বেলাভূমিতে বাড়ছে টুরিস্টদের উৎপাত, করোনার আশঙ্কা উড়িয়ে সাগরে হুল্লোড়

  • জাওয়াদ হোসাইন, কক্সবাজার থেকে
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত/ছবি: বার্তা২৪.কম

কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত/ছবি: বার্তা২৪.কম

দেশের পর্যটকদের স্রোত এখন কক্সবাজারমুখী। করোনাকালে ঘরবন্দী মানুষের উড়ুউড়ু মন আর পাঁচমাসের অচলাবস্থার মুখে বাঁধভাঙা জোয়ার এসেছে বাংলাদেশের শীর্ষ ভ্রমণস্পট কক্সবাজারে। করোনার আশঙ্কাকে তুড়ি মেরে ছুটছে সবাই সাগরের নীল জলের দিকে।

করোনার সংক্রমণ ঠেকাতে গত ১৮ মার্চ থেকে দেশের সব পর্যটনকেন্দ্রেতে প্রবেশের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। এই নিষেধাজ্ঞার তালিকায় রয়েছে পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত কক্সবাজারও। ফলে পাঁচমাসের করোনাকালে কোলাহলহীন সৈকত ‘রিস্টার্ট’ নিয়েছে। কিন্তু গত একসপ্তাহের চিত্র ও দুই দিনের সরেজমিন পর্যবেক্ষণ বলছে, সৈকত রাজ্যের সুনসান নীরবতার সবুজ গালিচা ভেঙে দিয়েছে মাতোয়ারা পর্যটকের দল।

বিজ্ঞাপন
 ছুটছে সবাই সাগরের নীল জলের দিকে

আজ থেকে ঠিক পাঁচমাস আগে মার্চের ৮ তারিখ বাংলাদেশে প্রথম করোনার প্রাদুর্ভাব ছড়ায়। সেই করোনাভাইরাস বিশ্ববিপর্যস্ত করে থাবা মেলেছে বাংলাদেশেও। লকডাউন ও হোমকোয়ারিন্টিনের মাধ্যমে করোনার শৃঙ্খল ভাঙা যায়নি, বরং বেড়েছে হু হু করে। এ নিয়ে দেশে করোনায় মোট মৃতের সংখ্যা ৩ হাজার ৩৯৯ জন। আর মোট শনাক্তের সংখ্যা ২ লাখ ৫৭ হাজার ৬০০ জন।

শনিবার দুপুরে পুরোদস্তুর করোনার থাবার মধ্যে মহাসড়কে দাঁড়িয়ে দেখা গেছে সাগর অভিমুখে অসংখ্য ধাবমান গাড়ি। শোঁ শোঁ শব্দে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে সব গাড়ি। উফ, যেন ভাইরাসের গতিকে টেক্কা দিচ্ছে, পিলে চমকে যায়। করোনাকালে নীরবতার সাগরপাড় আবারো সরব হয়ে উঠেছে। কিন্তু কথা থেকে যায়, সবই ঘটছে সরকারি নির্দেশনা অমান্য করে! এদিকে প্রশাসন বলছে, আগামী দুয়েকদিনের মধ্যে মনিটরিং টিম করা হবে।

বিজ্ঞাপন

৮ ও ৯ আগস্ট গত দুই দিন কক্সবাজার সরেজমিন পরিদর্শনে দেখা যায়, সমুদ্র সৈকত খুলে দেওয়ার নির্ধারিত সময়ের আগেই ভিড় জমিয়েছেন দর্শনার্থীরা। স্বাস্থ্যবিধি মানার নির্দেশনাকে তোয়াক্কা করছেন না অনেকেই। এমনকি জোয়ার-ভাটার নিয়ম না মেনেও সাগরে নামছেন পর্যটক। সৈকতে পুলিশ ও লাইফগার্ডদের তৎপরতা নেই বললেই চলে। আশঙ্কা রয়েছে, যে কোনো সময় ঘটতে পারে বড় ধরনের দুর্ঘটনা।

স্থানীয় প্রশাসন বলছে, তারা বিষয়টি গুরুত্বের সাথে নিচ্ছে। এই প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ কামাল হোসেন রোববার নিজ কার্যালয়ে প্রতিবেদককে বলেন, ‘জেলা করোনা প্রতিরোধ কমিটির মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিলো স্বাস্থ্যবিধি মেনেই ১৭ আগস্টের পর সীমিত আকারে সৈকত খুলে দেয়া হবে। যদিও অনেকেই ভিড় করেছেন। স্থানীয় জনগণদের ওপর আইন প্রয়োগ করতে চাইনি, আমরা মোটিভেট করতে চেয়েছি। ১৭ তারিখের পর নির্দেশনা না মানলে আমরা হোটেল-মোটেলে অভিযান চালিয়ে আইন প্রয়োগ করবো।’ তিনি আরো বলেন, আগস্ট মাসে করোনা সচেতনতা সৃষ্টির জন্য ৫ লক্ষ মাস্ক বিতরণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। নিয়মিত মোবাইল কোর্ট চলবে বলেও জানান তিনি।

কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ কামাল হোসেন

প্রসঙ্গত, মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহে বাংলাদেশে প্রথম করোনা শনাক্ত হয়। এরপর সবধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা দেয় সরকার। হঠাৎ করে ছুটি পেয়ে সেসময়ে সৈকতে দল বেঁধে পর্যটক আসতে শুরু করে। যদিও পরবর্তীতে সংক্রমণ এড়াতে কয়েক ধাপে সৈকতে পর্যটকদের ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা জারি হয়। দেশের অন্যান্য পর্যটনকেন্দ্রগুলোসহ কক্সবাজারের সব হোটেল-মোটেল পুরোপুরি বন্ধ ঘোষণা করে প্রশাসন। ফলে কিছুটা নিজস্ব ছন্দে ফিরে গিয়েছিলো এই সাগরপাড়। কিন্তু পাঁচ মাস বয়সী করোনাভাইরাসকে ভয় নেই বাঙালির। রোববার (৯ আগস্ট) দুপুরে মহাখালী থেকে নিয়মিত স্বাস্থ্য বুলেটিনে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা.নাসিমা সুলতানা যখন পড়ছেন- দেশে গত ২৪ ঘণ্টায় করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ৩৪ জন এবং শনাক্ত হয়েছে ২ হাজার ৪৮৭ জন’ তখন দেশের সর্বদক্ষিণপ্রান্তে চলছে সাগরপাড়ে মহাকল্লোল!

করোনাকালে কক্সবাজারকে ঘিরে আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হচ্ছে এখানকার হোটেল মালিক থেকে শুরু করে বিভিন্ন ব্যবসায়ীদের। সে বিষয়টিকে বিবেচানায় রেখে বন্ধের দীর্ঘ সময় পর আগামী ১৭ আগস্ট কক্সবাজারের পর্যটন কেন্দ্রগুলো ও আবাসিক হোটেল সীমিত পরিসরে খুলে দেয়ার ঘোষণা দেয় জেলা প্রশাসন। গত ৫ আগস্ট অনলাইন মিটিংয়ের মাধ্যমে করোনাভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধ কমিটির এক সভায় এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। ঘোষণার পর থেকে খোলার নির্ধারিত সময়ের আগেই কক্সবাজার সৈকতে পর্যটকেরা আসতে শুরু করেছে। অধিকাংশ হোটেল গুলোও প্রশাসনকে ফাঁকি দিয়ে তারা তাদের মতো করে পর্যটকদের হোটেল ভাড়া দিচ্ছে।

সুষমা ও সৌন্দর্যরাশি উপেক্ষা করার লোভ সামলানো কঠিন

হোটেল বে মেরিনার পরিচালক আবু নাঈম মুহাম্মদ হারুন প্রতিবেদককে বলেন, ‘আমরা জেলা প্রশাসনের গাইডলাইন বা নির্দেশনা মানবো। পর্যটকদের শতভাগ নিরাপদ রাখাই আমাদের প্রধান বিবেচ্য। আমরা হোটেলকে যথাযথভাবে জীবাণুমুক্ত করে নতুন পর্যটকদের জন্য স্বাগত জানাবো। ১৭ই আগস্টের আগে যেন কোন পর্যটক যেন না আসে সেটার জন্য প্রচার দরকার। আমরা সরকারের নির্দেশনা মেনে ১৭ আগস্টের আগে কোনভাবেই অতিথি গ্রহণ করছি না। কারণ ব্যবসার আগে স্বাস্থ্যের নিরাপত্তটা বেশি জরুরি।’

শনিবার গাড়ি থেকে নেমেই সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে এগিয়ে চললাম হোটেলের দিকে। তীর্থের কাকের মতন অতিথির অপেক্ষা করছে হোটেল মালিকরা। সাংবাদিক পরিচয় দিলে, কিছুটা ভ্রু কুঁচকালেও, হোটেলে রুম পেতে সমস্যা হয়নি। হোটেল ছেড়ে সাগরপাড়ে ঝাউয়ের বনে পা রাখতেই নোনা বাতাসের শনশন শব্দ শুনতে পেলাম। কিন্তু কাছে যেতেই টের পেলাম, সেই শব্দে ভাগ বসালো জনতার কোলাহল। দামাল ছেলের দল মেতে উঠছে ফুটবল খেলায়। সাগরবেলা কি আবারো মুখর হয়ে উঠেছে? প্রশ্ন উঠেছে, এসময় মোহময় নির্জন সাগরবেলার শান্ত ঢেউ দেখতে আসা কতটুকু স্বাস্থ্যসম্মত?

সৈকতে আসা একদল পর্যটক

পুরো দেশ যখন করোনায় আক্রান্ত ও মারা যাওয়া মানুষের হিসাব নিয়ে হিমশিম, সেখানে কক্সবাজারের প্রতি পর্যটকদের যেন উল্টোযাত্রা। বিন্দুমাত্র উদ্বিগ্ন নয় এমন বহু পর্যটকের দেখা মিলেছে। তেমনিই কয়েকজনকে দেখা গেলো ঢাকার সাভার থেকে আসা একদল পর্যটক। প্রতিবেদকের সাথে ভিডিও ইন্টারভিউ দেয়ার সময়ও ছয়জনকে দেখা যায় গাদাগাদি করে দাঁড়িয়ে বলছেন, ‘আসলে অনেকদিন পর পুনরায় একত্র হতে পেরেছি আমরা। মনের আবেগ ধরে রাখতে পারিনি। আমাদের জন্য দোয়া করবেন যেন করোনা না হয়।’ ১৭ তারিখ পর্যন্ত সৈকত ব্যবহারের নির্দেশনা প্রসঙ্গে তারা বলেন, এ ব্যাপারে তারা কিছুই জানতেন না।

শুধু কি ঢাকা? না, কুমিল্লা, সিলেট, চট্টগ্রামসহ সারা দেশ থেকেই মোটামুটি সাগরপাড়ে বেড়াতে আসছে মানুষ। ফের কি শুরু হলো মনুষ্য তাণ্ডব? আড়াল-আবডাল ভেঙ্গে ফের কি জাগরণের খেলা? হোটেল-মোটেলগুলোর নীরবতা ভাঙ্গার আয়োজন দেখে সেটাই মনে হওয়া স্বাভাবিক। কারণ নির্জন, কোলাহলমুক্ত পরিবেশে মায়াময় প্রকৃতির মাঝে সুষমা ও সৌন্দর্যরাশি উপেক্ষা করার লোভ সামলানো কঠিন। হোটেল মোটেল কি বিধিসম্মতভাবে প্রস্তুত ছোঁয়াচে ভাইরাস ঠেকাতে?

