আরাফাতের ময়দান (সৌদি আরব) থেকে: সৌদি আরবে আজ জিলহজ মাসের ৯ তারিখ। জিলহজের ৯ তারিখে পবিত্র হজ অনুষ্ঠিত হয়। হজ উপলক্ষে মক্কার সব রাস্তা এখন আরাফাতমুখী। হজপালনের জন্য আরাফাতের ময়দানে লাখো মুসুল্লি উপস্থিত। বিশ্বের ধর্মপ্রাণ মুসল্লিদের চোখ এখন আরাফাত ময়দানের দিকে।
সৌদি আরবের হজ ও ওমরা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছর হজপালনের জন্য বিভিন্ন দেশ থেকে ১৮ লাখ ৩৮ হাজার ৩৩৯ জন হজযাত্রী এসেছেন।
বিজ্ঞাপন
অন্যদিকে সৌদি আরবের নাগরিক ও সৌদি আরবে প্রবাসীদের মধ্যে সাড়ে ৪ লাখ মানুষকে প্রথমে হজপালনের অনুমতি দেওয়া হয়। কিন্তু আবেদনকারীদের সংখ্যা বেশি হওয়ায় পরে আরও লক্ষাধিক মানুষকে হজের অনুমতি দেওয়া হয়। সে হিসেবে এ বছর প্রায় ২৫ লাখ মানুষ হজপালন করছেন।
বিজ্ঞাপন
হজের অন্যতম ফরজ হলো- আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করা। হজপালনকারীদের যারা সৌদি আরবে এসে অসুস্থতার জন্য হাসপাতালে চিকিৎসাধীন, তাদেরকে স্বল্প সময়ের জন্য হলেও অ্যাম্বুলেন্সে করে আরাফাতের ময়দানে আনা হবে। মূলত ৯ জিলহজ আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করাই হজ।
আরাফা অর্থ পরিচিত হওয়া। আরাফাতের ময়দানের পাশের পর্বতের নাম- জাবালে রহমত। আরাফাহ ও আরাফাত এই দু'টো শব্দই আরবিতে প্রচলিত। এই ময়দান দৈর্ঘ্যে দুই মাইল, প্রস্থেও দুই মাইল। এই বিরাট সমতল ময়দানের নাম আরাফাত। ময়দানের তিন দিক পাহাড়বেষ্টিত। আরাফাতের ময়দানে হাজিরা জোহরে ও আসরের নামাজ আদায় করবেন। এছাড়া দোয়া-মোনাজাত, কোরআন তেলায়ত ও নফল নামাজ আদায় করে সময় কাটাবেন। আরাফাতের ময়দানের দোয়া করা সবচেয়ে বেশি ফজিলতের কাজ। আলেমরাও এই পরামর্শ দিয়ে থাকেন।
৯ জিলহজ সকাল থেকে পুরুষ হাজিরা উচ্চস্বরে তাকবির পাঠ করবেন, নারীরা তাকবির পাঠ করবেন নিম্ন আওয়াজে। তাকবির হলো- 'আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার ওয়ালিল্লাহিল হামদ।' ১৩ জিলহজ আসরের নামাজের পর পর্যন্ত তাকবির বলা ওয়াজিব।
এই ময়দানে ৬৩১ খ্রিস্টাব্দে প্রিয় নবী হজরত মুহম্মাদ (সা.)-এর নিকট হজ বিধান নাজিল হলে তিনি ৬৩২ খ্রিস্টাব্দে এক লাখ চল্লিশ হাজার সাহাবিসহ হজ পালন করেন।
নবী করিম (সা.) ৯ জিলহজ আরাফাতের ময়দানে উটের পিঠে আরোহণ করে বিদায় হজের খুতবা দিয়েছিলেন। ওই খুতবা মানবতার ইতিহাসে এক অনন্য মাইলফলক হয়ে আছে।
ওই খুতবার অনুসরণে আরাফাত ময়দানে অবস্থিত মসজিদে নামিরা থেকে হজের খতিব উপস্থিত হাজিদের উদ্দেশে খুতবা প্রদান করবেন। স্থানীয় সময়ানুসারে সাধারণত খুতবা শুরু হয় দুপুর সাড়ে ১২টায়।
খুতবার পর সূর্যাস্ত পর্যন্ত তালবিয়া, তাহমিদ, দোয়া-দুরুদ, ইসতেগফার কোরআন তেলাওয়াত ও আল্লাহতায়ালার দরবারে কান্নাকাটি করে সময় পার করবেন।
হজপালনকারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সৌদি কর্তৃপক্ষ সব ধরনের প্রস্তুতি গ্রহণ করেছেন। হাজিদের বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা দিতে মিনা ও আরাফাতের পথে কিছু দূর পরপর রয়েছে হাসপাতাল। রয়েছে দমকল ও পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা। আরাফাতের ময়দানে সৌদি সরকারের পক্ষ থেকে সব হাজিকে বিনামূল্যে খাবার, বিশুদ্ধ পানিসহ সব সুবিধা দেওয়ার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানও হাজিদের নানা উপহার দিচ্ছে।
ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের অন্যতম হজ। এটি ফরজ ইবাদত। যেসব মুসলিম নর-নারীর শারীরিক সক্ষমতার পাশাপাশি আর্থিক সংগতি আছে, তাদের জন্য জীবনে একবার হজ পালন করা ফরজ। চাঁদ দেখা সাপেক্ষে ২০২৫ সালের ৫ জুন পবিত্র হজ অনুষ্ঠিত হতে পারে।
এ বছর বাংলাদেশ থেকে এক লাখ ২৭ হাজার ১৯৮ জন হজব্রত পালনের সুযোগ পাবেন। এরই মধ্যে হজযাত্রী নিবন্ধন কার্যক্রম শুরু হয়েছে এবং তা ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত চলবে।
হজ একটি দ্বিরাষ্ট্রীয় ও সময়াবদ্ধ কার্যক্রম। সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ অনুসরণ করে বাংলাদেশ ও সৌদি সরকারের যৌথ ব্যবস্থাপনায় হজের যাবতীয় কার্যক্রম সম্পাদিত হয়।
এই রোডম্যাপ অনুসরণে বিচ্যুতি ঘটলে সার্বিক হজ ব্যবস্থাপনায় নেতিবাচক প্রভাব পড়ে, হজ ব্যবস্থাপনায় বিঘ্ন ঘটে। সৌদি যেতে প্রয়োজন একটি বৈধ পাসপোর্ট এবং হজের জন্য প্রয়োজন হজ ভিসা। এবার হজ পালনের জন্য ১৫ ডিসেম্বর ২০২৫ পর্যন্ত পাসপোর্টের মেয়াদ থাকতে হবে। হজ ভিসা ছাড়া হজপালন সম্ভব নয়।
বাংলাদেশ থেকে দুটি মাধ্যমে হজ পালন করা যায়। সরকারি মাধ্যমে ও বেসরকারি হজ এজেন্সির মাধ্যমে। এ বছর হজে যেতে প্রথমে প্রাক-নিবন্ধন, এরপর প্রাথমিক নিবন্ধন এবং সব শেষে চূড়ান্ত নিবন্ধন করতে হবে। এ বছরের অক্টোবরের ১ তারিখ থেকেই শুরু হয়েছে ২০২৫ সালের হজ নিবন্ধন, চলবে ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত। ঢাকার হজ অফিস, বায়তুল মোকাররমে ইসলামিক ফাউন্ডেশন, বিভাগীয় ও জেলা কার্যালয়ে প্রাক-নিবন্ধন ও নিবন্ধন করা যাবে। এ ছাড়া হজের কল সেন্টার ১৬১৩৬ নম্বরে ফোন করে, e-Hajj ইউ মোবাইল অ্যাপ কিংবা www.hajj.gov.bd ওয়েব পোর্টালে লগ ইন করে নিবন্ধন করা যাবে।
তবে দুরারোগ্য ব্যাধি, যেমন- ক্যান্সার, অ্যাডভান্সড কার্ডিয়াক, লিভার সিরোসিস, কিডনি রোগ, সংক্রামক যক্ষ্মা ও ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তি ছাড়া হজ গমনেচ্ছু বাংলাদেশের যেকোনো মুসলিম নাগরিক যথাযথ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে হজে যেতে পারবেন।
