিণের সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন কবির পুনরায় সভাপতি করার প্রতিশ্রুতিতে বিভিন্ন সময় ২০ লাখ টাকা নিয়েছেন। কিন্তু আরও বেশি টাকার বিনিময়ে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে অন্যজনের নাম প্রস্তাব করেছেন। চিঠিতে তিনি তার ত্যাগের মূল্যায়ন ও ২০ লাখ টাকা ফেরত চান।
রমনা থানা ও ১৯ নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ নেতা সফিকুল ইসলাম খুনের মামলার আসামি, ডাকাতি-ছিনতাইসহ মাদক ব্যবসায়ীদের প্রস্তাবিত কমিটিতে রাখার অভিযোগ এনে গত ২৯ জুন আওয়ামী লীগ সভাপতির কার্যালয়ে চিঠি জমা দেন। চিঠিতে সফিকুল ইসলাম ১৯ নং ওয়ার্ড প্রস্তাবিত সভাপতি শহিদ মাতবরের বিরুদ্ধে গাড়ি চুরির মামলা আছে বলে অভিযোগ তুলেন। অন্যদিকে প্রস্তাবিত সাধারণ সম্পাদক নুরুল বাসারের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে বলেন, তিনি পূর্বে কোন কমিটিতে না থাকলেও বিপুল অর্থের বিনিময়ে নিজের নাম প্রস্তাব করিয়েছেন।
এছাড়াও কোতোয়ালি, উত্তরখান, তুরাগ, দক্ষিণখান, উত্তরাসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে সভাপতির কার্যালয়ে পাঠানো চিঠিতেও একই ধরনের অভিযোগ আনা হয়। এসব চিঠিতে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বর্তমান নেতারা অবমূল্যায়নের অভিযোগ তুলেন। অন্যদিকে প্রস্তাবিত কমিটিতে টাকার বিনিময়ে বিতর্কিতদের নাম প্রস্তাব করা হয়েছে বলেও অভিযোগ করেন।
ঢাকা মহানগর উত্তর থানা ও ওয়ার্ডে দীর্ঘদিন কমিটি না থাকা ও প্রস্তাবিত কমিটির নাম প্রকাশ, সেখানে ত্যাগীদের মূল্যায়ন না করে বিতর্কিতদের ঢুকানো আবার পদ-বাণিজ্যের অভিযোগের ফলে ত্যাগী নেতাকর্মীরা কোটা সংস্কার আন্দোলনে মাঠে না নামা এমন অভিযোগের বিষয়ে মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ বজলুর রহমানের কাছে জানতে চাইলে বার্তা২৪.কমকে তিনি বলেন, আমি এই বিষয়ে কোন মন্তব্য করব না।
এ বিষয়ে জানতে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সভাপতি আবু আহমেদ মন্নাফীকে কয়েকবার ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।