২৭ বছর ধরে তারাবি পড়াচ্ছেন হাফেজ আনোয়ারুল
মাহে রমজান এলেই মন চায় সৌদি আরব যেতে। কোরআনে কারিমের উচ্চারণ, ইয়াদ, সুর যেন বারবার এই আকুতি জানায়। পবিত্র রমজানজুড়ে ইসলামের পূণ্যভূমি সৌদি আরবে ইবাদত-বন্দেগিতে মশগুল থাকে সেখানকার মানুষ। ইবাদতের বালাখানায় ইফতার, তারাবি, তাহাজ্জুদ, সেহেরি আর কোরআন তেলওয়াতে নেই কোনো ঘাটতি।
এ মাসে সম্প্রীতির বন্ধন, একে অপরের খোঁজ-খবর রাখা আর অসহায়ের পাশে দাঁড়ানোর জন্য উদগ্রীব থাকেন সৌদির মানুষ। এমন প্রশান্তির পরিবেশে দীর্ঘ সাড়ে আট বছর সময় কেটেছে হাফেজে কোরআন আনোয়ারুল ইসলাম সাজুর। তাই রমজান মাস এলেই সৌদি আরবে ফিরে যেতে চান তিনি।
১৯৯০ সালে হেফজ পড়াশুনা শেষ করার পর রংপুরে কয়েকটি মসজিদে তারাবির নামাজের ইমামতি করেন আনোরুয়াল ইসলাম। পরে ১৯৯২ সালে চাকরির সুবাদে তিনি সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদের সোলেমানিয়াতে চলে যান। সেখানে এক বছর পর মাহে রমজানে একটি ওয়াক্তিয়া মসজিদে দীর্ঘ সাত বছর তারাবির ইমামতি করেন।
সৌদির প্রবাস জীবনে মসজিদে মসজিদে গিয়ে রমজানে মাসে ভিন্নরকম প্রশান্তি পেয়েছেন এই হাফেজ। সেখানকার হাফেজে কোরআনদের মন জুড়ানো তেলাওয়াত আর রমজানের ইবাদত ভুলতে পারেন না এখনও।
রমজানকে ঘিরে বার্তা২৪.কম’র সঙ্গে আলাপচারিতায় সেই কথাগুলোই বলছিলেন আনোয়ারুল ইসলাম সাজু। সৌদি থেকে দেশে ফেরার পর রংপুরের বেশ কয়েকটি মসজিদে বিভিন্ন রমজানে তারাবির ইমামতি করেছেন। এখন রংপুর মহানগরীর শাপলা চত্বর আশরাফিয়া জামে মসজিদে তারাবির ইমামতি করছেন।
আটচল্লিশ বছর বয়সী এই হাফেজে কোরআনের তারাবিতে ইমামতি করার ২৭ বছর চলছে। তিনি বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘জীবনের শ্রেষ্ঠ তারাবির সময় কেটেছে সৌদি আরবে। সেখানকার মানুষরা রমজান মাসে রাতদিন ইবাদত-বন্দেগিতে ব্যস্ত থাকে। বিশেষ করে সালাতুল তারাবি থেকে তাহাজ্জুদের সময় পর্যন্ত চারদিক থেকে ভেসে আসা সুমধুর কোরআন তেলাওয়াত বিমোহিত করার মতো।’
রমজানজুড়ে সৌদি আরবে ইফতার সামগ্রী ক্রয় নিয়ে কাউকে চিন্তা করতে হয় না। সেখানকার ধনাঢ্যরা ইফতারের পসরা নিয়ে বসে থাকেন রোজাদারের অপেক্ষায়। আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, ‘সৌদিতে ইফতারের সময় মসজিদে মসজিদে হাজার হাজার রোজদার এক সঙ্গে ইফতার করে। বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিকরাও রোজাদারকে ডেকে নিয়ে ইফতার খাওয়ান। অধিকাংশ মধ্যবিত্ত, নিম্ন-মধ্যবিত্তসহ অসহায়, গরীবদের সেখানে ইফতার কিনে খেতে হয় না। কোনো না কোনো মাধ্যমে তারা ইফতার পেয়ে যান। শুধু সেহেরির সময়টুকু বাদ দিয়ে পুরো সৌদি আরবের মসজিদে মসজিদে ইফতার, তারাবি ও তাহাজ্জুদের সময় মুসল্লিদের ঢল নামে।’
আনোয়ারুলের ভাষায়, ‘মুসলমানদের জন্য সারা বছরই নামাজ ফরজ। তাই রমজানের সবচেয়ে উত্তম ইবাদত হচ্ছে কোরআন তেলাওয়াত। রোজার সঙ্গে কোরআন তেলাওয়াত মনকে শীতল রাখে। সৌদিতে তারাবির সময় কোরআনের আয়াত শুনে মুসল্লিদের কেউ কেউ কান্নায় ভেঙে পড়েন। কিন্তু আমরা বাঙালিরা তো কোরআনের তেলাওয়াত শুনি, অর্থ বুঝি না। এ কারণে আমাদের মধ্যে কোরআন শোনার মনোযোগ কম। সৌদির মসজিদগুলোতে শুধু বিশ রাকাত সালাতুল তারাবিতে নয়, তাহাজ্জুদের সময়ও মুসল্লিরা দীর্ঘ সময় নামাজ আদায় করেন। অথচ বাংলাদেশে আমরা নামাজের ব্যাপারে উদাসীন।’
রমজানে অসহায়, গরীব-মিসকিনদের বেশি বেশি সাহায্য-সহযোগিতা ও দান করার তাগিদ দিয়ে এই হাফেজ বলেন, ‘আমি পনের দিন তারাবির ইমামতি করতাম। আর পনের দিন মক্কা ও মদিনার বিভিন্ন মসজিদে মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়তাম। কখনোই মসজিদে মুসল্লি কম দেখিনি। কিন্তু আমাদের দেশেতো রমজানের প্রথম দশদিন পর থেকে মুসল্লি কমতে থাকে।’
তিনি বলেন, ‘আল্লাহ্ যে উদ্দেশ্যে রমজানকে রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের মাস হিসেবে মুসলমানদের জন্য নির্ধারণ করেছেন, আমরা যদি তা সত্যিকার অর্থে তা অনুধাবন করতে পারি, তবেই স্বার্থক হবে নেয়ামত ও ফজিলতের এই মাসের ইবাদত।’
বর্তমানে হাফেজ আনোয়ারুল ইসলাম সাজু রংপুরের একটি মাদরাসায় শিক্ষকতার পাশাপাশি আশরাফিয়া জামে মসজিদে ইমামতি করছেন। তিনি কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার গুনাইগাছি ইউনিয়নের কাঁঠালবাড়ি জুম্মারহাট গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা চাঁন মিয়ার বড় ছেলে। বর্তমানে স্ত্রী ও এক মেয়ে সন্তান নিয়ে রংপুরে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন তিনি।