হজ ব্যবস্থাপনায় আমূল পরিবর্তন আসছে: ধর্মসচিব
মক্কা মোকাররমা ( সৌদি আরব) থেকে: আমরা হজ ব্যবস্থাপনায় আমূল পরিবর্তন আনতে যাচ্ছি। করতে যাচ্ছি হজ আইন। দেশে গিয়েই আশা করছি, কেবিনেটে নতুন আইনটা তুলতে পারবো। আর সেটা হলে, হজ ব্যবস্থাপনায় আরো গতি আসবে। হজযাত্রীদের অধিকারে সুরক্ষা যেমন বাড়বে, তেমনি নতুন আইনি কাঠামোর কারণে হাজী সাহেবদের অনেক দূর্ভোগও কমে যাবে। আরেকটি বিষয় জানাতে চাই, মন্ত্রণালয় নয়- হজযাত্রী নিয়ে পূর্ণাঙ্গভাবে কাজ করবে হজ অফিস।
সেই অফিসের কাঠামোও পরিবর্তন আনবো। নতুন প্রশাসনিক কাঠামোতে হজ অফিস বর্তমানে পরিচালক থেকে চলে যাবে মহাপরিচালকের দায়িত্বে। অতিরিক্ত বা যুগ্ম সচিব মর্যাদায় শতাধিক জনবলের মাধ্যমে তখন পরিচালিত হবে হজ অফিস।
সৌদি আরবের পবিত্র নগরী মক্কায় বাংলাদেশ হজ মিশনের দপ্তরে বসে একান্ত সাক্ষাতকারে বার্তা২৪.কমকে এমনটাই বলছিলেন ধর্মসচিব মো. আনিসুর রহমান।
চলতি হজ মৌসুমে ব্যবস্থাপনা সদস্যসহ বাংলাদেশ থেকে আসা হজযাত্রীর সংখ্যা ১ লাখ ২৭ হাজার ২৯৮ জন। এরই মধ্যে ৭১ জন চলে গেছেন না ফেরার দেশে। সোয়া লাখের বেশি হজযাত্রীর সুযোগ-সুবিধা দেখতে হজের পূর্ব মূহুর্ত থেকে মক্কায় অবস্থান করছেন বিসিএস (প্রশাসন) ১৯৮৫ ব্যাচের কর্মকর্তা আনিসুর রহমান।
সচিব হিসেবে ২০১৭ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর থেকে ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে শরিয়তপুর জেলার সন্তান আনিসুর রহমান। এর আগে একই মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিবের দায়িত্ব পালন করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল বিভাগ থেকে সম্মান ও মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করা মেধাবী সরকারি এই কর্মকর্তা স্থানীয় সরকার বিভাগ, অর্থ বিভাগ, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন পর্যায়ে দায়িত্ব পালন করেছেন।
এবারের হজ মৌসুমের সার্বিক চিত্রটা কেমন দেখছেন?
এখন পর্যন্ত সন্তোষজনক। সৌদি ধর্ম মন্ত্রণালয় পর্যন্ত আমাদের ব্যবস্থাপনার প্রশংসা করেছে। আমি এখানে আমাদের কর্মকর্তাদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করেছি। আমাদের লক্ষ্য, হাজীদের সেবার মান যাতে কোথাও কমতি না হয়। তারা আল্লাহর মেহমান। তাদের যেন কোথাও কষ্ট না হয়।
তবে মিনা থেকে হাজী সাহেবরা হজের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে মক্কায় ফিরে আসার পর পরিস্থিতিটা আর বিশদভাবে বোঝা যাবে।
এখানে ফেতরা পদ্ধতির কারণে এক বাড়িকে ৫ থেকে ৬ বার ভাড়া দেওয়া হয়। এটা এখানে স্বীকৃত, কিন্তু কষ্টটা হয় হাজীদের। যেমন ধরেন, হজে আসার আগে আপনাকে বলা হলো, কাবা শরিফের কাছে জমজম টাওয়ার বা হিলটনের মতো হোটেলে রাখা হবে।
তারা সেটা রাখবে ঠিকই, তার আগে বা পরে আপনাকে দূরে কোনো হোটেলে রাখবে। এসব বিষয়ে আগে অনেক অভিযোগ ছিলো। আমাদের মনিটরিংয়ের কারণে এখন কমে এসেছে। হজ এজেন্সিজ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (হাব) নেতাদের বলেছি, দেশে যেভাবে আমাদের সহায়তা করেছেন, এখানেও সেটা বজায় রাখুন। যারা হাজীদের দূর্ভোগ সৃষ্টি করবে তাদের আগেভাগেই সর্তক করে দিন।
