চিরবিদায় স্মরণীয় সম্পাদক
সম্পাদকদের এক ধরনের চলমান চ্যালেঞ্জের মধ্যে থাকতে হয়। তাদের সেই চ্যালেঞ্জের সঙ্গে এসে যুক্ত হয় এক প্রকারের যন্ত্রণাবোধ, বিশেষ করে, যে সম্পাদকের মধ্যে লেখকসত্ত্বা থাকে, তাকে বাস করতে হয় চ্যালেঞ্জ আর যন্ত্রণার যুগল আচ্ছাদনের চেতনা প্রবাহে। চ্যালেঞ্জ ও যন্ত্রণা আর কিছু নয়, আসলে তা হলো, প্রার্থিত শব্দকে মননের রসে ডুবিয়ে কলমের ডগায় নিয়ে আসার কিংবা শিরোনামে তুলে ধরার দ্বৈরথ।
সদ্য প্রয়াত গোলাম সারওয়ার সম্পাদকের চ্যালেঞ্জ ও যন্ত্রণার দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে 'হেডিং মাস্টার' বা 'মেকাপ মাস্টার' বলে পরিচিতি পেয়েছিলেন প্রার্থিত শব্দকে মননের রসে ডুবিয়ে কলমের ডগায় নিয়ে আসার সাফল্যের পথ ধরে। বার্তা, নির্বাহী বা মূল সম্পাদক পদে থেকেও 'আষাঢস্য প্রথম দিবসে' কিংবা 'ফুল ফুটুক না ফুটুক, আজ বসন্ত' ধরনের সাহিত্যগন্ধী কিছু রিপোর্ট তিনি প্রতিবছরই স্বনামে লিখেছেন, যেখানে আবেগ, ভাষা ও রস সঞ্চারের সুযোগকে কাজে লাগানোর প্রচেষ্টা লক্ষ করা যেত।
ষাট দশক থেকে সাংবাদিকতায় থাকলেও গোলাম সারওয়ারের সামনে নিজেকে পূর্ণ বিকশিত করার সুযোগ উন্মোচিত হয় মধ্য আশির দশকে ইত্তেফাক ভবনে। দৈনিক সংবাদ থেকে ইত্তেফাক হাউসের সিনে কাগজ পূর্বাণীর হাত ধরে সুযোগগুলো তিনি সক্ষমতার সঙ্গে কাজেও লাগান তখন, যার শীর্ষবিন্দু তিনি স্পর্শ করেন কিছুদিনের মধ্যেই, তখনকার প্রধান দৈনিক ইত্তেফাকের কর্মজীবনে। তার জীবনের বাকী সময়টুকু ইত্তেফাক পর্বের সম্প্রসারণ।
সম্পাদকের চ্যালেঞ্জ ও যন্ত্রণার পাশাপাশি ভারসাম্যের পরীক্ষাটিও তিনি সফলতার সঙ্গে উত্তীর্ণ হওয়ার প্রমাণপত্র হাতে পান ইত্তেফাকের কালপর্বে। সাংবাদিক, কর্মচারী ও প্রেস ইউনিয়নের সম্মিলিত শক্তির সাংগঠনিক প্রাধান্যের সুযোগে তিনি মালিক পক্ষের ক্রমবর্ধিষ্ণু অসহিষ্ণুতাকে সামাল দেওয়ার সাফল্য দেখিয়ে ছিলেন। নানামুখী চাপের মধ্যেও ভারসাম্যপূর্ণ নিউজ রুমের অবয়বটি শেষ পর্যন্ত ধরে রাখতে পেরেছিলেন তিনি।
ইত্তেফাকের স্বর্ণযুগের সিরাজুদ্দীন হোসেন বা আসফউদ্দৌলাহ রেজার সঙ্গে গোলাম সারওয়ারের তুলনা করা চলে না। অগ্রণীরা যে ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালনের সুযোগ ও প্রেক্ষাপট পেয়েছিলেন তেমনটি তিনি পান নি। তিনি ছিলেন একটি স্থির, অসঙ্কুল, নিস্তরঙ্গ সময়ের পেশাজীবী সাংবাদিক। ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালনের জাতীয় ক্রান্তিকাল বলতে যে মহাপ্লাবনসম পরিস্থিতিকে গণ্য করা হয়, তার পেশাজীবনের তেমন ঘটনাপ্রবাহ আসে নি।
