জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের ছয় মাস পেরিয়ে যাওয়া দেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার একটা কঠিন সময়ে এসে উপনীত হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না।
শনিবার (৮ ফেব্রুয়ারি) জাতীয় প্রেসক্লাবের তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া হলে রাষ্ট্র সংস্কার ফোরামের আয়োজনে 'নির্বাচন সংস্কার বিশ্লেষণ' শিরোনামে আলোচনা সভায় তিনি এসব কথা বলেন।
মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ছয় মাস পরে এসে অন্তর্বতী সরকার একটা ক্রুশিয়াল টাইমে এসে পড়েছে। এটা তো সত্যি। উনি (প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস) দেশের অর্থনীতির অবস্থা ভালো করতে পারেন নাই। এত বড় অর্থনীতিবিদ! জিনিসের দাম কমাতে পারেন নাই। ইনভেস্টমেন্ট বাড়েনি, ইনকাম রেট বাড়েনি। দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি দুর্বল।
আশঙ্কা প্রকাশ করে মান্না বলেন, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে মানুষ যদি রাস্তায় নামে তবে এই সরকার কি তা থামাতে পারবে? কোনো একটি রাজনৈতিক দল যদি তা সমর্থন করে হরতাল ডাকে তবে তা মোকাবিলা করার জন্য কি পুলিশ নামবে? সরকার তো দুর্বল। এরকম সরকার দিয়ে তো দীর্ঘ দিন ভালো শাসন চালাতে পারবেন না। যখন তখন সেটা ভেঙে যেতে পারে।
তবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে সমর্থন জুগিয়ে যাওয়ার যৌক্তিকতায় মান্না বলেন, আমরা সরকারের সমালোচনা করি কিন্তু কাঠগড়ায় তুলি না। আমরা জানি এ সরকার পরাজিত হলে আমরাও পরাজিত হব।
জানা গেছে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ১৫টি সংস্কার কমিশনের মধ্যে ৬টির রিপোর্ট জমা হবে শিগগির। এ প্রসঙ্গে মান্না বলেন, এরপরে মূল কথা কী? ৬টা সংস্কার কমিশনের মধ্যে কমন কতগুলো কথা পাওয়া যায়। আলোচনা করে কতগুলোতে ঐক্যমত করা যায় তার ওপর নির্ভর করছে সংস্কারের সফলতা।
সংস্কার প্রস্তাবনা নিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল দ্বিমত পোষণ করছেন এমন পরিস্থিতিতে মান্না তার নিজস্ব ভাবনার কথা বিনিময় করে বলেন, সংস্কারের ওপর রাগটাগ করে লাভ নেই। সংস্কার সর্বাংশে ভালো জিনিস। সংস্কার করার ব্যাপারে সমগ্র জাতি এখন ঐক্যবদ্ধ আছে। প্রশ্নটা হলো সংস্কারটা কতখানি লাগবে। তবে ইউনূস সাহেব বলেছেন, সংস্কারের প্রশ্নে কোনো বিষয়ে ন্যূনতম যে ঐক্যমত হবে সরকার ততটুকু সংস্কার করবে। কোনো সংস্কার তিনি চাপিয়ে দেবেন না। এটাই ভাবনার ব্যাপার। কারণ আমাদের এমন একটা বিভাজিত দেশ। নিজেদের মধ্যে ঐক্যমত বলতে কিছু নাই। এ পর্যন্ত সংস্কার প্রসঙ্গে যত আলোচনা হয়েছে আমি একটা প্রসঙ্গে ঐক্যমত দেখতে পাচ্ছি, সেটা হল প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা কমাতে হবে। এর বাইরে অন্য কোনো বিষয়ে ঐক্যমত দেখানে যায়নি।
সংস্কার প্রস্তাবনায় গণতন্ত্রের উত্তরণের বিষয়টি সবচেয়ে গুরুত্ব দিয়ে দেখার পরামর্শ দেন বর্ষীয়ান এ রাজনীতিবিদ। তিনি বলেন, পুলিশ, ব্যুরোক্রেসি ও ইলেকশন কমিশন সংস্কার করেন তাহলে এটা নিয়ে বেশি বিতর্ক তৈরি হবে না।
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনের আগে গণঅভ্যুত্থানে পতিত আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনাসহ শীর্ষ নেতাদের বিচার প্রক্রিয়া শুরু করার দাবিও উঠেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্ল্যাটফর্ম থেকে। তবে কেবল এই প্রক্রিয়া নিয়ে ব্যস্ত থাকলে নির্বাচন আয়োজনে সময় লাগবে বলে মন্তব্য করেন মান্না।
তিনি বলেন, অনেকে দাবি করছেন আওয়ামী লীগের বিচার করতে হবে, তার আগে ভোট হবে না। কিন্তু দেখা গেলো বিচার করতে করতে ছয় বছর লেগে গেলো। তখন তো জনগণ মেনে নেবে না। তাই সবকিছু আবেগ দিয়ে, রাগ দিয়ে বিচার করলে হবে না।
সরকারের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, এ সরকারের কাছে বলব, এখনো সময় আছে এখনো যদি পুতুপুতু করেন, কিছু করতে পারবেন না। এখন তাদের ডিসাইসিভ (সিদ্ধান্তমূলক) রোল প্লে করতে হবে। এ কারণে যে খুব সম্প্রতি একটা অশুভ ইঙ্গিত পাওয়া গেছে।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাষণ নিয়ে যে উত্তেজনা বিরাজ করছে, তা প্রশমনের প্রচেষ্টা সরকারকে করতে হবে বলে মন্তব্য করেন মান্না।
তিনি বলেন, কেউ যদি উস্কানি দেন আর আপনি উসকান, আর এটা যদি প্রতি তিন মাস পরপর ঘটতে থাকে তো আগামী তিন বছরেও তো ভোট করতে পারবেন না। ভোট করতে তো একটা পরিবেশ লাগবে। আপনি জিততে চান, কিন্তু ফ্যাসিবাদের ওপর রাগ দেখিয়ে কি জিততে পারবেন? লড়াই করে, রক্ত দিয়ে যে বিজয় আমরা অর্জন করেছি, তা বুদ্ধি-স্থিরতা তথা ধী শক্তি দিয়ে রক্ষা করতে হবে।
আওয়ামী লীগের রাজনীতি কিভাবে মোকাবিলা করা যায় সে বিষয়েও পরামর্শ দেন নাগরিক ঐক্যের সভাপতি।
মাহমুদুর রহমান মান্না সরকারের উদ্দেশ্যে বলেন, আপনারা গ্রহণযোগ্য ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পথ রচনা করুন। তাহলে আওয়ামী লীগের মত ফ্যাসিবাদী একটি দল আর কোনোদিন জনগণের কাছে আসতে পারবে না। এমন একটি নির্বাচন আয়োজন করুন, যার ওপর দাঁড়িয়ে আগামী দিনের গণতন্ত্রের ভিত রচিত হয়।
গত ছয় মাসে সরকার রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে কোনো ডিসকোর্স করে নাই। এখন সেটা করে সংস্কার দ্রুত এগিয়ে নিন। আমি এ কথা কখনো বলব না যে আগে সংস্কার করুন তারপরে ভোট।