নিস্তার নেই, ঘাটে ঘাটে হজ এজেন্সির প্রতারণা!
মক্কা মোকাররমা (সৌদি আরব) থেকে: বেশ কয়েক বছর টিপে টিপে হাত খরচ করেছেন তিনি। অর্থ জমিয়ে জমিয়ে সঞ্চয় করেছিলেন তিন থেকে তিন লাখ টাকা। এটুকু সঞ্চয়েই ক্লান্তি ভর করেছিলো। বলেছিলেন, আর সঙ্গতি নেই! কিন্তু না। আরও ৫ হাজার টাকা চাই! ওটাই যেন যক্ষের ধন! আকুতি জানিয়েও ৫ হাজার টাকার ছাড় পাননি।
নাছোড়বান্দা হজ এজেন্সি সাকুল্যে ৩ লাখ ৫ হাজার টাকা নিলো তো নিলোই! তবে সমস্যা হলো- দুই বিছানায় তিনজন। হজ করতে এসে পবিত্র মক্কায় এভাবেই দিন কাটছে জামালপুরের আকমত আলির।
কোনটা নিয়ম আর কোনটা অনিয়ম তা জানেন না সত্তরোর্ধ্ব আকমত আলি। সৌদির ওমরা ও হজ মন্ত্রণালয়ের নীতিমালার চরম বরখেলাম দুই বিছানায় তিনজন। এটা জানার কথাও নয় তার। তবুও নেই কোনো অভিযোগ বা আক্ষেপ। বরং নিয়তি হিসেবে অব্যবস্থাপনার সবকিছুই মেনে নিয়েছেন এই হাজী।
এমনিতেই সিঙ্গেল বেড। একজনের জন্যেই কেমন যেন! বেশ সরু বিছানা। ঘুমের ঘোরে মোচড় বা গড়াগড়ি দেবার অভ্যাস থাকলে কেল্লা ফতে। সটান গড়িয়ে পড়তে হবে ফ্লোরে।
এরকম দু’টো বিছানা যুক্ত করে শয়নের ব্যবস্থা করা হয়েছে তিন জনের।
-কষ্ট হয় না?
‘না বাবা! কখনও এক কাইত করে শুই। আবার কেউ বাইরে গেলে একটু আরাম করে ঘুমাই’- মলিন মুখে বলেন আকমত আলী।
মক্কার মেসফালার নজুম আল মেসফালাহ হোটেল-৫ এর নিচ তলায় ঠাঁই হয়েছে এই হাজীর। এক রুমে গাদাগাদি করে রাখা হয়েছে নয়টি বেড। তার মধ্যে দু’টি বেড একত্র করে শয়নের ব্যবস্থা করা হয়েছে তিন জনের। ফ্লোরে অবশিষ্ট জায়গা নেই। স্থানাভাবে লাগেজ জায়গা করে নিয়েছে বেডে।
চাচা হজ কেমন করলেন? খুব ভালো, সরল উত্তর দেন তিনি।
কোনো সমস্যা নেই তো?
