এজেন্সির প্রতারণা: মক্কা হজ অফিসে অভিযোগের পাহাড়
মক্কা মোকাররমা (সৌদি আরব) থেকে: অনিয়ম, প্রতারণা তো রয়েছেই। তার সঙ্গে হজ এজেন্সিগুলোর বিরুদ্ধে যুক্ত হয়েছে ‘মা হাজীদের’ গলা ধাক্বা দেওয়ার ঘটনা।
পবিত্র হজপালনে মক্কায় এসে থাকার রুম না দিয়ে খোলা আকাশের নিচে রাখার মতো অভিনব প্রতারণার সব ঘটনা লিপিবদ্ধ হচ্ছে অভিযোগের খাতায়। দিন যাচ্ছে, অভিযোগের সংখ্যা বাড়ছে মক্কায় অবস্থিত হজ মিশনের অভিযোগের বাক্সে।
সূত্র বলছে, মোয়াল্লেম ইন্টারন্যাশনাল নামের এজেন্সির বিরুদ্ধে এ এল এম কাওসার আহমেদসহ একাধিক হাজীর অভিযোগ, হজ পালনের সময় অব্যবস্থাপনার অভিযোগ করায় মিনার তাঁবু থেকে গলা ধাক্কা দিয়ে বের করে দেওয়া হয় নুরুন নাহার নামের এক মা হাজীকে। হজ মিশনে নারী হাজীদের সন্মান দিয়ে ‘মা হাজী’ ডাকা হয়। অভিযুক্ত এজেন্সির লাইসেন্স নম্বর- ১১৭৮।
সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরের এস এম ট্রাভেলস ইন্টারন্যাশনাল ও এস এম ফরহাদ আলী ট্রাভেল নামের দু’টি এজেন্সির ব্যবস্থাপনায় আসা হজযাত্রীরা লিখিত অভিযোগ করে বলেছেন, তারা দেশ থেকে এসে হোটেলের কক্ষ পাননি। খোলা আকাশের নিচে মানবেতর পরিবেশে থাকতে হয়েছে তাদের। এদের লাইসেন্স নম্বর যথাক্রমে- ১১৩২ ও ১১৩৩।
এমন অসংখ্য অনেক অভিযোগ প্রতিদিন লিপিবদ্ধ হচ্ছে হজ মিশনের খাতায়।
রুস্তম আলী নামের একজন হাজী অভিযোগ করেন, আমরা অভিযোগ করার পর প্রশাসনিক একটি দল যখন আমাদের হোটেলে এলো- তখন দলটিকে জামাই-আদরে আপ্যায়ন করার জন্যে উঠে পড়ে লেগে গেলেন এজেন্সির মালিক ও তাদের প্রতিনিধিরা।
এর মধ্যে হাজীদের একটি অংশকে হাত করে আমাদের কোনঠাসা এমনভাবে করা হলো- যাতে মনে হয় অভিযোগ করে আমরা ভুলই করে ফেলেছি।
মাকসুদুর রহমান নামের আরেক হাজী জানান, তাদের ব্যবস্থাপনার চিত্র সরজমিনে দেখতে আসা হজ প্রশাসনিক দলকে খুশি করতে এজেন্সি মালিক দৌড়াদৌড়ি শুরু করলেন। কেউ কোক আনেন তো কেউ পেপসি!
যদিও সেই প্রতিনিধি দলে থাকা যুগ্মসচিব পর্যায়ের একজন কর্মকর্তা কোনো আপ্যায়ন গ্রহণ করেননি। তবে তাদের তুষ্টি অর্জনে এজেন্সি মালিকদের তোড়জোড় দেখে হাজীরা আর নিজেদের সমস্যার কথা বলেননি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন এজেন্সি মালিকের প্রতিনিধি জানান, হাজী আনাটা আমাদের ব্যবসা। ২০১৯ সালের নিবন্ধনের কোটা শেষ। আগামীবারের হাজী রিজার্ভ আছে। এদের অভিযোগ সব আমলে নিলে ব্যবসা গুটিয়ে বসে থাকতে হবে। তারচেয়ে প্রশাসন হাতে থাকলে সুবিধা। এদের খাতির করাটাও এক ধরণের বিনিয়োগ। এতে লাভ ছাড়া কোনো ক্ষতি নেই।
দেলোয়ার হোসেন নামের এক হাজী জানান, তিনি অভিযোগ দায়েরের ভাষাই হারিয়ে ফেলেছেন।
কেন?
আসর ও মাগরিবের ওয়াক্তে আমাদের হোটেলে বিশেষ বয়ান হয়। এতে বলা হয়েছে, হজে যত কষ্ট হবে- তত সওয়াব। হজটা আরাম-আয়েশের বিষয় নয়। যারা পরহেজগার তারা সব কষ্ট সহ্য করে হজকে পরিপূর্ণ করবে।
আবার বয়ান শেষে এজেন্সি মালিক নিজেই মোনাজাত ধরে বলেন, হে আল্লাহ! তোমার মেহমান হাজী সাহেবদের খেদমতে কোনো ভুল-ক্রুটি হলে আমাদের ক্ষমা করে দিয়ো।
তো আমি যখন সেই মোনাজাতে হাত তুলে আমিন বলি, তখন কি করে আর তাদের অব্যবস্থাপনা সম্পর্কে অভিযোগ করি!
হাজীদের অভিযোগ প্রসঙ্গে ধর্ম সচিব মো. আনিসুর রহমান বলেন, এবার ব্যবস্থাপনার দিকে কঠোর নজরদারী থাকায় অভিযোগ তুলনামূলক কিছুটা কম।
অভিযোগের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে হজ এজেন্সিজ এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (হাব) মহাসচিব শাহাদাত হোসাইন তসলিম জানান, অভিযোগ আসা মাত্রই সেটা সমাধান করা হচ্ছে। মক্কায় অবস্থান করে আমি নিজেও গুরুতর বেশ কয়েকটি অভিযোগের সমাধান করেছি।
তবে হজ মিশনে দায়েরকৃত অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইতে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মকর্তা জানান, এবার ৫২৮টি হজ এজেন্সির মধ্যে গড়পড়তায় ২৮টি এজেন্সির অনিয়ম ও প্রতারণায় আমরা বিব্রত।
তার ভাষায়, আগে জানতাম- একশ’ অমানুষ মরলে একটা শকুন হয়, কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, একশ’ শকুন মরলে একটা দুষ্টু হজ এজেন্সির মালিক হয়।
আমি বুঝি না, কি করে তারা এই পবিত্র কাবার শহরে আল্লাহর মেহমানদের সঙ্গে প্রতারণা করেন। এভাবে প্রতারণার অর্থ কিভাবে তাদের হজম হয়?