আরেকটি বিষয়, জেদ্দা বিমানবন্দর থেকেই কিন্তু হাজীদের ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব স্থানীয় মোয়াল্লেমদের। যারা আবার মোয়াচ্ছাসাদের নিয়ন্ত্রণে। হাজীদের মক্কায় যেমন যাতায়াতের দায়িত্বে ইউনাইটেড কার এজেন্সি তেমনি মদিনায় দায়িত্বে আদিল্লা নামের সংস্থার।
২০১৬ সালে আমি যখন হজে আসি তখন কিন্তু আমাকে অতিরিক্ত দুই ঘন্টা গাড়িতে ঘুরতে হয়েছিলো। কারণ অতিরিক্ত আয়ের জন্যে হজ মৌসুমে মিসর থেকে অনেক চালক আসেন। যারা এখানকার পথ বা হোটেল ঠিকমতো চেনেন না।
এ ধরনের ব্যবস্থাপনায় কিন্তু আমাদের কোনো এজেন্সির নিয়ন্ত্রণ নেই।
এবার মিনায় গতবারের তুলনায় আমাদের ৩০ ভাগ কম জায়গা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। অথচ হাজীর সংখ্যা কিন্তু বেড়েছে। যদিও সে তুলনায় বাড়েনি মিনার জায়গার পরিধি। এবার তাঁবুতে হাজী প্রতি ১৮ ইঞ্চির বদলে ১৬ ইঞ্চি জায়গা বরাদ্দ পাওয়া গেছে। সৌদি কর্তৃপক্ষ স্থান সংকুলানের জন্যে মিনায় দোতলা, তিন তলা খাটের ব্যবস্থার কথা বলেছিলো।
আমরা তাতে সাড়া দেইনি। আমরা বলেছি, এটা আমাদের সংস্কৃতির সঙ্গে সঙ্গতিহীন। এক জনের ওপর আরেকজন শোয়া কেউ পছন্দ করবে না। তবে পরিস্থিতি যেমন দাঁড়িয়েছে তাতে ভবিষ্যতে দুই বা তিনস্তর বিশিষ্ট খাটের বিকল্পও নেই।
মিনা, আরাফা আর মুজদালিফায় যে ধরণের খাবার সরবরাহ করা হয়, তা আমাদের দেশের মানুষ খেতে পারেন না। আমরা বলেছি, বাংলাদেশিরা পছন্দ করে- এমন খাবার যাতে পরিবেশন করা হয়।
আমরা হজ নীতিতে পরিবর্তন আনছি। আইনি কাঠামো নিশ্চিত করতে হজ আইন প্রণয়ণ করতে যাচ্ছি। এখন সব কিছুই করা হয় নির্বাহী আদেশে। আমরা ধরেই নেই, আইন না থাকার দূর্বলতার সুযোগ নিয়ে আমাদের নেওয়া পদক্ষেপের বিরুদ্ধে অনেকে আদালতে যাবে।নীতি দিয়ে কাউকে ধরা বাঁধা কঠিন। তবে আইনের অবস্থান সবার ওপরে। আইন থাকলে এজেন্সির প্রতারণাগুলো যেমন কমে আসবে আবার আইনগত বাধ্যবাধকতার কারণে অনিয়ম দূর হবে।
হজ প্রশাসনিক বা সহায়ক দলে কে বা কারা থাকবে তা নির্ধারিত হবে এই আইনে। যার অধীনে শক্তিশালী প্রশাসনিক কাঠামো থাকবে হজ অফিসের। মন্ত্রণালয় নীতি প্রণয়ণ করবে, হজ অফিস তা বাস্তবায়ন করবে। আমাদের ইচ্ছে, হজ সহায়ক কর্মী ভবিষ্যতে সৌদি আরবের প্রবাসীদের মাঝ থেকে নেওয়া। এতে করে হাজীদের সুবিধা আরো বাড়বে।
এবার হজে প্রশাসনিক দলের সদস্য হয়ে যারা এসেছেন, তারা আগে থাকতেন মিশনে। এবার সরকারিভাবে আসা হাজীদের হোটেলে তাদের অবস্থান বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। যে কারণে হাজীদের যেকোনো ধরনের সুবিধা-অসুবিধা তারা যেমন তাৎক্ষনিক জানতে পারছে, তেমনি সমাধানটাও করতে পারছে দ্রুত।
এভাবেই হজ ব্যবস্থাপনায় আমাদের পরিবর্তনটা আজ সৌদি কর্তৃপক্ষের কাছেও প্রশংসিত।