 লোকে লোকারণ্য সৈকত

শনিবারের সৈকত ছিলো লোকে লোকারণ্য। অধিকাংশের মধ্যেই ছিলো না স্বাস্থ্যবিধি মানার চিহ্ন। মারণ ভাইরাস করোনার ভয়ংকর ছোবলে বিশ্বজুড়ে মানুষ যখন ভীত সন্ত্রস্ত, তখন ত্রাহি রূপ নয়, প্রকৃতির অপরূপ দৃশ্যই হয়ে উঠছে পরম আরাধ্য। কতটুকু নিরাপত্তা রয়েছে বেলাভূমিতে? কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ কামাল হোসেন বলছেন, ‘লাইফ গার্ড নিয়ে যারা কাজ করছে চাহিদার তুলনায় অনেক কম। যারা পর্যটক আসবেন তাঁদের সচেতনতাও গুরুত্বপূর্ণ। যারা এতদূর থেকে কক্সবাজার আসছেন, তারা নিশ্চয়ই জোয়ার ভাটার হিসাব বুঝবেন, সম্ভাব্য বিপদ বুঝে নিজেরা সচেতন হবেন, আমাদেরও সহযোগিতা করবেন।’

চট্টগ্রামের চারদেয়ালে পাঁচমাসের বন্দী দশ থেকে মুক্তি পেয়ে কক্সবাজার ছুটে এসেছন কয়েকজন। কথা হলো প্রতিবেদকের সাথে। যাদের দেখে মনে হয়, শ্রাবণের ‘প্রখর তপন তাপে’ আপাত ক’দিনের গন্তব্য ঠিক করেছেন এই বেলাভূমিতে। সাথে থাকলো ঈদ উল আযহায় অবসরের ঠেক! আবার পেশাগত কাজেও কক্সবাজারে ছুটে এসেছেন অনেকেই। তেমনিই দুজন সাংবাদিক ঢাকার একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলের সিনিয়র সাংবাদিক মহসিন উল হাকিম এবং চট্টগ্রামের একটি অনলাইন পোর্টালের দায়িত্বে থাকা সাংবাদিক পার্থ প্রতীম নন্দী। দেখা গেছে, স্বাস্থ্যবিধি মেনেই পেশাগত কাজ করছেন তারা।

স্থানীয়রা অনেকেই বলছেন, গত পাঁচমাসে সৈকত তার নিজের নিয়মে চলেছে। সকালে গাছগাছালির ছায়া-মায়ায় শোনা গেছে পাখপাখালির কুজন, বেলাভূমিতে ফিরে এসেছে নির্ভিক শুশুক আর ডলফিন। মানুষের টহল থেমে যাওয়ায় জল ফুঁড়ে গলা উঁচিয়ে নিজের উপস্থিতি জানান দিয়েছে বহু কাছিম। কিন্তু গত এক সপ্তাহের লোকারণ্য ও জনকোলাহল ফের পুরানো কক্সবাজারকেই যেন হাজির করেছে।

রোববার (৯ আগস্ট) ‘ঠিক সন্ধ্যে নামার মুখে’ আকাশের পশ্চিমপাড় সেজে উঠেছে সূর্যাস্তের আড়ম্বরে। মায়াবী অনির্বচনীয় আলোয় নিরালা সৈকতে নেমে এসেছে নীরবতা। তাতে বুঁদ হয়ে থাকতে দেখা গেলো কোন কোন দম্পতিকেও! শ্রাবণের ঘরঘোর বরিষণে যেন রবিঠাকুরের ‘শেষের কবিতা’ আওরে একে অন্যকে বলছে- “পথ বেঁধে দিল বন্ধনহীন গ্রন্থি, আমরা দুজন চলতি হাওয়ার পন্থী।”

হ্যাঁ, করোনার বিস্তৃত থাবাকে উপেক্ষা করে এভাবেই বেড়ে চলছে বেলাভূমিতে উৎপাত। ফলে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সমুদ্র সৈকতে দাঁড়িয়ে যে প্রশ্নটি সবার আগে আসবে তা হলো- করোনাকালে বদলে যাওয়া পৃথিবীর ‘নিউ নরমাল’ লাইফে কক্সবাজার কতটুকু প্রস্তুত? ১৭ আগস্টের পর কেমন হবে সৈকতের চেহারা? একসপ্তাহ হাতে রেখে করোনাকে তুরী মেরে পাল্টা চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিচ্ছে যেন সাগরকন্যা কক্সবাজার! যদিও নির্জন বালির বেলাভূমিতে বাড়ছে টুরিস্টদের উৎপাত, করোনার আশঙ্কা উড়িয়ে চলছে সাগরপাড়ে তুমুল হুল্লোড়।