বরং তিনি পেয়েছিলেন বাংলাদেশের সংবাদপত্র জগত ও মিডিয়া মানচিত্রের পালাবদলের যুগান্তকারী সময়কাল। প্রযুক্তি ও প্রকরণে সংবাদপত্র ও সংবাদমাধ্যম যখন আমূল বদলে যাচ্ছিল, প্রিন্ট মিডিয়ার মৃত্যু ঘণ্টা বাজিয়ে যখন অনলাইন ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার যুগভেরী বেজেছিল, তখন তিনি ছিলেন তেমন একটি স্বর্ণগর্ভা পরিস্থিতির অংশ।
সেই পরিস্থিতিতে তিনি নিশ্চুপ ছিলেন না। ট্র্যাডিশনাল মুদ্রিত দৈনিক নিয়ে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। পাতার সংখ্যা, বিষয়ের বৈচিত্র, মুদ্রণের সৌকর্ষ বাড়িয়ে তিনি শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করেছেন ছাপানো কাগজের অস্তিত্ব ও পাঠক ধরে রাখতে। আশ্চর্যের বিষয় হলো, মুদ্রিত কাগজের শেষ লগ্নের লড়াইয়ে ইত্তেফাক ছেড়ে যুগান্তর বা সমকাল যেখানেই গিয়েছেন, সেখানেই আপাত সফল হয়েছে তিনি। শেষ মুঘলের মতো তিনি প্রথাগত দৈনিকের জীবন বাঁচাতে যে আপ্রাণ প্রচেষ্টা নিয়েছেন, ইতিহাস একদিন তা মূল্যায়ন করবে।
হয়ত পরিবর্তমান মিডিয়া বিন্যাসের সমকালীন-জাতক অনলাইন ও ইলেক্ট্রোনিক ভার্সানের অগ্রসরতার তোড়ে তিনি থেকে যাবেন প্রথাগত ছাপানো সংবাদপত্রের কাফেলায়, তথাপি তাঁর সম্পাদকীয় চ্যালেঞ্জ ও যন্ত্রণাজাত আর্তি থেকে উৎসারিত প্রার্থিত শব্দকে মননের রসে ডুবিয়ে কলমের ডগায় নিয়ে আসার কিংবা শিরোনামে তুলে ধরার কৃতিত্বকে অস্বীকার করা যাবে না। তাঁর স্মরণে মনে পড়বে সংবাদ ও সাহিত্যের মেলবন্ধনে রচিত প্রাচীন প্রেমের কথা। মনে পড়বে মিডিয়া বাস্তবতায় অধুনা লুপ্ত হয়ে যাওয়া একটি প্রবচন, যা আসলে কবি বিষ্ণু দে'র একটি কাব্যগ্রন্থের শিরোনাম (১৯৬৯ সালে প্রকাশিত এবং শামসুর রাহমান ও আবু বকর সিদ্দিককে উৎসর্গীকৃত) এবং সাংবাদিক গৌর কিশোর ঘোষের প্রিয় উচ্চারণ। কথাটি হলো, 'সংবাদ মূলত কাব্য'।
গোলাম সারওয়ারের মৃত্যুতে বাংলাদেশে এই কথাটি অর্থবহ করার মতো আর কেউ রইলেন না! তাঁর মৃত্যুতে যেন বা অম্তর্হিত হলো প্রাচীন উক্তিটিরও। চিরবিদায় স্মরণীয় সম্পাদক গোলাম সারওয়ার, বাংলাদেশের সংবাদপত্র জগত আপনাকে ভুলবে না।
আরও পড়ুন, সমকাল সম্পাদক গোলাম সারওয়ার আর নেই