নিবন্ধনের সময় জাতীয় পরিচয়পত্র বা পাসপোর্ট, সদ্য তোলা পাসপোর্ট সাইজের এক কপি ছবি ও হজযাত্রীর ব্যাংক হিসাবের তথ্য প্রয়োজন হবে। প্রাক-নিবন্ধনের জন্য ৩০ হাজার এবং প্রাথমিক নিবন্ধনের জন্য তিন লাখ টাকা সোনালী ব্যাংকের যেকোনো শাখায় জমা দিতে হবে।
ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয় কর্তৃক নির্ধারিত তারিখের মধ্যে প্যাকেজ মূল্য পরিশোধ করে চূড়ান্ত নিবন্ধন সম্পন্ন করতে হবে। প্রাক-নিবন্ধনকালে জমাকৃত ৩০ হাজার টাকার মধ্যে প্রাক-নিবন্ধন প্রসেস ফি বাবদ এক হাজার টাকা কাটার পর অবশিষ্ট ২৯ হাজার টাকা এবং প্রাথমিক নিবন্ধনের তিন লাখ টাকা চূড়ান্ত নিবন্ধনের সময় প্যাকেজ মূল্যের সঙ্গে সমন্বয় করা হবে।
গত ৩০ অক্টোবর অন্তর্বর্তী সরকারের ধর্ম উপদেষ্টা হজ প্যাকেজ ২০২৫ ঘোষণা করেন। এবার সরকারি ব্যবস্থাপনায় সাধারণ হজ প্যাকেজ-১ ও সাধারণ হজ প্যাকেজ-২ নামে দুটি প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছে। সাধারণ হজ প্যাকেজ-১-এর মূল্য চার লাখ ৭৮ হাজার ২৪২ টাকা এবং অন্যটির মূল্য পাঁচ লাখ ৭৫ হাজার ৬৮০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। সরকারের দৃঢ় মনোভাব ও যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণের কারণেই এ বছর উড়োজাহাজ ভাড়া ২৬ হাজার ৯৮০ টাকা কমেছে।
রাজস্ব বোর্ডও হাজিদের জন্য বিমান টিকিটের ওপর শুল্ক ও ভ্যাট প্রত্যাহার করেছে। সৌদি রিয়ালের দাম গতবারের তুলনায় ২.৭৬ টাকা বৃদ্ধি পাওয়ায় সংগত কারণে হজের খরচ বৃদ্ধি পাওয়ার কথা। কিন্তু এ দেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা যাতে সুলভে হজ পালন করতে পারে সেই লক্ষ্যে সরকার হাজিদের আবাসন ও সেবায় কিছুটা পরিবর্তন এনে হজ প্যাকেজ ঘোষণা করেছে।
এ বছর বেসরকারি মাধ্যমের সাধারণ হজ প্যাকেজের মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে চার লাখ ৮৩ হাজার ১৫৬ টাকা। এ ছাড়া সাধারণ হজ প্যাকেজ গ্রহণপূর্বক এজেন্সিকে একটি অতিরিক্ত বিশেষ প্যাকেজ ঘোষণা করার সুযোগ রাখা হয়েছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে বেসরকারি হজ এজেন্সিগুলো দুটি অংশ আলাদাভাবে প্যাকেজ ঘোষণা করেছে।
হজযাত্রীকে বায়োমেট্রিক সম্পন্ন করে ঢাকার হজ অফিসে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে বায়োমেট্রিক সনদ ও পাসপোর্ট জমা দিতে হবে। শিশুদের নিবন্ধন অভিভাবকের সঙ্গে একত্রে করতে হবে। হজ শেষে শিশু বা নবজাতকের বিমানভাড়ার ফেরতযোগ্য অংশ প্রাপ্তির জন্য সংশ্লিষ্ট এয়ারলাইনসের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। মৃত্যু বা গুরুতর অসুস্থতার কারণে হজে যেতে সক্ষম না হলে জমাকৃত অর্থের অব্যয়িত অংশ হজযাত্রীকে ফেরত দেওয়া হয়ে থাকে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক বিধি অনুসরণপূর্বক প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রা হজের সময় সঙ্গে নেওয়া যাবে। হজযাত্রীদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা সরকারি হাসপাতালে বা বেসরকারি স্বনামধন্য ডায়াগনস্টিক সেন্টারে সম্পন্ন করে রিপোর্টসহ টিকাদান কেন্দ্রে উপস্থিত হয়ে মেনিনজাইটিস ও ইনফ্লুয়েঞ্জা টিকা নিয়ে টিকা সংবলিত স্বাস্থ্য সনদ গ্রহণ করতে হবে। বিমানে ভ্রমণকালে একজন হজযাত্রী সর্বোচ্চ ৪৬ কেজি (২৩+২৩) ওজনের দুটি ট্রলিব্যাগ এবং সর্বোচ্চ সাত কেজি ওজনের একটি হ্যান্ডব্যাগ সঙ্গে নিতে পারবেন। ট্রলিব্যাগে হজযাত্রীর নাম, পাসপোর্ট নম্বর, whatsapp যুক্ত মোবাইল নম্বর, গাইড, মোনাজ্জেম মোবাইল নম্বর ইত্যাদি ইংরেজিতে লিখতে হবে।
সৌদি সরকারের আইন অনুযায়ী, হজযাত্রীর লাগেজে নেশাজাতীয় ওষুধ, তামাকপাতা, জর্দা, গুল, শুঁটকি, গুড়, রান্না করা খাবার, পচনশীল দ্রব্যাদি (ফলমূল, পান, সুপারি) ইত্যাদি পরিবহন করা নিষিদ্ধ। ডায়াবেটিস, হৃদরোগের মতো অসুস্থতার জন্য প্রেসক্রিপশনসহ নিয়মিত সেবন করতে হয় এমন ওষুধ, স্ট্রিপ ইত্যাদি অবশ্যই সঙ্গে নিতে হবে।
ঢাকার হজযাত্রীরা হজ ফ্লাইট সময়ের কমপক্ষে ছয় ঘণ্টা আগে এবং ঢাকার বাইরের হজযাত্রীদের কমপক্ষে এক দিন আগে ঢাকার আশকোনা হজ ক্যাম্পে উপস্থিত থাকতে হবে। হজক্যাম্প ডরমিটরিতে বিনামূল্যে থাকা এবং নিজ খরচে ক্যান্টিনে খাওয়ার ব্যবস্থা রাখা হয়।
সৌদি আরবে হজযাত্রীকে নুসুক কার্ড, পরিচয়পত্র, মোয়াল্লেম কার্ড ও হোটেলের কার্ড সার্বক্ষণিক সঙ্গে রাখতে হবে। সৌদি অবস্থানকালে রাজনীতি, বিক্ষোভ প্রদর্শন, মানববন্ধন, ভিক্ষাবৃত্তি, চুরিসহ সব ধরনের অনৈতিক ও অপরাধমূলক কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে। অন্যথায় সে দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
হজ সফরে মৃত্যুবরণকারী হজযাত্রীকে সৌদি আরবে দাফন করা হয়ে থাকে। হজ শেষে মৃত্যু সনদ ঢাকার হজ অফিসের মাধ্যমে মৃতের ওয়ারিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়। লাগেজ হারিয়ে গেলে বাংলাদেশ হজ অফিস, জেদ্দা, মক্কা বা মদিনায় সরাসরি বা এজেন্সির মোনাজ্জেম বা গাইডের মাধ্যমে অবহিত করতে হবে। দেশে ফেরার পথে লাগেজ হারানো গেলে এ সংক্রান্ত তথ্যাদি বিমানবন্দরের লস্ট অ্যান্ড ফাউন্ড সেকশনে জানাতে হবে। জেদ্দা, মক্কা ও মদিনায় স্থাপিত মেডিক্যাল সেন্টার থেকে হজযাত্রীরা বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা গ্রহণ করতে পারবেন। তবে খাওয়ার পানি, হ্যান্ডওয়াশ বা সাবান ও টয়লেট পেপার নিজ ব্যবস্থাপনায় কিনে ব্যবহার করতে হবে।
২৫ জিলকদ ১৪৪৬ হিজরির পর কোনো হজযাত্রী মক্কা কিংবা জেদ্দা থেকে সড়কপথে মদিনায় যেতে পারবেন না। ৫ জিলহজের পর কোনো হজযাত্রী মদিনা-আল-মুনাওয়ারায় অবস্থান করতে পারবেন না। হজের পর ১৪ জিলহজের আগে কোনো হজযাত্রী মক্কা মোকাররমা থেকে মদিনা মোনাওয়ারায় যেতে পারবেন না।
হজব্রত পালনের জন্য সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা থাকা আবশ্যক। পরিকল্পিত পদক্ষেপের মাধ্যমে অগ্রসর হলে হজের মতো গুরুত্বপূর্ণ ইবাদতটি সহজ ও সাবলীলভাবে সম্পন্ন করা সম্ভব। মহান আল্লাহ সবার হজ সহজ করে দিন। আমিন।
পবিত্র হজ নানা রহস্য ও হেকমতে ভরপুর এমন এক ইবাদত, যাতে রয়েছে অনেক কল্যাণ। বিশ্বের মুসলমানরা ফরজ হজপালনের জন্য জিলহজ মাসের প্রথম দিকে পবিত্র কাবার শহর মক্কামুখি হন। আর উমরা সারা বছরের যেকোনো সময় আদায় করা যায়। সব ধরনের সামর্থ্য থাকলে একজন মুসলমানের জন্য জীবনে একবার হজ করা ফরজ।
হজের দর্শনের মধ্যে রয়েছে বস্তুগত, আধ্যাত্মিক, রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক এবং ব্যক্তিগত নানা কল্যাণ। যেমন- হজ মুসলিম বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ও সমস্যাগুলো পর্যালোচনার সুযোগ এনে দেয় এবং এতে জোরদার হয় মুসলিম বিশ্বের ঐক্য ও সংহতি। সাংস্কৃতিক লেনদেনও ঘটে হজকে কেন্দ্র করে।
হজের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দর্শন হলো, একনিষ্ঠ ও প্রেমময় চিত্তে আল্লাহর দাসত্বের ঘোষণা দেওয়া। ইহরাম বাঁধা, কাবা ঘরের তওয়াফ ও কোরবানিসহ অন্যান্য তৎপরতায় এ বিষয়টি ফুঁটে উঠে। এ ছাড়া হজের মাধ্যমে আরও বেশ কিছু বিষয় প্রকাশ পায়, সেগুলো হলো-
পরকালের প্রতি মনোযোগ সেলাইবিহীন সাদা কাপড় পরে হজযাত্রী সব ধরনের পার্থিব মোহ ও আকর্ষণ থেকে নিজেকে মুক্ত করে নিজেকে আধ্যাত্মিক ও আসমানি পর্যায়ে উন্নীত করেন।
মুসলমানদের সহমর্মিতা হজের সময় সারা বিশ্বের মুসলমানরা হন একত্রিত। সমচিন্তা ও সহমর্মিতার ঢেউ খেলে যায় তাদের মধ্যে। কিভাবে বিশ্বের মজলুম ও দুর্বল মানুষদের সমস্যার সমাধান করা যায় তা নিয়ে ঘটে বিশ্লেষণ ও মতবিনিময়। মুসলিম বিশ্বের যে বিশাল শক্তিমত্তা তা দেশ ও জাতিগুলোর সমস্যা সমাধানে কাজে লাগাতে পারে।
আলেমরা বলেন, ‘হজ এমন এক বিধান, যার মাধ্যমে মানুষের মধ্যে ধর্মের প্রতি আনুগত্য ফুটে উঠে ও পার্থিব নানা কল্যাণ অর্জন করে। হজ মৌসুমে সারা দুনিয়ার মানুষ একত্র হওয়ায় জানতে পারে একে-অপরকে এবং জাতিগুলো পরস্পরের বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক উৎপাদন থেকেও হয় উপকৃত। এ ছাড়া তারা নবী কারিম (সা.)-এর অবদান এবং তার সম্পর্কে নানা তথ্য ও প্রামাণ্য বিষয় জানতে পারে।’
ইসলামি সমাজের সুরক্ষা হজ ইসলামকে শক্তিশালী করে ও শক্তিশালী করে মুসলিম উম্মাহকে। হজ নানা শাস্তি থেকে বিশ্বের মুসলমানদের রক্ষা কর। কাবা ঘরকে পরিত্যাগ করা হলে ও হজ বন্ধ হয়ে গেলে ধ্বংস হবে সমাজ এবং নাজিল হবে আল্লাহর শাস্তি। তাই মুসলিম সরকারের উচিত হজপালনে জনগণকে উৎসাহ দেওয়া এবং কোনো ব্যক্তির যদি আর্থিক সামর্থ্য নাও থাকে তাকেও আর্থিক সহায়তা দিয়ে হজে পাঠানো।
