এখনই যদি বিদ্যুৎ খাতকে টাইট না করি, তাহলে কিন্তু ২০২৭ সালের মধ্যে বিপদ এসে পড়বে বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু।
বৃহস্পতিবার (২ ডিসেম্বর) রাজধানীর গুলশানে দলের চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলের বিদ্যুৎ খাতের ব্যাপক দুর্নীতি নিয়ে করা এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি একথা বলেন। এসময় সাংবাদিকদের সামনে উপস্থাপন করা সকল তথ্য বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম থেকে নেয়া হয়েছে বলেও জানান তিনি।
তিনি বলন, ক্যাপাসিটি চার্জের ক্ষেত্রে তো মেশিনগুলো ইনসপেকশন করা যায়। কে কত টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ নিচ্ছে, একচুয়াল ক্যাপাসিটি চার্জ কত? এটা যদি নির্ধারণ করতে পারি তাহলে একচুয়াল ক্যাপাসিটি চার্জ কমে আসবে। এই জিনিসগুলো বর্তমান সরকারের দ্রুত করা উচিৎ। আমি যেটুকু জানি, অন্তর্বর্তী সরকার এসে বিদ্যুৎ খাতের বকেয়া প্রায় সবই পরিশোধ করেছেন। বকেয়া খুব একটা বেশি নাই। কিন্তু আলটিমেটলি ২০২৭ সালে গিয়ে ধরা খাবো সবাই। এখন যদি এই খাতকে টাইট না করি, তাহলে কিন্তু ২০২৭ সালের মধ্যে বিপদ এসে পড়বে। যেহেতু এটা পাবলিক প্রকিউরমেন্ট রুল ফলো করে নাই, সরকারের কাছে জনগণের অধিকার এই খাতকে বিশেষভাবে দেখার। তাহলে আমরা নাগরিক সমাজ এই জায়গায় কথা বলতে পারবো।
এই বিদ্যুৎ উন্নয়ন সাসটেইনেবল না, যে কোন সময় ধ্বসে পড়বে উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, আমাদের ফরেন এক্সচ্যাঞ্জে ঘাটতি পড়ে যাবে। টাকা ছাপানো হবে, টাকা ছাপায়ে ইনফ্লেশন বাড়বে৷ তাহলে চিন্তা করুন ২০২৭ সালে কি হবে বাংলাদেশের।
ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, ২০০৯ সালে দায়িত্ব গ্রহণের পর আওয়ামী লীগ সরকার বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতকে জনগণের চোখে ভেলকির মাধ্যমে পরিচালনা করে অর্থ লুটপাট এবং পাচারকে অন্যতম অগ্রাধিকার দেয়। শুরু থেকেই বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত ধ্বংসের লক্ষ্যে অত্যন্ত সুকৌশলে অবাস্তব মেজিক পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে উন্নয়নের নামে বিদেশে রোড-শো আয়োজন করা হয় উল্লেখ করে বিএনপির এই সিনিয়র নেতা বলেন, এর মাধ্যমে বিনিয়োগকারী, বৈদেশিক ঠিকাদার, ব্যাংক, এবং বিভিন্ন এজেন্ট সংগ্রহ করা হয়। পরে বলা হয়, বিদ্যুতের অপর্যাপ্ত সরবরাহের কারণে উচ্চ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা, দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচি, এবং কৃষি উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ফলে ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটানোর জন্য একের পর এক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের অনুমতি দেওয়া হয়। এর পিছনে উদ্দেশ্য ছিল জনগনকে ধোকা দিয়ে বিপুল পরিমাণ অর্থ লুটপাটসহ বিদেশে অর্থ পাচার করা।
বিদ্যুৎ খাত শুরু থেকেই অপরিকল্পিত ছিল জানিয়ে ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, ১৫ বছরে তিনটি মাস্টারপ্ল্যান তৈরি হলেও সেগুলোর বাস্তবায়ন হয়নি। বরং মাস্টারপ্ল্যান এড়িয়ে একের পর এক বিদ্যুৎকেন্দ্রের লাইসেন্স দেওয়া হয়। আর এসব বিষয় নিয়ে যাতে কোনো ধরনের আইনি প্রশ্ন না উঠে এজন্য ২০১০ সালেই বিতর্কিত দায়মুক্তি প্রণয়ন করে সরকার।
তিনি বলেন, বিদ্যুৎ সংকট মেটানোর নামে ২০০৯ সাল থেকে বেসরকারি খাতকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। ছোট-বড় প্রায় ১০০টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের লাইসেন্স দেওয়া হলেও এর অধিকাংশই অকার্যকর। তারপরও ডলারের রেটে ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করতে হয়েছে, যা বিদ্যুৎ খাতের জন্য 'লুটেরা মডেল' হিসেবে পরিচিত।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির এই সদস্য বলেন, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) দায়মুক্তি আইন ২০১০ বিদ্যুৎ খাতকে জবাবদিহিতার ঊর্ধ্বে নিয়ে গেছে। এই কারণে গত ২০১০-১১ অর্থবছর থেকে ১২ বছরে পিডিবি লোকসান গুণেছে ১ লাখ ৫ হাজার ৪১৯ কোটি টাকা। ২০২২-২৩ ও ২০২৩-২৪ অর্থবছর যোগ করলে লোকসান দাঁড়াবে ১ লাখ ১৩ হাজার ৫৩২ কোটি টাকা।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে খুশি করতে আদানি ও রিলাযেন্সকে ২টি বিদ্যুৎকেন্দ্র দেয়া হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, চুক্তির সব শর্ত হতে দেখা যায় আদানির বিদ্যুতের দাম পড়বে প্রতি ইউনিট ১৮ টাকা। ২৫ বছরে আদানিকে ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হবে ১১ বিলিয়ন ডলার। এছাড়াও প্রতি বছর কমপক্ষে ৫.৫০% হারে বাড়বে বিদ্যুতের দাম। ফলে ২০৪৭ সালে আদানির বিদ্যুতের দাম বেড়ে দাঁড়াবে ইউনিটপ্রতি ৩৬.৪১ টাকা।
গত ১২ বছরে বাল্ক বিদ্যুতের দাম ১০ বার বাড়ানো হয়েছে। গত ১৩ বছরে গ্রাহক পর্যাযে দাম বাড়ানো হযেছে ১১ বার। ফলে
বিদ্যুতের দাম বাল্কে বেড়েছে ১৮৩ ও গ্রাহক পর্যাযে ১১১ শতাংশ। যোগ করেন তিনি।
সংবাদ সম্মেলনে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের দুর্নীতি, পটুয়াখালীর পায়রায় নির্মিত ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্র সহ স্মর্ট মিটার প্রকল্পে দুর্নীতির মাধ্যমে জনগনের হাজার কোটি টাকা লুটপাটসহ পাচার করার অভিযোগ করেন তিনি।
তিনি বলেন, সঞ্চালন ব্যবস্থাপনা সঠিক ভাবে না করা হলে বাস্তবায়িত বা বাস্তবায়িতব্য মেগা প্রকল্প সহ রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প হতে উৎপাদিত বিদ্যুৎ গ্রীডে সংযোগ হলে যে কোনো সময় দেশ ঝুকির মধ্যে পড়তে পারে।
সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান।