মদিনা রাষ্ট্রের প্রাসঙ্গিকতা আজও বিদ্যমান

  • মুফতি এনায়েতুল্লাহ, বিভাগীয় প্রধান, ইসলাম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

বির্তককে সঙ্গী করে পাকিস্তানে ১১তম জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। ২৫ জুলাই অনুষ্ঠিত নির্বাচনের ফলাফলে একসময়ের জগদ্বিখ্যাত ক্রিকেট অধিনায়ক ইমরান খানের নেতৃত্বাধীন তেহরিক-ই- ইনসাফ পার্টি সরকার গঠনের দ্বারপ্রান্তে। তবে তাকে জোট গড়তে হবে। এই নিবন্ধ লেখা পর্যন্ত তিনি কোন দলের সঙ্গে জোট করবেন তা স্পষ্ট হয়নি।

উপমহাদেশ ও বৈশ্বিক বাস্তবতায় পাকিস্তানের জাতীয় নির্বাচন এবং রাজনৈতিক পরিস্থিতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আর পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি উপমহাদেশের অন্য যে কোনো দেশের চেয়ে ভিন্নতর। আফগানিস্তানসহ মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক বাস্তবতা, পশ্চিমাদের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ এবং চীন-মার্কিন মেরুকরণ, ভারতের সঙ্গে ক‚টনৈতিক সম্পর্কের উত্তাপ পাকিস্তানকে সরাসরি প্রভাবিত করে। তবে এটা স্বীকৃত যে, পাকিস্তানের রাজনীতিতে পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে সেনাবাহিনী সর্বদাই গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করে থাকে। দেশ পরিচালনায় সরকার ও সেনাবাহিনীর মধ্যকার দূরত্ব বা সমন্বয়হীনতার কারণে পাকিস্তানের জাতীয় রাজনীতি ও সামাজিক বাস্তবতায় বিরূপ প্রভাব পড়তে দেখা যায়। সেটা অবশ্য ভিন্ন প্রসঙ্গ।

বিজ্ঞাপন

সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, পাকিস্তান প্রধান সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন সম্পন্ন করতে সক্ষম হয়েছে। অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতার পালাবদল এবং নির্বাচিত সরকারের মেয়াদ পূর্ণ করার অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ হলো। এটা পাকিস্তানের গণতন্ত্র ও জাতীয় রাজনীতিতে অবশ্যই তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা।

পাকিস্তানে এবারের জাতীয় নির্বাচনে সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণের পাশাপাশি ভোটারদের উপস্থিতি বা অংশগ্রহণও ছিল অতীতের যে কোন জাতীয় নির্বাচনের চেয়ে বেশি। পাকিস্তানের অতি রক্ষণশীল সামাজিক বিধি-নিষেধ ডিঙিয়ে নারী ভোটারের উপস্থিতি ছিলো চোখে পড়ার মতো।

বিজ্ঞাপন

প্রাপ্ত ফলাফল অনুসারে ইমরান খানই পাকিস্তানের পরবর্তী সরকারের প্রধানমন্ত্রী হতে চলেছেন, এটা নিশ্চিত। ইমরান খান একই সঙ্গে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত এবং ইসলামি মূল্যবোধের প্রতি একনিষ্ঠ। তেহরিক-ই- ইনসাফ পার্টির নির্বাচনী ইশতিহারটিও ছিল সময়োপযোগী এবং জনগণের প্রত্যাশার কাছাকাছি।

/uploads/files/FZAixM7HNxtN5ghL0gu8GyoUd7TCaaM5ea36HBaq.jpeg

নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশের পর বৃহস্পতিবার জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণে ইমরান খান বলেন, বর্তমানে আমাদের দেশ বিপর্যয়ের মধ্যে রয়েছে। কৃষকরা তাদের শ্রমের মূল্য পান না, ২ কোটি ৫০ লাখ শিশু শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত, পর্যাপ্ত চিকিৎসাসেবার অভাবে আমাদের প্রসূতি মায়েরা অব্যাহতভাবে মারা যাচ্ছেন, সরকার নিরাপদ খাবার পানিও সরবরাহ করতে পারে না। আমি মদিনা রাষ্ট্রের মতো করে পাকিস্তান গঠনের স্বপ্ন দেখি। যেখানে বিধবা ও দরিদ্ররা অবহেলিত হবে না। আমাদের সকল নীতি হবে সুবিধাবঞ্চিত মানুষের সহযোগিতা করার জন্য।

ইমরান খানের ওই ভাষণেকে রাজনৈতিক মহল বেশ তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করছে। তিনি ভাষণে বলেছেন, সরকার গঠনের পর তার দল এই ভিশন নিয়েই দেশ পরিচালনা করবে। আমরাও মনে করি, পাকিস্তানের রাজনৈতিক বলয়ে ক্ষমতার মসনদে নির্দিষ্ট দল বা শক্তিগুলোর বাইরে ইমরান খানের প্রবেশ একেবারেই নতুন ঘটনা। এমতাবস্থায় তাকে বিচক্ষণতার সঙ্গে পথ চলতে হবে।

এক্ষেত্রে তিনি ‘মদিনা রাষ্ট্রের মতো করে পাকিস্তান গঠনের স্বপ্ন দেখি’ বলে সাধারণ মানুষের প্রত্যাশাকে বাড়িয়ে দিয়েছেন। সেই সঙ্গে মদিনা রাষ্ট্র যে আজও প্রাসঙ্গিক তা তিনি স্বীকার করে নিয়েছেন। বস্তুত হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব। তার জীবনের পূর্ণতা ও সফল বাস্তবায়ন ঘটে মদিনায় একটি কল্যাণ রাষ্ট্র গঠনের মাধ্যমে। তিনি ঐতিহাসিক মদিনা সনদের মাধ্যমে বিশ্ববাসীর সামনে আদর্শ রাষ্ট্র ও সমাজ গঠনের উজ্জ্বল একটি নজির রেখে গেছেন। দেড় হাজার বছর আগের ঐতিহাসিক সেই সূত্র আজকের আধুনিক বিশ্বেও প্রাসঙ্গিক। সামাজিক ভারসাম্য ও আদর্শভিত্তিক রাষ্ট্র গঠনে তার প্রণীত নীতিমালার কোনো বিকল্প নেই।

মদিনায় হিজরতের পর নবী করিম সেখানে বসবাসকারী ইহুদি, খ্রিস্টান এবং মূর্তি পূজকদের সঙ্গে মুসলিম সম্প্রদায়ের সহাবস্থানের জন্য একটি সনদ প্রণয়ন করেন। ইতিহাসে তা ‘মদিনা সনদ’ নামে পরিচিত। এর মাধ্যমে তিনি রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতার পরিচয় দেন। ধর্মীয় এবং সামাজিক জীবনেও এই সনদের প্রভাব বিস্তৃত ছিল। দ্বিধাবিভক্ত মদিনাকে তিনি গেঁথেছিলেন এক সুতোয়। গৃহযুদ্ধে লিপ্ত মদিনাবাসীকে জড়ো করেন শান্তি ও সম্প্রীতির ডোরে। জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সব মুসলমান ও ইহুদি নাগরিকদের সমান অধিকার ও কর্তব্য নির্ধারণ করেন। মুসলমান ও অমুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে মৈত্রী, সদ্ভাব ও পরস্পর সহযোগিতার ভিত্তিতে বন্ধুত্ব ও প্রীতির সম্পর্ক গড়ে তোলেন।

মদিনা সনদের আলোকে গড়ে ওঠা ঐতিহাসিক মদিনা রাষ্ট্রের আবেদন আজও ফুরিয়ে যায়নি। বর্তমান সমস্যাসংকুল এই বিশ্বে, গভীর সংকটে আবর্তিত সমাজ ও রাষ্ট্রের উত্তরণ ঘটতে পারে একমাত্র মদিনা সনদের আলোকেই। ঐতিহাসিক সেই ৪৭টি ধারা অনুসরণ করলে আমাদের দেশের রাজনীতি, রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যাপকভাবে উপকৃত হতে পারে। মদিনার সনদের পরতে পরতে শান্তি, সম্প্রীতি, সহাবস্থান, মানবাধিকার ও ধর্মীয় গোঁড়ামি পরিহারের যে বারতা রয়েছে তা অনুসরণ করলে আমরাও লাভ করতে পারি বহুল কাঙ্ক্ষিত একটি কল্যাণ রাষ্ট্র। সামগ্রিক জীবনধারা নবীর আদর্শে গড়ে তোলার মধ্যেই রয়েছে প্রকৃত সফলতা।

পরিবর্তনশীল বিশ্বে নানা মতবাদ ও তন্ত্রমন্ত্রে আচ্ছন্ন বিশ্ববাসীর সামনে বিষয়গুলো নতুনভাবে তুলে আনায় পাকিস্তানের হবু প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে শুভেচ্ছা, সেই সঙ্গে অভিনন্দন তার বিজয়েও।