ফেনী নদী থেকে একতরফা পানি তুলে নিচ্ছে ভারত
রামগড়-ফটিকছড়ি-মিরসরাই সীমান্তবর্তী ফেনী নদী থেকে একতরফা পানি তুলে নিচ্ছে ভারত। কোনো ধরনের চুক্তি ছাড়াই ভারত ফেনী নদীতে উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন পাম্প বসিয়ে পানি তুলছে।
জানা গেছে, ভারতের দক্ষিণ ত্রিপুরার সাবরুম মহকুমার ১৭টি সীমান্ত পয়েন্টের নো-ম্যান্স ল্যান্ডে বিদ্যুৎচালিত উচ্চ ক্ষমতার প্রায় ২৫টি লো-লিফট পাম্প স্থাপন করে এ নদী থেকে পানি তুলে নিয়ে যাচ্ছে তারা। এ নিয়ে বিভিন্ন সময় বাংলাদেশ থেকে আপত্তি জানানো হলেও কর্ণপাত করছে না ভারত।
পানি উত্তোলন বন্ধে বিএসএফকে আনুষ্ঠানিকভাবে চিঠি দেওয়ার পাশাপাশি তাদের সঙ্গে বৈঠকও করেছে বিজিবির প্রতিনিধি দল। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মাহমুদুল ইসলাম বার্তা২৪.কমকে জানান, ফেনী নদী থেকে পানি না নেয়ার জন্য ভারতকে বেশ কয়েকবার চিঠি দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের উচ্চ পর্যায়ে আলাপ আলোচনা চলছে।
তিনি বলেন, ‘ভারত শুষ্ক মৌসুমে পানি তুলে। ফেনী নদীর পানি দিয়ে তারা চাষাবাদ ও স্থানীয় জনসাধারনের খাবার পানির চাহিদা পূরণ করে। কিন্তু পানি তোলার ক্ষেত্রে আমাদের আপত্তি আছে বলে তাদের জানিয়েছি।’
এদিকে ভারত ফেনী নদী থেকে পানি তুলে নিয়ে যাওয়ায় হুমকিতে পড়ছে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সেচ প্রকল্প 'মুহুরি প্রজেক্ট'। বিশেষ করে নদীতে পানি কমে গেলে শুষ্ক মৌসুমে ভয়াবহ সংকট সৃষ্টি হয়। পানির অভাবে বন্ধ হয়ে যায় চাষাবাদ।
বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্র জানায়, ফেনী নদী থেকে এক দশমিক ৮২ কিউসেক পানি নিতে চাইছে ভারত। বিষয়টি বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনার পর্যায়ে রয়েছে। তবে এ ব্যাপারে চুক্তি হওয়ার আগেই নিয়মিত পানি তুলে নিচ্ছে তারা। ফেনী নদী ১১৬ কিলোমিটার দীর্ঘ। বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে এ নদী রয়েছে প্রায় ৭০ কিলোমিটার জুড়ে।
খাগড়াছড়ির রামগড় ও ভারতের দক্ষিণ ত্রিপুরার সাবরুম পাশাপাশি এলাকা।
সরেজমিনে দেখা গেছে, নদীর প্রবাহ থেকে ৩০-৩৫ গজ দূরে পাম্প হাউস স্থাপন করে পানি নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। পাম্প হাউস থেকে নদীর পানির ধারা পর্যন্ত মাটির নিচ দিয়ে ৭-৮ ইঞ্চি ব্যাসের পাইপ লাগানো হয়েছে। এর মাধ্যমে পানি তুলে সাবরুম মহকুমার বিস্তীর্ণ এলাকায় সেচের মাধ্যমে চাষাবাদ করছে ভারত। দক্ষিণ ত্রিপুরার অমরপুরের শিলাছড়ি থেকে সাবরুমের আমলীঘাট পর্যন্ত পাম্প হাউসগুলো স্থাপিত হয়েছে। সেগুলোকে বেশিরভাগ বাংলাদেশের রামগড়ের সীমান্তবর্তী লাচারিপাড়া থেকে মিরসরাইয়ের অলিনগরের বিপরীত দিকে অবস্থিত।
