'শরৎ, তোমার অরুণ আলোর অঞ্জলি'
কবিগুরু শরৎ প্রেমে মুগ্ধ হয়ে লিখেছেন, 'শরৎ, তোমার অরুণ আলোর অঞ্জলি, ছড়িয়ে গেল ছাপিয়ে মোহন অঙ্গুলি। শরৎ, তোমার শিশির-ধোয়া কুন্তলে বনের-পথে-লুটিয়ে ।' ভাদ্র মাস দিয়ে সেই শরতে সূচনা হলো বৃহস্পতিবার (১৬ আগস্ট) প্রত্যুষে।
শরৎ বাংলাদেশের কোমল, স্নিগ্ধ, স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল এক ঋতু। মূলত বাংলাদেশের ছয়টি ঋতুই ছয়টি ভিন্ন ভিন্ন রূপের পসরা দিয়ে সজ্জিত। তবে গ্রীষ্ম ও শীতের মাঝখানে শরৎ অনন্য ও অনুপম।
বৈচিত্রময় বাংলাদেশে এক-একটি ঋতুতে ভিন্ন ভিন্ন ফুলে ও ফলে, ফসলে ও সৌন্দর্যে সেজে ওঠে প্রকৃতি। পৃথিবীর আর কোনও দেশের প্রকৃতিতে ঋতুবৈচিত্র্যর এমন সম্ভার বিরল। ঋতুবৈচিত্রে বাংলাদেশ এক অপার সৌন্দর্যভূমি।
ঋতু পরিক্রমায় বর্ষা অশ্রুসজল চোখে বিদায় নেয় শ্রাবণে। তারপর ভাদ্রের চোখে সূর্য মিষ্টি আলোর স্পর্শ নিয়ে প্রকৃতি ঘোষণা করে শরতের আগমন বার্তা। থেমে যায় বর্ষামেঘের কাজল-কালো বুকের ভেতর দুঃখজলের বর্ষণ। আসে ঝকঝকে নীল আকাশে শুভ্র মেঘ, ফুলের শোভা আর শস্যের শ্যামলতা।
আলোয়, রঙে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে শরৎ। প্রকৃতির কন্ঠে কন্ঠে মিলিয়ে কবিকণ্ঠ ঘোষণা করে: ‘আজি ধানের খেতে রৌদ্র ছায়ায়/ লুকোচুরির খেলা/ নীল আকাশে কে ভাসালে/ সাদা মেঘের ভেলা ’
ভাদ্র-আশ্বিন এ দুই মাস বাংলাদেশে শরৎকাল। ঋতুবৈশিষ্ট্যে শতের সৌন্দর্য বাংলার প্রকৃতিকে করে রূপময়। গাছপালার পত্রপল্লবে প্রদোষকালীন গুচ্ছ গুচ্ছ অন্ধকার ফিকে হয়ে আসতেই পাখপাখালির দল মহাকলরবে মাতায়। প্রভাতে আবার ডানা মেলে উড়ে যায় নীল আকাশে। আকাশের উজ্জ্বল নীলিমা শরতের বিশেষ উপহার, সে দিগন্তময় আকাশের প্রান্ত ছুঁয়ে মালার মত উড়ে যায় পাখির ঝাঁক।
আকাশে শরতে শিমুল তুলোর মতো ভেসে চলে বৃষ্টিহীন সাদা মেঘের খেয়া। চারদিকে সজীব গাছপালার ওপর বয়ে যায় শেফালিফুলের মদির গন্ধভরা ফূরফুরে মিষ্টি হাওয়া। শিউলি তলায় হালকা শিশিরে ভেজা দূর্বাঘাসের ওপর চাদরের মত বিছিয়ে থাকে সাদা আর জাফরন রং মেশানো রাশি রাশি শিউলিফুল। শরতের ভোরের এই সুরভিত বাতাস মনে জাগায় আনন্দের বন্যা। জীবনে জাগে উষ্ণ ও শীতলতার মাঝামাঝি রোমাঞ্চকর আমেজ।
শরতের সূর্য ওঠে স্বর্ণপ্রভায়। তসপহীন নির্মল আলোয় ভরে যায় চরাচর। গ্রাম-বাংলার মাঠে মাঠে উচ্ছ্বসিত ধানের সবুজ চারার ওপর ঢেউ খেলে যায় উদাসী হাওয়া।বআদিগন্ত সবুজের সমারোহে দেখা পাওয়া যায় প্রকৃত রূপসী বাংলার। । কাশবনের সাদা কাশফুল শারদীয় হাতছানিতে ডাকে: ‘পুচ্ছ তোলা পাখির মতো/কাশবনে এক কন্যে/তুলছে কাশের মযূর-চূড়া/কালো খোঁপার জন্যে।’
চিরায়ত সুন্দর শরতে নদীর বুকে রঙিন পাল তুলে মালবোঝাই নৌকা চলে। মাঝি হয়তো গেয়ে ওঠে ভাটিয়ালি গান। পুকুরপাড়ে আমগাছের ডালে মাছরাঙা ধ্যান করে। স্বচ্ছ জলে পুঁটি, চান্দা বা খলসে মাছের রূপালি শরীর ভেসে উঠলে সে ছোঁ মেরে তুলে নেবে তার লম্বা ঠোঁটে। নদীর চরে চখাচখি, পানকৌড়ি, বালিহাঁস বা খঞ্জনা পাখির ঝাঁক খেলা করে। কলসি কাঁথে মেঠো পথে হেঁটে চলে গাঁয়ের বধূ। ছবির মতো মনে হয় রূপসী শরতকে।
শরতের এক বিশেষ ছবি দেখা যায় বিলের জলে। নক্ষত্রের মতো ফুটে থাকে সাদা ও লাল শাপলা। সকালের হালকা কুয়াশায় সেই শাপলা এক স্বপ্নিল দৃশ্যের দ্যোতনা জাগায়।
শরতের স্নিগ্ধ মনোরম প্রকৃতি তাপিত মানবজীবনেও আনে প্রশান্তির আমেজ। শহরের মানুষও অবকাশ নিয়ে শরতের মনোরম প্রকৃতি উপভোগ করার জন্য গ্রামের বাড়িতে ছুটে যায়। নীল আকাশের সাদা মেঘের ভেলা আর নদী তীরের সাদা কাশফূল আর ভোরের হালকা শিশির ভেজা শিউলি ফুলে অমলি শরৎ যেন শুভ্রতার ঋতু।
শরৎকালে রাতের বেলায় জ্যোৎস্নার রূপ অনিন্দ্য প্রভায় ঝিকমিক করে। মেঘমুক্ত আকাশে মনে হয় কল্পকথার পরীরা ডানা মেলে নেমে আসে নশ্বর পৃথিবীতে। শরতের জ্যোৎস্নার মোহিত রূপ নিজ চোখে না দেখলে বোঝা যায় না ।
শরৎ বাংলার ঋতু পরিক্রমায় সবচেয়ে মোহনীয় ঋতু । নরম, কোমল, মায়াবী স্পর্শে দোলা দেয় শরৎ। অরুণ আলোর অঞ্জলিতে ভরে সমগ্র প্রকৃতি ও মানুষের অন্তর-বাহির।