হজের মাধ্যমে অভাব দূর হয়, এটা ঐক্যের মাধ্যম। হজযাত্রীরা জালেম, সত্য গোপনকারী ও মুশরিকদের প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করেন। এটা হজের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য। তারা বিশ্বের সব মজলুম ও বঞ্চিতদের প্রতি সংহতি ঘোষণা করেন।
দ্বিতীয়বারের মতো নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুতে পবিত্র কোরআন হেফজ (মুখস্থ) প্রতিযোগিতার আয়োজন করছে সৌদি আরব।
সৌদি প্রেস এজেন্সি জানিয়েছে, আগামী ২১-২২ ডিসেম্বর কাঠমান্ডুতে পবিত্র কোরআন হেফজ প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছে ইসলাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দাওয়া ও গাইডেন্স মন্ত্রণালয়।
নেপালের বিভিন্ন রাজ্য ও গভর্নরেট থেকে চার শতাধিক প্রতিযোগী প্রাথমিক বাছাইপর্বে অংশ নেবেন।
আরব নিউজের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রতিযোগিতাটি বিশ্বজুড়ে তরুণ মুসলমানদের মধ্যে কোরআনে কারিমের শিক্ষা ছড়িয়ে দেওয়ার সৌদি আরবের প্রচেষ্টার অংশ।
সমাপনী অনুষ্ঠানে বিজয়ীদের পুরষ্কার প্রদান করা হবে। নেপালজুড়ে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারাও উপস্থিত থাকবেন।
এর আগে চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে কাঠমান্ডুতে সৌদি দূতাবাসের তত্ত্বাবধানে নেপালের মুসলিম কমিশনের সমন্বয়ে প্রথমবারের মতো কোরআন প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়।
২০২৩ সালে প্রকাশিত নেপালের সর্বশেষ আদমশুমারির তথ্য মতে, প্রায় ১৫ লাখ মুসলমান রয়েছে বলে জানা গেছে। যা মোট জনসংখ্যার ৫.০৯ শতাংশ এবং দেশটিতে ইসলাম তৃতীয় সর্বাধিক অনুসরণ করা ধর্ম। দেশের প্রায় প্রতিটি জেলায়ই মুসলমানরা বসবাস করেন।
নেপালের ইতিহাস থেকে জানা যায়, হিজরি পঞ্চম শতকে আরব দেশ থেকে বাণিজ্য কাফেলার আগমনের মধ্য দিয়ে হিমালয় কন্যা নেপালে মুসলমানদের আগমন ঘটে। বর্তমানে নেপালে ৪৩০টির মতো মসজিদ রয়েছে। রাজধানী কাঠমান্ডুর রত্নাপার্ক সংলগ্ন এলাকায় দেশটির ঐতিহ্যবাহী কেন্দ্রীয় মসজিদ অবস্থিত। এই মসজিদ ইসলাম ও মুসলমানদের ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক। দেশটিতে রয়েছে বেশ কয়েকটি মাদরাসা।
২০০৮ সালে নেপালে রাজতন্ত্র বিলোপ এবং মাওবাদিদের নেতৃত্বে গণতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর মুসলমানের ধর্মীয় দিবসগুলোতে সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয়। এখন নেপালের মুসলিমরা প্রকাশ্যে ধর্মীয় উৎসব পালন করছে।
