শাহাদাতের ‘সিনেমা’ শেষ!
ক্রিকেটার হলেও হাঁটাচলা, কথাবার্তা এমনকি চুলের স্টাইলে সিনেমাটিক একটা ব্যাপার ছিল তার মধ্যে। ক্রিকেটার শাহাদাত হোসেন নিজের সেই সিনেমাটিকসুলভ ভাবভঙ্গি খুব উপভোগও করতেন। শুধু করতেন বলাটা ভুল হবে। নায়কগিরি নিয়ে তিনি বেশ মজেও ছিলেন।
একটা উদাহরণ দেই।
২০০৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহ। ঢাকার মিরপুরের হোম অব ক্রিকেটে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে টেস্টে খেলছে বাংলাদেশ দল। প্রথম ইনিংসে বাংলাদেশ গুটিয়ে যায় ১৯২ রানে। জবাবে দক্ষিণ আফ্রিকার ইনিংস শেষ আরও কম রানে, ১৭০ তে! আর এই ইনিংসে শাহাদাত হোসেন সেরা বোলার। ১৫.৩ ওভারে ৮ মেডেনসহ ২৭ রান খরচায় তার শিকার ৬ উইকেট। এখন পর্যন্ত টেস্ট ক্রিকেটে এক ইনিংসে বাংলাদেশের কোন পেসারের সেরা বোলিং ওটাই!
দুর্দান্ত সেই সাফল্য শেষে সংবাদ সম্মেলনে এলেন শাহাদাত। চুল পানিতে ভেজা। ব্যাকব্রাশ করা। হাতে পানির বোতল। সংবাদ সম্মেলন কক্ষে প্রবেশ করলেন একটু হেলেদুলে। যুদ্ধজয়ের তৃপ্তির ছটা ঠিকরে বেরুচ্ছে তার প্রতিটি নড়াচড়ায়! লম্বা সংবাদ সম্মেলন শেষে বেরিয়ে যাওয়ার সময় আরেকটা প্রশ্ন-‘ম্যাচের এই পরিস্থিতিকে আপনি কিভাবে ব্যাখা করবেন?’
সেসময় শাহরুখ খান ও দীপিকা পাড়ুকোনের ওম শান্তি ওম সিনেমাটা সুপারহিট। বলিউডের সেই সিনেমার একটা সংলাপ অনুকরণ করে শাহাদাত বেরিয়ে যেতে যেতে বলেন-‘পিকচার আভি তাক বাকি হ্যায় মেরে দোসত!’
হো হো করে হাসির রোল উঠে সংবাদ সম্মেলনে।
তবে সেই ম্যাচ শেষের পিকচার জানাল-বাংলাদেশের হার। দক্ষিণ আফ্রিকা টেস্ট ম্যাচ জিতে নেয় ৫ উইকেটে। সেটা ছিল পেসার শাহাদাত হোসেনের টেস্ট ক্যারিয়ারের ১৪ নম্বর ম্যাচ। ২০০৫ সালে লর্ডসে টেস্ট অভিষেক হয়েছিল তার। সেই টেস্টে মাত্র ১২ ওভারে ১০১ রানের খরচা গুনলেও কোন উইকেট পাননি।
তবে ক্যারিয়ারের বাকি সময়েও কিছু সিনোমাটিক ব্যাপার ঘটেছে তার। অভিষেকের পাঁচ বছর পর লর্ডসে আবার টেস্ট খেলতে নামেন। এবং ইনিংসে পাঁচ উইকেট নিয়ে অর্নাস বোর্ডে নাম লেখান। তবে ক্রিকেটার হিসেবে মাঠের পারফরমেন্সে সেটাই তার শেষ ধার।
পরের কাহিনী শুধু মরচে পড়া। ফ্লপ সিনেমা!
ক্যারিয়ারের শেষের ১০ টেস্টে তার শিকার মাত্র ৭ উইকেট। আর জাতীয় দল থেকে বাদ পড়ার পর মাঠে এবং মাঠের বাইরে এখন পর্যন্ত যা করেছেন তা কোনমতেই নায়কের নয়, পুরাই ভিলেন!
আর তাতেই শেষ তার ‘সিনেমা’!