রামগড় এলাকার স্থানীয় সমাজকর্মী নিজাম উদ্দিন বার্তা২৪.কমকে জানান, বাংলাদেশের বাধা উপেক্ষা করে বছরের পর বছর পানি নিয়ে যাচ্ছে ভারত। এতে বাংলাদেশের রামগড়, ফটিকছড়ি ও মিরসরাইয়ের সীমান্তবর্তী এলাকার হাজার হাজার একর জমিতে পানির অভাবে চাষাবাদ করা যাচ্ছে না। নষ্ট হয়ে যাচ্ছে শত শত ফলের বাগান। এ কারণে পথে বসার উপক্রম হয়েছে এলাকার কৃষকদের। একইভাবে পানির অভাবে হুমকির মুখে পড়ছে মিরসরাইয়ের 'মুহুরি প্রজেক্ট'ও। শুষ্ক মৌসুমে পানি নিয়ে যাওয়ায় ধু-ধু চরে পরিণত হয় ফেনী নদী।
যোগাযোগ করা হলে চট্টগ্রামের জেলা প্রসাশক মোহাম্মদ ইলিয়াছ হোসেন বার্তা২৪.কমকে জানান, ফেনী নদীসহ অভিন্ন নদীগুলো নিয়ে ভারতের সঙ্গে আলোচনা চলছে।
তিনি বলেন, ‘আমার জানা মতে, ভারতের সাবরুমে বিএসএফের সঙ্গে বৈঠক করেছে বিজিবির প্রতিনিধি দল। কিন্তু কোনো ধরনের সুফল আমরা এখনো পাচ্ছি না।’
বিজিবি গুইমারা সেক্টর কমান্ডার আবদুল হাই বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘নদীর বিভিন্ন পয়েন্টে কমপক্ষে ২০টি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন পাম্প স্থাপন করে পানি তুলে নিচ্ছে। পানি উত্তোলন বন্ধ করতে বিজিবির পক্ষ থেকে তাদের চিঠি দেওয়া হয়েছিল। বৈঠক হয়েছে। পরে বিষয়টি যৌথ নদী কমিশনকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমরা আর এ বিষয় নিয়ে কাজ করছি না।’
আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী সীমান্ত থেকে ১৫০ গজের মধ্যে কোনো স্থায়ী অবকাঠামো নির্মাণ অবৈধ। আইন অমান্য করে নো-ম্যান্স ল্যান্ডে অবকাঠামো নির্মাণ করে পানি নিয়ে যাচ্ছে ভারত। ২০০৩ সালে বিএসএফের পাহারায় সীমান্ত এলাকার যতীচরের বিপরীতে নদীর জলসীমা থেকে মাত্র ৩০ গজ দূরে প্রথম একটি পাম্প হাউস স্থাপন করে ভারত। সে সময় বিডিআর (বর্তমানে বিজিবি) বাধা দিলে বিএসএফ তাদের ওপর গুলি ছুড়েছিল।
পরে ভারতের আমলীঘাট, কৃষ্ণনগর, হুয়াংবাড়ি হয়ে সমরগঞ্জ পর্যন্ত ১২ কিলোমিটার সেচ ও সাবরুম মহকুমা এলাকায় পানি সরবরাহের জন্য একটি প্রকল্প নেয় ভারত। ৩৬ ইঞ্চির একটি পাইপ লাগিয়ে পানি নেওয়ার চেষ্টা করলে বিডিআর বাধা দেয়। তখন পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নদীরতীর সংরক্ষণ কাজ বন্ধ করে দেয় বিএসএফ। ২০১০ সালে দু'দেশের সচিব পর্যায়ে বৈঠকে এক দশমিক ৮২ কিউসেক পানি দিতে সম্মত হয় বাংলাদেশ। এরপর কাজ করতে দেয় ভারত। তবে ভারত ৫ মিটার ব্যাসের ও ২০ মিটার গভীর পাকা কূপ নির্মাণ করে সিসি পাইপ বসিয়ে পানি নিতে চাইলে রাজি হয়নি বাংলাদেশ। পরবর্তীতে ২০১৬ সালে ২৭ সেপ্টেম্বর দু’দেশের মধ্যে পুনরায় বৈঠক হয়। কিন্তু কোনো ধরনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়নি।