আশার কথা হলো, গণতান্ত্রিক নেপালের সরকারগুলো মুসলিমদের সমস্যাগুলোকে গুরুত্ব দিচ্ছে এবং তাদের উন্নয়নের লক্ষে কাজ করছে। নেপালি মুসলিমরা ভবিষ্যতের ব্যাপারে প্রচণ্ড আশাবাদী। কেননা নেপালের রাষ্ট্র ও সংবিধান দিনদিন তাদের অধিকারগুলোর স্বীকৃতি দিচ্ছে।
২০১৫ সালে গৃহীত সংবিধান প্রথমবারের মতো মুসলিমদের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। সংখ্যালঘু হিসেবে সরকারি চাকরিতে মুসলিমদের কোটা অধিকার দিয়েছে। যদিও নেপালের সরকারি চাকরিতে মুসলমানের প্রতিনিধিত্ব এক শতাংশের চেয়ে কম।
মুসলিম স্থাপত্যশৈলীর অনন্য নিদর্শন সাতক্ষীরার কালিগঞ্জ উপজেলার প্রবাজপুর শাহী মসজিদ। ১৬৯৩ খ্রিস্টাব্দের ২ মে (১১০৪ হিজরির ১৯ রমজান) নির্মাণের পর থেকে এখনও প্রবাজপুর শাহী জামে মসজিদে জামাতের সঙ্গে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করছেন মুসল্লিরা।
জনশ্রুতি আছে, জিনেরা জঙ্গল কেটে রাতারাতি মসজিদটি নির্মাণ করেছিল। আবার অনেকেই বলেন, মাটির নিচ থেকে উঠেছিল মসজিদটি।
উইকিপিডিয়ার মতে, মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব মুসলমান সৈন্যদের পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ার জন্য সুবেদার পরবাজ খাঁকে একটি মসজিদ নির্মাণ করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। যা তার নাম অনুসারে প্রবাজপুর শাহী জামে মসজিদ নামে পরিচিত।
এক ফার্সি পরোয়ানা থেকে জানা যায়, মসজিদটি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সম্রাট আওরঙ্গজেবের সময় তার ফৌজদার নবাব নুরুল্লাহ খাঁ ৫০ একর জমি দান করেছিলেন। কিন্তু বর্তমানে মসজিদের দখলে মাত্র তিন একর জমি রয়েছে।
এদিকে সংস্কারের অভাবে প্রায় সাড়ে তিনশ’ বছর আগে নির্মিত প্রবাজপুর শাহী মসজিদ দিন দিন জরাজীর্ণ হয়ে পড়ছে। খসে পড়ছে দেয়ালের ইট।
দৃষ্টিনন্দন এ মসজিদটির বহির্বিভাগের দৈর্ঘ্য ৫২ ফুট ৫ ইঞ্চি এবং প্রস্থ ৩৯ ফুট ৮ ইঞ্চি। মসজিদটির অভ্যন্তরে ২১ ফুট ৬ ইঞ্চির বর্গাকৃতির একটি নামাজের জায়গা রয়েছে। মসজিদের দেয়ালগুলো ৫ ফুট ৯ ইঞ্চি থেকে ৭ ফুট পুরু। আর মসজিদের প্রধান দরজাটি ৪ ফুট ৭ ইঞ্চি প্রশস্ত। মসজিদটিতে ৬ ফুট ৯ ইঞ্চি প্রশস্ত একটি বারান্দা ছিল যা এখন আর নেই।
প্রবাজপুর শাহী জামে মসজিদের সভাপতি মাখলুকাত হোসেন জানান, মসজিদটির অধিকাংশ জমি বেদখল হয়ে গেছে। এমনকি মসজিদের মূল ভবনের জমিও জালজালিয়াতি করে রেকর্ড করে নেওয়া হয়েছে। এটি নিয়ে মামলা চলছে হাইকোর্টে।
তিনি বলেন, প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর মসজিদটি পুরাকীর্তি হিসেবে সংরক্ষিত ঘোষণা দেওয়ার পর একবার সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। তখন কুমিল্লা ও দিনাজপুর থেকে লোক এনে ইট কেটে মসজিদের দেয়ালের নকশার মতো নকশা তৈরি করে বসানো হয়েছিল। তারপর থেকে আর সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।