আত্মসমালোচনা মানুষকে পাপ থেকে বাঁচিয়ে রাখে

  • মাহফুজ আবেদ, অতিথি লেখক, ইসলাম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

আত্মসমালোচনা মানুষকে পাপ থেকে বাঁচিয়ে রাখে, ছবি: বার্তা২৪.কম

আত্মসমালোচনা মানুষকে পাপ থেকে বাঁচিয়ে রাখে, ছবি: বার্তা২৪.কম

আল্লাহতায়ালার শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানুষ। মানুষ মর্যাদাবান হবে, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু মর্যাদাবান মানুষের কথা বা বক্তব্য কেমন হবে? মর্যাদার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হওয়াটাই তো স্বাভাবিক, কিন্তু বর্তমান সভ্যতায় এই স্বাভাবিক বিষয়টি কতটা লক্ষ্য করা যাচ্ছে?

আসলে পৃথিবীর ক্ষমতাবান গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের কর্মকাণ্ডে সাধারণ মানুষের মুখে হাসি ফুটছে না, আর তাদের অনেকের বিদ্বেষপূর্ণ ও বিষাক্ত বাক্যবানে হতাশার মাত্রা দিন দিন আরও বাড়ছে। এমন বিশ্ববাতাবরণে কেউ কেউ পবিত্র কোরআনের বাণীতে সমাধান খোঁজার আহ্বান জানাচ্ছেন। বলি, উত্তম আহ্বান।

বিজ্ঞাপন

কিন্তু প্রশ্ন হলো, কোরআন পাঠে প্রবৃত্ত হওয়ার আগে তো মানুষের চোখে পড়ছেন মুসলিম এবং তাদের সমাজ। মানুষ তো পড়ার চাইতে দেখতে বেশি ভালোবাসে। মুসলমানদের দেখে কি বর্তমান সময়ে পবিত্র কোরআনের বার্তা উপলব্ধির খুব সুযোগ আছে? আর মুসলমানদের কথাবার্তা ও জীবনদৃষ্টি? দূষণে-মিশ্রণে বাস্তবতা এমন হয়েছে যে, মুসলমানদের অন্যদের থেকে আলাদা করা বেশ মুশকিল।

অথচ পবিত্র কোরআনে মুসলমানদের উদ্দেশ্যে বলা হয়েছে, ‘তোমাদের সৃষ্টি করা হয়েছে সমগ্র মানবজাতির কল্যাণের জন্য।’ মুসলমান তো আসলে তথাকথিত কোনো ‘সম্প্রদায়ের’ নাম নয়, বরং বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত সচেতন মানবমণ্ডলীর নাম, যাদের লক্ষ্য শুধুই কল্যাণ। এই চেতনা এখন পৃথিবীতে কতটা বর্তমান আছে। মুসলমানদের কথাবার্তা বা বাক্য-বিন্যাসেই বা এর প্রতিফলন কতটা ঘটছে?

বিজ্ঞাপন

পবিত্র কোরআনে তো ইসলামের নবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সৃষ্টি জগতের জন্য ‘রাহমাতাললিল আলামিন’ বলে বর্ণনা করা হয়েছে। এখান থেকে তো আমরা মানুষের প্রতি, প্রাণীর প্রতি তথা পরস্পরের প্রতি দয়া-ভালোবাসা, স্নেহ-মমতার শিক্ষা পাই।

এখন প্রশ্ন হলো, আল্লাহতায়ালা তার প্রিয় নবীর মাধ্যমে মানবজাতির জন্য কি বার্তা পাঠালেন, আর আমরা করছি কী? এমন প্রশ্নে হতাশা নয়, বরং প্রয়োজন আত্মসমালোচনা। আর আত্মসমালোচনার দায়িত্বটা প্রথমেই পালন করতে হবে মুসলমানদের।

তবে আদমশুমারির তালিকায় কিংবা বংশানুক্রমে আমরা যারা মুসলিম, তারা এই দায়িত্ব কতটা উপলব্ধি করবো সেই প্রশ্ন থেকেই যায়।