‘না বাবা। আল্লাহর মেহেরবানি। সহি-সালামতেই হজ করাইছে। আমরা ভালো আছি।’
জামালপুর জেলার দেওয়ানগঞ্জ কাঠারবিল এলাকার আকমত আলীর মতো আক্ষেপ আর অভিযোগহীন হাজীদের একটি বড় অংশের কারনে এবার বেশ তুষ্টিতে বাংলাদেশের হজ মিশন ও ধর্ম মন্ত্রণালয়।
কেবল কি আকমত আলী? না, আর্থিক প্রতারণা- দূর্বিসহ কষ্ট সয়েও তার মতো অনেকে নীরবে হজ শেষ করে প্রতীক্ষায় আছেন দেশে ফেরার। অনেকে অভিযোগ না দিলেও হজ এজেন্সি সংশ্লিষ্টদের প্রতি অভিসম্পাত দিয়ে ফিরে গেছেন দেশে।
যেমন বাংলাদেশ অর্থোপেডিক সোসাইটির সদ্য সাবেক মহাসচিব, জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন কেন্দ্র-নিটোরের (পঙ্গু হাসপাতালের) একাডেমিক ডাইরেক্টর অধ্যাপক ডা. সৈয়দ শহিদুল ইসলাম সহিদ কিংবা ঢাকার ব্যবসায়ি সেলিম নয়ন।
তাদের দূর্বিসহ যন্ত্রণা আর অন্তহীন প্রতারণার সাক্ষী মক্কা। কোনো কোনোটি আবার হাব জানলেও এমন অধিকাংশই কোনো অভিযোগের স্বাক্ষর নেই হজ মিশনে।
প্রতি ৪৫ জন হাজীর জন্যে একজন করে গাইড থাকার কথা। পরিবেশসম্মত পরিবেশ, মানসম্মত খাবার-দাবার কিংবা সহজ যাতায়াত ব্যবস্থাপনা- এমন প্রতিশ্রুতি ঢাকাতে থাকলেও মক্কায় তার ছিটেফোঁটাও পাননি হাজীদের অনেকে।
প্রতি ৪৫ জন হাজীর জন্যে একজন করে গাইডের বিষয়টি যেন কাজীর গরু। কেতাবে আছে, গোয়ালে নেই।
আকমত আলী এসেছেন শফিক ওভারসিজ নামের হজ এজেন্সির মাধ্যমে। যার লাইসেন্স ১৪১৫ আর মক্তব নম্বর ১২৫।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক হজ এজেন্সির মালিক জানান, গ্রামের দরিদ্র মানুষগুলো স্থানীয় মসজিদের ইমাম বা মুয়াজ্জিন ধরে আমাদের কাছে আসে। হাজী সংগ্রহের জন্যে তাদের সন্মানজনক অর্থ দিতে হয়।
দিন শেষে সরকারের বেঁধে দেওয়া রেটের চেয়েও কম রেটে হাজী আনতে হয়। যে কারণে সার্ভিসে এদিক-সেদিক হয়। কম্প্রোমাইজ করেই চলতে হবে।
তবে সুবিধা এই যে, এই শ্রেণির হাজিদের কোনো অভিযোগ থাকে না। বাসা দূরে হলেও এদের কোনো আক্ষেপ নেই। খাবার-দাবারে সমস্যা হলেও কোনো বিকার নেই।
বলতে পারেন, এই শ্রেণির হাজীরাই বেশ। একটু সচেতন বা শিক্ষিত হাজীদেরই যত হম্বিতম্বি! বেড়ে যায়, তাদের চাহিদা। সামাল দিতে না পারলে অভিযোগের ফিরিস্তি নিয়ে চলে যায় হজ মিশনে।
পয়সা একটু কম হলেও এ ধরনের হাজী এনেই শান্তি- বলেন নাম প্রকাশ না করার শর্তে হজ এজেন্সির একজন প্রতিনিধি।
মক্কায় হজ মিশনে দেখা বাংলাদেশ প্রশাসনিক দলের প্রধান অতিরিক্ত ধর্ম সচিব হাফিজুর রহমানের সঙ্গে।
কেমন দেখলেন এবারের হজ ব্যবস্থাপনা?
তুলনামূলক অভিযোগ কম। সে হিসেবে হজ ব্যবস্থাপনা এবার বেশ ছিলো- জানান এই কর্মকর্তা।
ধর্মমন্ত্রী অধ্যক্ষ মতিউর রহমানের কাছে জানতে চেয়েছিলাম মন্ত্রনালয়ের পর্যবেক্ষণ।
‘এবারের হজ ব্যবস্থাপনা শ্রেষ্ঠ হজ ব্যবস্থাপনা। আমি ছদ্মবেশে মক্কায় ঘুরেছি। আমাদের কঠোর নজরদারীর কারণেই অভিযোগ বহুলাংশে কমে এসেছে।
হজ মিশনের পরিসংখ্যান বলছে, গতবারের তুলনায় এবার অভিযোগ কম। তবে অনিয়ম আর অব্যবস্থাপনার শিকার হয়েও যাদের অভিযোগ নেই বা অভিযোগ করেননি, এই অভিযোগহীনতাই বাড়িয়েছে সবার তুষ্টি। সাফল্যের মানদণ্ডকেও তুলে ধরেছে আরেকটু ওপরে! যদিও বাস্তবতা ভিন্ন। ফি বছর এসব নিয়েই চলে বাংলাদেশের হাজীদের হজপালন।