একটু সেই বর্ননায় যাই।
২০১৫ সালের অক্টেবরের প্রথম সপ্তাহে তাকে স্ত্রীসহ জেলে যেতে হয়। অভিযোগ গুরুতর। বাসার ১১ বছর বয়সী কাজের মেয়েশিশুকে অমানবিক কায়দায় নির্যাতন করেন শাহাদাত ও তার স্ত্রী। অভিযোগ উঠে-বেত এবং খুন্তি দিয়ে নিয়মিত বাসার কাজের সেই শিশুকে নির্যাতন করতেন শাহাদাত দম্পতি। নির্যাতনে প্রায় অর্ধমৃত অবস্থায় সেই শিশুকে পথচারীরা উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করে। শিশু নির্যাতনের মামলা হয় শাহাদাত দম্পতির নামে। গ্রেফতার এড়াতে পালিয়ে থাকেন তারা দুজনে। পরে আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। জামিনের আবেদন বাতিল করে তাদের দুজনকে আদালত কারাগারে প্রেরণের নির্দেশ দেন। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) সেসময় শাহাদাতকে সব ধরনের ক্রিকেটে নিষিদ্ধ করে। বিসিবি জানিয়ে দেয়-অভিযোগ থেকে মুক্তি না পাওয়া পর্যন্ত তিনি ক্রিকেটে নিষিদ্ধ থাকবেন। বেশকিছুদিন কারাভোগ করার পর মামলা প্রত্যাহারের আপোষ রফায় পৌঁছাতে সক্ষম হন শাহাদাত দম্পতি। জানা যায় এই আপোষের জন্য ১২ লাখ টাকা খরচ গুনতে হয়েছিল শাহাদাত হোসেনকে।
তবে জাতীয় দলে আর কোনদিনই ফেরা হয়নি তার। ঘরোয়া ক্রিকেট খেলে রোজগেরে জীবন কাটে। মুলত উচ্চতা এবং জোরে বোলিংয়ের কার্যকারিতা-এই দুই গুনেই এতদিন জাতীয় দলে খেলে গেছেন শাহাদাত হোসেন। কিন্তু ক্রিকেটের জন্য যে মস্তিস্কেরও প্রয়োজন হয়- সেটাই যে তার জানা হয়ে উঠলো না।
মাশরাফির পর টেস্টে বাংলাদেশের পেসারদের মধ্যে তার উইকেট শিকারই সবচেয়ে বেশি। কিন্তু পেস বোলিংয়ের জন্য যে ফিটনেস, উৎকর্ষতা, নিয়মানুবর্তিতা, খাদ্যাভাস এবং প্রতিনিয়ত শেখার তাগিদ-তার কোনটিই ধরে রাখতে পারেননি শাহাদাত হোসেন।
যা পেরেছেন তার নাম হম্বিতম্বি। গ্যালারি শো। এবং মানুষের সঙ্গে ক্রমশ অভব্য ও অসধাচারণ করা। রাস্তায় গাড়ি থামিয়ে সিএনজি চালকের কলার চেপে ধরে তাকে ধাক্কাধাক্কি দেয়ার মধ্যে তিনি ‘নায়কোচিত সুখ’ খুঁজতে চেয়েছেন। ডায়লগ তার-‘‘আমি তোকে মেরেছি। পারলে তুই আমাকে মার!’’
সতীর্থ ক্রিকেটারকে- ‘‘এই তুই বল ঘষে দে, আমি বোলিংয়ে যাবো’’-জমিদারি স্টাইলে এমন নির্দেশনামা দিয়েছেন। সেই নির্দেশ পালন না হওয়ায় মাঠের মধ্যেই তারচেয়ে অর্ধেক বয়সী ক্রিকেটারকে মারধর করেছেন। তারই শাস্তি হিসেবে এখন ক্রিকেট বোর্ডের নতুন নিষেধাজ্ঞা তার বিরুদ্ধে।
লর্ডসে ক্রিকেট অভিষেক। ৩৮ টেস্টে ৭২ উইকেট। গৃহকর্মী নির্যাতনে জেলজীবন। জাতীয় দল থেকে বাদ। ঘরোয়া ক্রিকেটে ন্যুব্জ পারফরমেন্স। অসামাজিক আচরণ। সবশেষে সতীর্থের গায়ে হাত তুলে আবার নিষিদ্ধ।
দুঃখিত শাহাদাত; পিকচার তো খতম!