দুনিয়ার স্বাভাবিক নিয়মে প্রতিটি মানবসত্তাই মন্দ কাজে লিপ্ত হয়। তাই তা থেকে বেঁচে থাকার জন্য আত্মসমালোচনা একান্ত প্রয়োজন। প্রতিদিন মানুষ নিজেই নিজের পাপের হিসাব নেওয়ার মাধ্যমে পুনরায় ওই পাপে লিপ্ত হওয়া থেকে বিরত থাকতে পারে। এছাড়া ব্যক্তির মাঝে যে পাপবোধ সৃষ্টি হয় আত্মসমালোচনা তাকে ক্ষমা লাভের উপযুক্ত করে তোলে।

আভিধানিক অর্থে আত্মসমালোচনা হলো- নিজের সম্পর্কে সমালোচনা করা। পারিভাষিক অর্থে আত্মসমালোচনা বলতে বুঝায়, সচেতনভাবে কোনো কাজ সম্পন্ন করা বা পরিত্যাগ করা, যাতে কৃতকর্ম সম্পর্কে নিজের সুস্পষ্ট ধারণা থাকে। সুতরাং যদি তা আল্লাহর সন্তুষ্টিমূলক কাজ হয়, তবে তা নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করা। আর যদি তা আল্লাহর অসন্তুষ্টিমূলক কাজ হয় তবে তা থেকে সর্বতোভাবে বিরত থাকা। সেই সঙ্গে নিজেকে সর্বদা আল্লাহর সন্তুষ্টিমূলক কাজ তথা ইবাদতে মশগুল রাখা।

আল্লামা ইবনুল কাইয়্যুম রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, আত্মসমালোচনার অর্থ হচ্ছে- নিজের করণীয় এবং বর্জনীয় পৃথক করে ফেলা। অতঃপর সর্বদা ফরজ ও নফল কর্তব্যসমূহ আদায়ের জন্য প্রস্তত থাকা এবং হারাম বা নিষিদ্ধ বিষয়সমূহ পরিত্যাগ করার উপর সুদৃঢ় থাকা।

আত্মসমালোচনার মাধ্যমে নিজের দোষ-ত্রুটি নিজের সামনে প্রকাশ করার মাধ্যমে মানুষ স্বীয় ভুল-ত্রুটি জানতে পারে। ফলে তার হৃদয় ভালো কাজের দিকে আকৃষ্ট হয় এবং মন্দ কাজ থেকে দূরে থাকতে পারে। আত্মসমালোচনা দ্বীনের ওপর দৃঢ়তা অর্জনের সবচেয়ে কার্যকরি মাধ্যম, যা মানুষকে আল্লাহর দরবারে মুহসিন ও মুখলিস বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত করে। আত্মসমালোচনার মাধ্যমে মানুষ আল্লাহর নিয়ামতসমূহ, অধিকারসমূহ জানতে পারে। আর সে যখন আল্লাহর নিয়ামত ও তার অবস্থান সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করে, তখন সে আল্লাহর নিয়ামতের শুকরিয়া আদায়ে উদ্বুদ্ধ হয়।

আত্মসমালোচনার মাধ্যমে মানুষের মাঝে পরকালীন জওয়াবদিহিতার উপলব্ধি সৃষ্টি হয়। এটা জীবনের লক্ষ্যকে সজীব করে রাখে। আত্মসমালোচনার ফলে কোনো পাপ দ্বিতীয়বার করতে গেলে বিবেকে বাধা দেয়। ফলে পাপের কাজ থেকে মুক্তির পথ সহজ হয়ে যায়।

মোদ্দাকথা হলো- আত্মসমালোচনা আমাদের পার্থিব জীবনে দায়িত্বশীলতা সৃষ্টি করে, পরকালীন জওয়াবদিহিতার চিন্তা বৃদ্ধি করে এবং বিবেককে শাণিত করে। করণীয় ও বর্জনীয় সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা লাভে সাহায্য করে। সর্বোপরি জীবনের উচ্চতম লক্ষ্যকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে একজন প্রকৃত মানুষ হয়ে গড়ে উঠার কাজে সর্বদা প্রহরীর মতো দায়িত্ব পালন করে।

অতএব আসুন! আমরা নিজেদেরকে একজন প্রকৃত মানুষ হিসেবে, প্রকৃত মুসলমান হিসাবে গড়ে তোলার জন্য জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপ সতর্কতার সঙ্গে ফেলি।